প্রবীর বিকাশ সরকার : ২০০৪ সালের কথা। আমি তখন জাপানের সবচে মর্যাদাসম্পন্ন আধুনিক প্রকাশনা সংস্থা হেইবোনশা পাবলিশার কোম্পানির সহোদর প্রতিষ্ঠান ফটো প্রিন্টিং কোম্পানিতে কাজ করি। এখানে উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা সংস্থাগুলোর দামি দামি বই, ম্যাগাজিন ছাপা হত। আমার কাজ ছিল দুপুর একটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। দোতলায় ক্রিয়েশন বিভাগে কালার সেপারেশন, প্লেট মেকিং এবং কালার চেকিং এর কাজ হত। সব অটোমেটিক মেশিনে কম্পিউটারের মাধ্যমে। সন্ধের পর আমি একাই কাজ করতাম নিরিবিলি।

দোতলাতেই ছিল কোম্পানির গেস্ট রুম। এখানে মালিক ফুজিমিশা সান বসে বই পড়তেন কাজের ফাঁকে ফাঁকে। এখানে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ছিল। হেইবোনশা তো বটেই অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থার মূল্যবান বড় বড় গ্রন্থাদি সাজানো ছিল। সন্ধের পর আমি সেখান থেকে নানা বই নিয়ে এসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়তাম সবই জাপানি ভাষায় লিখিত। এমন কিছু বই পেয়েছি যা বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধতর জাপানের সংসদ লাইব্রেরিতেও খুঁজে পাইনি। সেগুলো কপি করে নিয়েছি।

একদিন ঘাঁটতে ঘাঁটতে অসাধারণ একটি ডাউস ম্যাগাজিনের কেইস পেয়ে গেলাম। তিনটি ম্যাগাজিনের একটি সেট। ম্যাগাজিনটির নাম ফ্রন্ট। প্রচ্ছদে লেখা এগুলো পুনর্মুদ্রণ সংস্করণ। ম্যাগাজিনগুলো খুলে অবাক হয়ে গেলাম! মোটা কাগজে বিশেষ রঙে ছাপা অফসেট মেশিনেই। ছবিগুলোও হাই রেজুলেশনের ক্যামেরা দিয়ে তোলা। ফ্রন্ট মূলত ওয়ার গ্রাফিক ম্যাগাজিন। নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল মুদ্রণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা, বৃটেন, জার্মানি, ইটালি, রাশিয়ায় এই ধরনের ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে নিজেদের শক্তিমত্তাকে তুলে ধরার জন্য। জাপানও পিছিয়ে থাকেনি। সেও সমকক্ষ হয়ে উঠেছিল শ্বেতাঙ্গ মহাশক্তিগুলোর। ওয়ার মেশিন সেও চালু করেছিল আমেরিকা, নেদারল্যন্ডস এবং বৃটেনের বিরুদ্ধে।

এই ম্যাগাজিনগুলোর ছবি ও তথ্য প্রমাণ করেছে বিপুল শক্তি অর্জন করেছিল জাপান এশিয়ার প্রথম শিল্পোন্নত রাষ্ট্র হিসেবে। লোহা ও ইস্পাতের বিপুল ব্যবহার বিস্ময়কর বলে মনে হয়েছে আমার কাছে অথচ প্রাকৃতিক কোনো সম্পদই নেই দেশটির। কীভাবে বিশাল বিশাল যুদ্ধ জাহাজ, ডুবো জাহাজ, ট্যাঙ্ক, বিমান, বন্দুক, মেশিনগান, কামান, বোমা, প্যারাশুট, যানবাহন ইত্যাদি তৈরি করেছে নিজের দেশের কারখানায় তা ছবি দেখে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। শুধু তাই নয়, পদানত এশিয়ার একাধিক দেশে কীভাবে সে মাইলের পর মাইল রেললাইন বসানো, আধুনিক ট্রেন তৈরি, স্টেশন তৈরি, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, হাসপাতাল তৈরি করেছে ভাবাই যায় না! এগুলো স্থাপনের সময় স্থানীয় জানমালের ক্ষতি হলেও সেগুলো এখন সেইসব দেশের উন্নয়নের ভিত্তি।

খুবই আশ্চর্য লাগে যে, চারটি বছর কীভাবে জাপান একাই বিশ্বের তখনকার তিনটি সাম্রাজ্যবাদী মহাশক্তিকে এশিয়া থেকে বিতাড়িত করেছিল এক ঝটিকা অভিযানে! কীভাবে একাই সমগ্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরকে স্বনিয়ন্ত্রণে লেখেছিল যা চিন্তারও বাইরে!

একদিন মালিককে ম্যাগাজিনগুলোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম আরও অনেকগুলো আছে তবে এখানে নেই। ইন্ডিয়া সংস্করণও একটি প্রকাশিত হয়েছিল। ওয়ার গ্রাফিক নিয়ে একটা বইও বইয়ের দোকানে খুঁজে পেলাম যেটা হেইবোনশা পাবলিশার প্রকাশ করেছিল সেটাতে ফ্রন্ট ম্যাগাজিনগুলো কীভাবে ডিজাইন ও ছাপা হয়েছে তার ইতিহাস জানতে পারলাম। তখনকার প্রতিভাধর সব ডিজাইনার, ক্যামেরাম্যান এবং কারিগরদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছিল ফ্রন্টের প্রকল্পে।

২০০৫ সালে ফটো প্রিন্টিং কোম্পানি বন্ধ করে দেয়া হয়। তখন মালিক এই ম্যাগাজিনসহ বেশকিছু দুর্লভ গ্রন্থ আমাকে উপহার দেন। তিনি জানতেন যে আমি জাপান নিয়ে গবেষণা করি। বললেন, এইগুলো নিয়ে লিখে তোমার দেশের মানুষদের কাছে তুলে ধরো সম্ভব হলে।

লেখক : জাপান প্রবাসী

(ওএস/এইচআর/সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৪)