শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট : নারকেল গাছের জেলা বাগেরহাট। মানুষের অন্যতম অন্যতম অর্থকরী ফসল। এ জেলার প্রতিটি বাড়ীতেই কম-বেশি নারকেল গাছ রয়েছে। জেলার চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি এর ওপর ভিত্তি করে জেলায় গড়ে উঠছে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান। তবে নানা কারণে বর্তমানে নারকেল গাছের ফলন কমতে শুরু করেছে। তার সাথে নতুন করে শুরু হয়েছে হোয়াইট ফ্লাই (সাদা মাছি) পোকার আক্রমণ।

বর্তমানে জেলার প্রায়ই প্রতিটি নারকেল গাছে হোয়াইট ফ্লাই পোকা আক্রমণ করায় জেলায় নারকেল গাছের ফলন কমেছে ৩০ থেকে ৩৫ এর শতাংস। শুধু ফলন কমে যাওয়া নয় ২০১৯ সাল থেকে শুরু হওয়া হোয়াইট ফ্লাই পোকার আক্রমণ এখন মারাত্মক আকার ধারন করেছে। এর প্রভাবে মরতে শুরু করেছে নারকেল গাছ। তবে কৃষি জেলা কৃষি বিভাগ বলছে সংক্রমণ ঠেকাতে জেলা কৃষকদের কীটনাশক প্রয়োগসহ নানা পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। আর কৃষকরা বলছেন এখনই নারকেল গাছের এ সংক্রমণ ঠেকানো না গেছে ভয়াবহ আকার ধারন করবে।

সরোজমিনে জেলার সদর উপজেলার কাড়াপাড়া, ষাটগম্বুজ, যাত্রাপুর, ফকিরহাট উপজেলা ও কচুয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখাযায়, নারকেল গাছের পাতার ওপর কালো আবরণ পড়েছে। পাতার নিচে রয়েছে তুলার মতো সাদা রঙ্গের পোকা। এই পোকাগুলোই বলা হয় হোয়াইট ফ্লাই বা সাদা মাছি। পোকাগুলো প্রথমে পাতায় ওপর বসে। পরে পাতায় মাকড়সার জালের মতো আবরণ তৈরি করে। প্রতিদিন এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। এর ফলে ধীরে ধীরে ওই গাছের পাতা নষ্ট হয়ে গাছ দূর্বল হয়ে পরে। গাছের ফল দেয়ার ক্ষমতা নষ্ট হতে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে গাছে এ পোকার আক্রমণে একটি সময় গাছ মারা যায়।

বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াপাড়া ইউনিয়নের কাঠিগোমতি এলাকার কৃষক বাসুদেব রায় জানান, ‘সাদা সাদা পোকের কারনে, আমাদের নাইরকেল গাছের পাতা শুকিয়ে যাচ্ছে। নাইরকেল গাছের মাথি (মাথা) মরে যাচ্ছে। গাছ মইরে যাচ্ছে। ফলণও কমে যাচ্ছে। আমরা এই পোক চিনিনা। আমার মত গ্রামের সবাইর গাছে একই অবস্থা। আমরা এর প্রতিকার চাই’।

ফকিরহাট উপজেলার নলধা-মৌভোগ ইউনিয়নের কৃষক আবুল হোসেন জানান, ‘আমার ঘেরের পাড়ে (মাছের খামার) প্রায় ৫০টির মত নাইরকেল গাছ রয়েছে। বছরে এই গাছ থেকে আমি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার নাইরকেল বেচিছি (বিক্রি করেছি)। গত বছর থেকে আমার নাইরকেল গাছের ফলন কুমতি শুরু করিছে। এহন ১০ হাজার টাকারও নাইরকেল বেছতি পারতিছি না। গাছের পাতায় সাদা সাদা পোকে ভইরে গেছে। গাছের পাতা কেমন যানি পুইরে যাচ্ছে’।

জেলার কচুয়া উপজেলার বাধাল এলাকার বাসিন্দা কৃষক আব্দুস সালাম শেখ জানান, ‘একটা সুমা ছিলো, আমাদের ঘেরের মাছ ও গাছের নাইরকেল বেইছে সংসার চলে যেতো। হাট-বাজারে নাইরকেল বেইছে ব্যাগ ভইরে বাজার করিছি। বাইরের ব্যবসায়ীরা এসে নাইরকেল কিনে নিয়ে গেছে। আগে গাছে কত বড় বড় নাইরকেল হইছে। সেই নাইরকেল এহন আর হয় না। তার উপর গত বছর থেকে দেখতিছি, সাদা সাদা পোকার যন্নি গাছের পাতা শুকোইয়ে যাচ্ছে, গাছ গুলো মইরে যাচ্ছে। এই পোকা আগে দেখিছি পিয়ারা গাছে, কলা গাছে। নাইরকেল গাছে এই পোকা কোনদিন দেখিনেই। এহন আমরা নাইরকেল বেচি না, উল্টে কিনে খাতি হচ্ছে’।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানাযায়, ২০২০-২১ অর্থ বছরে জেলায় ৩ হাজার ৬১৯ হেক্টর জমিতে নারকেল গাছের আবাদ হয়েছে। এ অর্থ বছরে জেলায় নারকেলের উপাদন হয় ৩০ হাজার ৯৩৬ মেট্রিক টন। তবে পরিমান বলতে না পারলেও বিগত অর্থ বছরের চেয়ে জেলায় নারকেল গাছের আবাদ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংস কমেছে বলে দাবী করছে কৃষি বিভাগ।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আজিজুর রহমান জানান, বর্তমানে বাগেরহাট জেলায় নারকেল গাছে হোয়াইট ফ্লাই বা সাদা মাছি ব্যাপক ভাবে আক্রমন করেছে। এটি আসলে ২০১৯ সালে দেখা যায়। বর্তমানে এর প্রভাবে জেলায় নারকেলের ফলন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংস কমে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল বিজ্ঞানী এসে সরোজমিনে বিষয়টি পর্যাবেক্ষণ করেছেন। তারা দেখেছেন প্রায় ৬১টি বিভিন্ন প্রজাতির গাছে এই পোকা আক্রমণ করে। বিশেষ করে নারকেলের পরে কলা এবং পেয়ারা গাছে এই পোকা অবস্থান করে।

আমরা বর্তমানে কৃষকদেরকে ‘ইমিডা ক্লোরোফিড জাতীয়’ ঔষুধ স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি। যেহেতু নারকেল গাছ অনেক লম্বা। এ কারনে ফুট পাম্প এর মাধ্যমে স্প্রে করতে হয় এবং সব গাছে একসাথে করতে হয়। আসলে এটি ভালো ভাবে দমন করতে হলে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা দরকার। কিন্তু এই পোকা দমনে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থার সঠিক গাইড লাইন এখন পর্যন্ত হয়নি। গাইড লাইন হলে এটি কার্যকর ভাবে দমন করা সম্ভব হবে।

(এসএকে/এসপি/জানুয়ারি ১১, ২০২২)