রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নের খেজুরডাঙা আরকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারি প্রধান শিক্ষক, একজন প্রহরী ও একজন পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োগে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পাতানো নিয়োগ বোর্ড বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমানের উপস্থিতিতে শুক্রবার সকাল ১০টায় দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরের ফটকের তালা ভেঙে এ নিয়োগ পরীক্ষা শুরুর প্রাক্কালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেশ কিছু অচেনা লোকের আনাগোনা দেখে স্থানীয়রা বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান।

খবর পেয়ে সেখানে যাওয়া মাত্র ওই বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণীকক্ষে দু’ নারীসহ ১১জনকে বসে থাকতে দেখা যায়। তাদের কাছে পরীক্ষা সংক্রান্ত প্রবেশপত্র ছিল। তবে তারা কোন বিষয়ে পরীক্ষা দেবেন তা তাৎক্ষণিক কেউ মুখ খোলেননি। সেখানকার দায়িত্বপালনকারি জনৈক হাবিবুর রহমান নিজেকে খেজুরডাঙা আর কে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উল্লেখ করে বলেন, এখানে একটা মিটিং হচ্ছে। কিসের মিটিং হচ্ছে জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। একপর্যায়ে প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান তার বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ইদ্রিস আলীর কাছে ফোন ধরিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। ইদ্রিস আলী বলেন সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে একজনের স্থায়ীকরণ, একজন প্রহরী ও একজন পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োগ পরীক্ষা সেখানে অনুষ্ঠিত হবে।

তবে বিষয়টি প্রকাশ হয়ে গেলে প্রধান শিক্ষক বলেন, তিনি আশাশুনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মোস্তাকিমের চাচাত ভাই। তার বোন ফারজানা আক্তার কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তিনি এমপি সাহেবের বাসার পাশেই থাকেন। তাই সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমানসহ নিয়োগ বোর্ডের সকলকে ম্যানেজ করেই আগে থেকে প্রহরী পদে ও পরিচ্ছন্ন কর্মী পদে তাহমিদ ও জাহিদকে আগে থেকে নিশ্চয়তা দিয়েই বিশেষ প্রক্রিয়ায় কোরাম পূর্ণ করে এ পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। নিয়োগের ব্যাপারে স্থানীয় কাফেলা ও একটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তিনি এ সেখানে পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। বিষয়টি কোন পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন না করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন।

আগে থেকে ঠিক করে রাখা সহকারি প্রধান শিক্ষক গোপীনাথপুরের দেবেন গাইন বলেন, তিনি ১৯৯৫ সালেল পহেলা জানুয়ারি থেকে ওই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত। তার বেসিক বেতন ২২ হাজার টাকা। বর্তমানে তিনি সহকারি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করলেও অনুমোদিত না হওয়ায় সহকারি প্রধানর শিক্ষকের বেতন অনুযায়ি বেসিক ২৩ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছেন না । তাই সকলের সহযোগিতায় তিনি ওই পদে নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুমোদন পাওয়ার জন্য এ পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। তবে কোরাম পুরণের জন্য প্রধান শিক্ষকের বোন কারিমা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারজানা আক্তার ও বাঁশদহা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তৃপ্তি রানীকে কোরাম পূরণের জন্য আনা হয়েছে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খেজুরডাঙা আরকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারি শিক্ষক সাংবাদিকদের বলেন, বোঝেন তো, এমপি সাহেব পিছনে থাকলে চিন্তা কি? তবে কোন এমপি তাদের পিছনে আছেন তা তিনি জানতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

খেজুরডাঙা গ্রামের কণ্ঠরাম সরকারের ছেলে প্রবেশ সরকার বলেন, তাকে প্রহরী পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য দাবিকৃত আট লাখ টাকার পরিবর্তে ছয় লঅখ টাকা নিলেও চাকুরির বয়স নেই দেখিয়ে তাকে পরীক্ষার কার্ড দেওয়া হয়নি।
খেজুরডাঙা গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান সাজু বলেন, পাঁচ মাস আগে পাতানো নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে একজন প্রহরী নেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি আদালতের শরনাপন্ন হন। মামলার কারণে ওই সময় পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। এখনো প্রধান শিক্ষক শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে তিনজনের কাছ থেকে কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকা নিয়ে ওই পাতানো নিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে তিনি জেনেছেন।

সাতক্ষীরা সদরের খেজুরডাঙা আর কে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি লাবসা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম সাংবাদিকদের বলেন, পরীক্ষা হওয়ার কথা তিনি জানেন । তবে কোথায় হচ্ছে এটা তাকে অবহিত করা হয়নি। তবে এতে কোন অর্থনৈতিক লেনদেন এর অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।

দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির নবনির্বাচিত সভাপতি জুনায়েত হোসে ন বায়রন বলেন, তাদের বিদ্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে এমনটি তাকে কেউ অবহিত করেনি।

দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সানজিদা আক্তার শুক্রবার দুপুরে মোবাইল ফোনে সাংবাদিকদের বলেন, তার বিদ্যালয়ে এ ধরণের কোন পরীক্ষার বিষয়ে তার জানা নেই। তবে বিদ্যালয়ের চাবি নৈশপ্রহরী কাম পিওন আল আমিনের কাছে থাকে । সেই ভাল বলতে পারে।

নৈশপ্রহরী আল আমিন বলেন, শুক্রবার সকাল ৯টায় কাটিয়া সরকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিন মিলন তাকে তাদের বিদ্যালয়ের একটি নির্ধারিত মিটিং দক্ষিণ কাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে করানোর জন্য তার কাছে সহযোগিাত চান। কিন্তু চাবি না নিয়ে হয়তো বা বাইরের দুর্বল ছিটকানি খুলে সেখানে বারান্দায় মিটিং করা হচ্ছে। বিষয়টি প্রদান শিক্ষক জানেন না। তবে দু’টি ঘর খোলা এবং সেখানে লোকজন রয়েছে এমন কথা বলার পর তিনি বলেন, এখনই তিনি সাধারণ ডায়েরী করবেন।

কাটিয়াপ সরনকারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যৃালয়ের পিওন মিলনের সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে যোগযোগের চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষাক কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান বলেন, নিয়ম মেনেই জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বলে নিয়োগ বোর্ড পরিচালনা করা হচ্ছে।

সাতক্ষীরা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বিষয়টি তাকে অবহিত করা হয়নি। তবে খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ওই পাতানো নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ১৪, ২০২২)