সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : ভৈরব বাজারের কাপড় পট্টিতে রাস্তার সামনে ৩০ বছর যাবত শুধু মাত্র গামছা বিক্রি করে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন যাপন করছেন ৫০ বছর বয়সী হরিসাধন সর্মা। বর্তমানে বিক্রি আগের মতো নেই, নেই মুনাফাও। তবুও এই ব্যবসাই তার জীবনের সবকিছু। 

তার মতই ভৈরবপুর উত্তর পাড়ার ৫০ বছর বয়সী মো. মাসুম মিয়া ওরফে মানিক মিয়া ভৈরব বাজারের লঞ্চ ঘাটে ২৫ বছর যাবত চিতই পিঠা বিক্রি করে জীবন চালাচ্ছেন। তার এই ছোট্ট পিঠার দোকান থেকেই ৪ ছেলে মেয়ের সংসারের সমস্ত কিছুর ব্যায় নির্বাহ হয়।

ভৈরব বাজারে এক চক্কর দিলে যে কোনো একটা মোড়ে আপনার দেখা হয়ে যাবে ৪৫ বছর বয়সী ডিম বিক্রেতা নাসিরের মিয়ার সঙ্গে। প্রায় দুই দশক যাবত তিনি সিদ্ধ ডিম বিক্রির পেশায় জড়িত। সকাল থেকে রাত অবদি সমস্ত বাজার ঘুরে ঘুরে গড়ে প্রতিদিন প্রায় শতেক ডিম বিক্রি করেন তিনি। দৈনিক তার গড় আয় ৫০০ টাকার মতো। দুই সন্তানের সংসারের সব সুখ-দুঃখের স্বাদ মিটে নাসিরের এই ডিম বিক্রির আয় দিয়েই।

তাদের মতই কেউ আবার দীর্ঘদিন মুচি, কেউ বাবুর্চি, কেউ বাদাম, নারিকেল বা ডাব বিক্রেতা, কেউ আবার ঠেলাগাড়ি বা রিকশা চালক, কেউবা কুলি বা শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন যাপন করছেন। তাদেরও একটি অর্থনীতি রয়েছে। সেই অর্থনীতিরও একটা শক্তি আছে। আছে প্রভাব ও গুরুত্ব।

স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল সূবর্ণজয়ন্তী উদযাপন শেষে শতকের পথে স্বদেশের যাত্রার বর্ণিল ক্ষণে নতুন বছরের প্রথম কার্যদিবসে এনআরবিসি ব্যাংক লিমিটেড এর ভৈরব বাজার উপ শাখা নিম্ন আয়ের এরকম ৫১ জন শ্রমজীবি মানুষদের সম্মানে বিশেষ সম্মাননা দেওয়ার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

আয়োজনে অংশগ্রহণকারী একজন কাচারী রোডের ডাব ও নারিকেল ব্যবসায়ী ৭৫ বছর বয়সী আলী আকবর ভূইয়া। ব্যাংকের পক্ষ হতে অভূতপূর্ব সম্মাননা পেয়ে উনি বেশ উচ্ছ্বাসিত। তিনি বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষরা বিভিন্ন কারণে ব্যাংকমুখি নয়। আমাদের পেশাকে সম্মান জানিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের এই রকম অনুষ্ঠান সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

আয়োজনটির সাথে ভার্চুয়ালী সংযুক্ত ছিলেন ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। এই সময় তিনি নিম্নবিত্তের অর্থনীতিকে যথাযথ সম্মান ও আনন্দের সহিত ব্যাংকিং চ্যানেলে সংযুক্তির এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগকে স্বাগত জানান।

তিনি বলেন, নিম্ন আয়ের তথা প্রান্তিক জনগোষ্ঠির ঘাম ঝরানো স্বচ্ছ ও সততার মোড়কে আচ্ছাদিত জীবনটাকে যদি সমৃদ্ধ করা যায়, শাণিত করা যায় তবেই স্বার্থক হয়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা গড়ার প্রচেষ্টা’।
ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের উদ্যোক্তা উপশাখার ইনচার্জ রকিবুল হাসান বলেন, নিম্নবিত্তের অর্থনীতিকে অবহেলা করে দেশের অর্থনীতির প্রবাহকে শক্তিশালী করা যাবে না। ব্যাংকের মাননীয় চেয়ারম্যান তমাল পারভেজ স্যারের উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায় এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র কিন্তু সৎ ও স্বচ্ছ অর্থনীতির পাশে আমরা দাড়াতে চাই। শতকের পথে স্বদেশের যাত্রায় মেহনতির মানুষদের এই সব প্রচেষ্টা গুলো নতুন প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠুক অনুপ্রেরণার অবারিত উৎস।

ব্যাংক কর্মকর্তা ইসতিয়াক আহমেদ ও ইমরুল কায়েস খান বলেন, এই শাখায় কর্মরত থাকার কল্যাণে বছরের শুরুতেই ভালো একটি কর্মদিবসের সাক্ষী হতে পেরেছি। বিষয়টি বেশ ভালো লাগার। এতে আমরা বেশ আনন্দিত এবং গর্ববোধ করছি। এমনকি আমাদের মত আমাদের ব্যাংকের অন্যান্য কর্মীরা এই আয়োজনটিতে স্বাগত জানিয়েছে। ব্যতিক্রম উদ্যোগটির কথা জেনে দিনব্যাপী স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও ব্যাংকে গিয়ে উদ্যোগের প্রশংসা করেন এবং আতিথেয়তা গ্রহণ করেন।

দিনব্যাপী আয়োজনটিতে শ্রমজীবি মানুষদের জন্য শাখার প্রবেশপথে অভ্যর্থনা গেইট সহ লাল গালিচা বিছানো হয়। ভেতরের সাজসজ্জায়ও আনা হয়েছিল বণার্ঢ্যতা। প্রবেশমাত্রই প্রত্যেক গ্রাহক ও শুভানুধ্যায়ীর হাতে লাল গোলাপ ও ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার ব্যাগ প্রদান করা হয়। এছাড়া সবাইকে মিষ্টি ও শীতের পিঠা-পুলি দ্বারা আপ্যায়িত করা হয়। ওইদিন শাখাটিতে নিম্ন আয়ের নানা পেশার অর্ধশতাধিক মানুষের ৬৩টি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়।

(এসএস/এসপি/জানুয়ারি ০৯, ২০২২)