রণেশ মৈত্র


২৫ মার্চ কাল রাতের বীভিষিকা আজও যাঁদের মনে আছে তাঁরা নিশ্চয়ই বলবেন, ঐদিন সারাদিন ধরে জাতির মানসিকতা যেমন ছিল-পর দিন ভোরে রাতের ঘটনার খবর নানাভাবে পেয়ে, সে ভাবনা স্বাভাবতত:ই বদলে গিয়েছিল। “বাঙালির হাতে ক্ষমতা দাও”, “বিজয়ী বঙ্গবন্ধুর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দিতে হবে”, “শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে বাধা দেওয়া চলবে না” জাতীয় শ্লোগানগুলি নিমেষেই যেন জাতি ভুলে গিয়েছিল -অন্তত: স্বল্পকালীন সময়ের জন্যে।

ঐ রাতের নারকীয়তা কখনও কেউ কল্পনা করে নি-তাই বীভৎসে খবরগুলিতে পাওয়ার আকস্মিকতা সকলরকে শুধু নিঘ্নিতই করে নি-দু’তিন দিনের জন্যে হলেও দেশের চাইতে যেন বড় হয়ে উঠেছিল “কে কোথায় আছে-কেমন আছে-বেঁচে আছে তো-দেশে থাকা যাবে তো?” এমন সব প্রশ্নই সকলকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। দেশ নিয়ে ভাববার মত মনের অবস্থা হারিয়ে ফেলেছিল।

সাতাশে মার্চও ঐ ভাবেই কাটালো। আটাশে মার্চে বেতার যোগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা শুনার পর মাথায় এলো তাই তো, বঙ্গবন্ধু তাহলে আছেন। সংবাদপত্র নেই, টেলিভিশন নেই, বেতারে খবর নেই-সে কী দুরসহ পরিস্থিতি।
স্থানে স্থানে, জেলায় জেলায়, মহকুমা-মহকুমায় ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে গেছেন ইতোমধ্যেই। ছাত্র যুবকেরা শুরু করেছে সশস্ত্র প্রতিরোধ ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঘুমন্ত শহরগুলিতে আসা পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে। কোথাও কোথাও সে যুদ্ধে বিজয়ও ঘটে গেল-বেশ কয়েকজন সি.এস.পি অফিসার, নানা উচ্চ সরকারি অবস্থানে থেকে অস্ত্র হাতে নেমে পড়েছেন শত্রু প্রতিরোধের অসম লড়াইএ।

লড়াইয়ে স্বল্পকালের জন্য হলেও প্রথম দফা বিজয় ঘটেছে অনেক স্থানে কিন্তু সে বিজয় ধরে রাখার মত আধুনিক অস্ত্র সরঞ্জাম অভাবে তরুণেরা দেশত্যাগ করতে সুরু করেন-ভারত থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিরেয় ফিরে এসে পাক-সেনার বিরুদ্ধে প্রবলতর যুদ্ধে নামার লক্ষ্যে।

বঙ্গবন্ধু কোথায়? সহসাই সে প্রশ্ন উচ্চারিত হতে থাকলো সর্বত্র। অকস্মাতৎ জানা গেল, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটক-২৬ মার্চ গভীর রাতে ৩২, ধানমন্ডী থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে সঙ্গোপনে আকাশ পথে তাঁকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তারও তো কোন প্রমাণ মিলছে না। কোথাও তা ছাপা হচ্ছে না। কোন রেডিও বলছে না। তাই গভীর আতংকের সৃষ্টি হলো সবার মনে সকল বাঙালির প্রিয় নেতা, যাঁকে এবং যাঁর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগকে নিয়ে নানা গুজবের মুখে।

না, গুজব নয়। শীঘ্রই তা প্রচারিত হলো কলকাতার, ভারতের, বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে, রেডিওতে ও টেলিভিশনে।
এবারে একদিকে আতংক সবার মনকে গ্রাস করলো-অপরদিকে জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করে পাকিস্তানকে পরাজিত করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনার দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার সুদৃঢ় শপথ।

বাংলাদেশ অবরুদ্ধ। সর্বত্র মিলিটারী তাদের ক্যাম্প-তাদের গাড়ি-তাদের অস্ত্রবাহী ট্রাক। কারা বাংলাদেশ চায় -কারা পাকিস্তানের বিরোধী মোটা দাগে তা তারা চূড়ান্তভাবে ঠিক করে নিয়েছে। যারা আওয়ামী লীগ করে তারা পাকিস্তান বিরোধী, যারা হিন্দু তারাও সবাই পাকিস্তানের দুশমন-বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী। কিন্তু যারা বিহারী, যারা অবাঙালি তারা পাকিস্তানের দোস্ত-বাংলাদেশের খাস দুশমন। তাই পাক-বাহিনী ধরে নিলো বিহারীরা সবাই তাদের এক নম্বর মিত্র। আর কারা? যারা মুসলিম লীগ করতো, যারা জামায়াতে ইসলামী করতো-তারাও সবাই পাকিস্তানের পক্ষে-বাংলাদেশের ও ভারতের বিপক্ষে। তাই সেনাবাহিনী দোস্তালি গড়ে তুললো বিহারী, মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর সাথে। বললো সব বাংলাদেশ সমর্থককে চিনিয়ে দাও-তাদের বাড়ী-ঘর । দোকান-পাট, সোনা-দানা লুট করে আর তাদের মেয়ে, বিশেষ করে বিবাহিত-অবিবাহিত যুবতী মেয়েদের আমাদের ক্যাম্পে দিয়ে যাও। আমরা তাদের কাছে থেকে খাঁটি পাকিস্তানী পয়দা করবো। পাকিস্তান রক্ষা করবো।

যে কথা, সেই কাজ। শুরু হয়ে গেল লুটপাট, যুবতী ধরে নিয়ে পাক-সেনাদের লালসা তৃপ্তিদর জন্য উপহার দিয়ে নতুন নতুন পাকিস্তানী মুসলমান পয়দা করতে সুযোগ দেওয়ার জন্যে। মানুষ্য আতংকিত। হিড়ি পড়ে গেল জীবন, মান-ইজ্জত রক্ষা করার জন্য পড়ি কি মরি করে লাখে লাখে দেশত্যাগী। তাঁরা ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে হয়ে পড়লেন শরণার্থী। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নির্দেশ দিলেন শরণার্থীদের পাশে সকলকে দাঁড়াতে। গঠিত হলো শত শত ছোট-বড় শরণার্থী শিবির। তাঁবু খাটিয়ে তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হলো, রেশন কার্ড দিয়ে তাদের বিনামূল্যে খাবার ও জ্বালানী এবং পরিধেয় বস্ত্রাদি সরবরাহের ব্যবস্থাও করা হলো।

যুব সমাজ ও নেতৃত্ব

আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও কমিউনিষ্ট পার্টি এবং তাদের দলীয় ও সমর্থক যুবক-যুবতীদেরকে রিক্রুট করা ও অস্ত্র প্রশিক্ষণে পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ, ত্রিপুরা ও আসামের বিশাল সীমান্ত জুড়ে অজস্র যুবশিবির গড়ে তোলা হলো-তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের কাজে নিয়োজিত হলেন ভারতের সেনাবাহিনী।

ইন্দিরা গান্ধী তার আগেই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে জানালেন একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠিত না হলে ভারত সরকারের পক্ষে অস্ত্র সরবরাহ বা আর বেীশ দূর অগ্রসর হওয়া যাবে না। গঠিত হলো তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রথম বাংলাদেশ সরকার-রাজধানী মুজিবনগর-যেখানে তাজউদ্দিন মন্ত্রীসভা ১৭ এপ্রিল, ৭১ শপথ গ্রহণ করেন এই সরকারের রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচিত করা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে। কিন্তু তিনি পাকিস্তানী কারাগারে আটক থাকায় তাঁর অনুপস্থিদতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিগসেবে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি ৭০ এর নির্বাচনে আসন না পাওয়ায় তাঁদেরকে বাদ দিয়েই মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। বামপন্থী ঐ দলটি দাবী তুললেন ন্যাশ নাল লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সকল দলকে তার অন্তর্ভূক্ত করা হোক। তা না হলেও তাঁরা তাজউদ্দিন মন্ত্রীসভাবে সমর্থন দেবেন-মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের সকল শক্তি নিয়ে অংশগ্রহণ করবেন। তিনি দলই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো-ভারত সরকার এবং ভারতের জনগণও সর্বাত্মক সহযোগিতা দিলেন।

মন্ত্রীসভা ঘোষণা করলেন, একটি স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নিঃশ^র্ত মুক্তির লক্ষ্যে তাঁরা সর্বশক্তি নিয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবেন।

বিদেশী পত্র-পত্রিকা, রেডিও টেলিভিশন-বিশেষ করে ভারতের পত্র-পত্রিকা ও টেলিভিশন এবং বিবিসি ব্যাপকভাবে প্রচার করলো তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ মন্ত্রীসভা গঠন ও শপথ গ্রহণের খবর। ভারতের আকাংবানী ও ইংল্যা-ের বিবিসি প্রতিদিন অসংখ্য বুলেটিন প্রচার করা শুরু করে দিয়েছিলো বাংলাদেশের ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ ও তার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্ত করে আনার শপথের কাহিনী। লাখে লাখে দেশত্যাগ, দেশের অভ্যন্তরে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা, শান্তি কমিটি গঠন, আল-বদর, আলশামস নামে সশস্ত্র সংগঠন গঠন, নারী অপহরণ ও পাক সেনাদের দ্বারা বাঙালি তরুণীদের যৌন নির্য্যাতনের বিস্তারিত খবর।

সরার পৃথিবীর মানুষ, যাঁরাই গণতন্ত্রে ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সকলেই বিস্ময়ে হতবাক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত কারামুক্তির দাবী উত্থাপন করলেন-মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য নানা দেশ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আসতে লাগলো।

বেড়ে গেল যুদ্ধের তীব্রতা সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সমগ্র সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির নৈতিক ও বৈষয়িক সহযোগিতা আসতে অপরদিকে বাড়তে থাকে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য কূটনৈতিক কার্য্যকলাপ। সারা বিশ্বের গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও প্রগতিকামী কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গায়ক-গায়িকা নানা দেশে নানা অনুষ্ঠানের বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে নানা অনুষ্ঠান ও তার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের। বিস্ময়কর সমর্থন পেলেন তাঁরা।

অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর পাক-বাহিনী আত্মসমর্পন করলো। বিজয় হলো মুক্তিযুদ্ধের। বিজয় হলো বাঙালির, বিজয় হলো সারা পৃথিবীর মানুষের।

এবারে একটিই দাবী। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি গুজব ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল বঙ্গবন্ধুকে বিচারের নামে প্রহসন করে ফাঁসির রজ্জুতে ঝোলানো হবে। যদি তাই হয় তবে কী হবে বাংলাদেশের-বাঙালি জাতির ।

তাজউদ্দিন মন্ত্রীসভা ঢাকা এসে সরকার পরিচালনা শুরু করলেন। দাবী তুললেন, এই মুহুর্তে বিনাশর্তে মুক্তি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু ছাড়তে বিলম্ব করছিল পাক-সরকার। ফলে অসহায়ত্ব বোধ সৃষ্টি হচ্ছিল কোটি কোটি সাধারণ বাঙালির মনে।

এবারে আরও বাড়ানো হলো কূটনৈতিক চাপ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবীতে ইন্দিরা গান্ধী ও লিওনিদ ব্রেঝনেড কূটনৈতিক সূত্রে কড়া হুঁশিয়ারী দিলেন। অবশেষে মুক্তি পেলেন বঙ্গবন্ধু। লন্ডন-দিল্লী হয়ে বিমানযোগে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করলেন তিনি।

চতুর্দিকে আনন্দের বন্যা। কোটি মানুষ বিমানবন্দরে সম্বর্ধনা জানালেন তাঁতের প্রিয় নেতাকে প্রথম আলিঙ্গন করলেন তাজউদ্দিন আহমেদ।

ফলটা দঁড়ালো এই যে বঙ্গবন্ধু থাকায় যেমন সংশয়াচ্ছন্ন হয়েছিলেন বাঙালি জাতি-মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের তার অনেকখানি নিরসন হলো বটে কিন্তু বঙ্গবন্ধু ফিরে আসায় তাঁর দ্বারা দেশটি গড়ে তোলার ব্যাপারে-গভীর আত্মবিশ্বাসের।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত।