রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : দীর্ঘদিনের জমি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেয়ে  প্রতিপক্ষরা সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানাধীন কাশিয়াডাঙা গ্রামের কৃষক আরিজুল মোড়লকে (৫২) নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় নিহতের ভাতিজা অনুপ মোড়ল বাদি হয়ে মঙ্গলবার রাতেই থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ মঈজদ্দিন মোড়ল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

গ্রেপ্তারকৃত মঈজদ্দিন মোড়ল পাটকেলঘাটা থানাধীন কাশিয়াডাঙা গ্রামের ইব্রাহীম মোড়লের ছেলে।

সরেজমিনে বুধবার সকালে পাটকেলঘাটা থানাধীন কাশিয়াডাঙা গ্রামে গেলে একেশ্বরবাদি (ভগবেনে) সম্প্রদায়ের আবুল মোড়লের ছেলে পিয়াস মোড়ল বলেন, প্রতিবেশি একই সম্প্রদায়ের আকের শেখের ছেলে রবিন, বাকের শেখের ছেলে ভুট্টো ওরফে ভোলা ও তাকের শেখের ছেলে পঙ্কিসহ তাদের পূর্ব পুরুষদের সঙ্গে ৭২ শতক ডাঙা জমি নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে বিরোধ রয়েছে।

এ নিয়ে তাদের প্রতিপক্ষরা ১৯৩৯ সালে তালা ঋণ শালিস আদালতে মামলা করে। হেরে যেয়ে পরবর্তীতে তারা তৃতীয় মুনসেফ আদালতে মামলা করলে ১৯৪৮ সালে ওই রায় প্রতিপক্ষদের বিপক্ষে যায়। একপর্যায়ে প্রতিপক্ষরা ১৯৯৫ সালে তার বাবা ও দু’ চাচার বিরুদ্ধে তালা সহকারি জজ আদালতে মামলা করেন। এক বছর যেতে না যেতেই প্রতিপক্ষরা ওই মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে ১৯৯৭ সালে একই আদালতে নতুন মামলা করে। রায় বিপক্ষে গেলে তারা জজ কোর্টে দেঃ আপিল ৯৭/২০০১ মামলা করে।

গত ৮ ডিসেম্বর সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ বিশ্বনাথ মণ্ডল দু’পক্ষের শুনানী শেষে দু’তরফা সূত্রে আপিল খারিজ করে দেন। আদেশটি তারা জানতে পারেন চলতি বছরের ২ জানুয়ারি। এরপর থেকে তার প্রতিপক্ষরা মামলার তদ্বিরকারক চাচা আরিজুল মোড়লের উপর ক্ষুব্ধ ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হন চাচা মতিয়ার মোড়ল ও ফুফাত ভাই অ্যাড. হায়দার মোড়লের কৃষি জমি জবরদখলের চেষ্টাকারি একই গ্রামের ইব্রাহীম মোড়লের ছেলে কালাম মোড়ল। বহিরাগত সন্ত্রাসীদের এনে চাচা আরিজুলকে হত্যার হুমকি দিচ্ছিল তাদের প্রতিপক্ষরা।

পিয়াস মোড়ল আরো জানান, মামলার রায় জানার পর প্রতিপক্ষদের হুমকির বিষয়টি গত বৃহষ্পতিবার চাচা আরিজুল মোড়ল পাটকেলঘাটা থানাকে অবহিত করতে যান। মামলার রায় এর সত্যায়িত কপিইনয়ে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দেখিয়ে যাওয়ার কথা বলে চাচা চলে আসেন। মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে চির কুমার চাচা অরিজুল দ্বিতীয় বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হন। প্রথম বাড়ি থেকে দ্বিতীয় বাড়ি ঢিঁল ছোঁড়া দূরত্বের মধ্যে। পরদিন ভোর ৬টার দিকে সরদার পাড়ার কফিলউদ্দিনের স্ত্রী তিন রাস্তার মোড়ে চাচা আরিজুলের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে তাদেরকে খবর দেয়।

আরিজুল মোড়লের বোন যমুনা জানান, বিরোধপূর্ণ ওই জমি জবরদখল করার চেষ্টা করলে খলিষখালিতে বসবাসরত বড় ভাই মকবুল মোড়লকে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে হত্যা করে বাড়ির সামনে পুকুরে ফেলে দেয় প্রতিপক্ষরা। মামলা করলে স্বপরিবারে হত্যার হুমকি দেওয়ায় তারা মামলা করেননি। এ ঘটনায় পুলিশ পাটকেলঘাটা থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করলেও পরবর্তীতে ময়না তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে তারা জানতে পারেননি। বা পুলিশ বাদি হয়ে কোন হত্যা মামলা করেছিল কিনা তা তারা জানেন না। মকবুল মোড়ল হত্যার ঘটনায় তাদের প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গৃহীত হলে ভাই আরিজুলকে আর মরতে হতো না।

সম্প্রতি আদালতের রায় জানার পর কালামসহ প্রতিপক্ষরা বহিরাগত লোকজন নিয়ে পাড়ায় রাতে হাজির করতো, আরিজুলকে হুমকি দিতো। একইভাবে তাদের গ্রামের আব্দুর রহিম মোড়লের জামাতা (শ্যামনগর) সুদখোর সেলিম হুমকি দিতো আরিজুলকে। বিষয়টি আরিজুল তার বন্ধু জাহাঙ্গীর, সোবহান, ইউপি সদস্য রবিউল, ইউপি চেয়ারম্যান সাবির হোসেনসহ কয়েকজনকে অবহিত করে। প্রতিপক্ষরাই তার ভাইকে প্রথম বাড়ি থেকে দ্বিতীয় বাড়িতে যাওয়ার পথে মাথায় ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করে রাস্তার উপর ফেলে দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্রা করেছে বলে তিনি মনে করেন।

খলিষখালি ইউপি চেয়ারম্যান কমঃ সাবির হোসেন জানান, মামলার রায় পাওয়ার পর জমি চাষণ করার কথা বলতে গেলে পাটকেলঘাটা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আদেশের কপি ছাড়া তাদেরকে সেখানে সেখানে যেতে নিষেধ করে। বিষয়টি তাকে জানানোর পর মঙ্গলবার তাকে নিয়ে থানায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার রাতেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

পাটকেলঘাটা থানার উপপরিদর্শক কৃষ্ণপদ সমাদ্দার জানান, কৃষক আরিজুলকে হত্যার ঘটনায় তার ভাইপো অনুপ মোড়ল বাদি হয়ে মঙ্গলবার রাতে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মঙ্গলবার দুপুরে ইব্রাহিম মোড়লের ছেলে মঈজুদ্দিনকে তার বাড়ির সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচদিনের রিমাণ্ড আবেদন জানিয়ে বুধবার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ১২, ২০২২)