রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলা করে মনোরম পরিবেশে স্থাপত্য শৈলি এবং নান্দনিকতার জন্য যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইন্সটিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট- রিবা অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। 

বুধবার ২৬ জানুয়ারি, শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালকে ২০২১ সালের রিবা অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক এ স্থাপত্য সংস্থাটি। এর আগে ২০২১ সালে রিবা অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পায় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল, শ্যামনগর।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলা সদর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে সোয়ালিয়া গ্রামে ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই একর জমির উপর আধুনিক সুযোগ সুবিধা সংবলিত এ হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে। নিপুন নির্মাণ শৈলীতে ৪৭ হাজার ৭৭২ বর্গফুট জায়গার উপর গড়ে তোলা হয়েছে ২০টি ভবন বিশিষ্ঠ এ স্থাপনা।

স্থানীয় প্রযুক্তি ও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে নির্মিত এ হাসপাতালে বহিবিভাগে ও অন্তঃবিভাগে চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি অডিটোরিয়াম, কনভেনশন সেন্টার, ক্যান্টিন আর প্রার্থনা কক্ষেরও ব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসক, সেবিকাসহ ৫৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসিক সুবিধা রাখা এ স্থাপনায় অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা চোখে পড়ার মত।
পরিবেশ বিপর্যয় রোধে মুল ভু-খন্ডের উপর গড়ে তোলা এ স্থাপনার যাবতীয় বর্জ্য ধ্বংসে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এসটিপির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভবনসমুহের মধ্যভাগ ও পাশ দিয়ে জলাধার সৃষ্টির মাধ্যমে নির্মল পরিবেশের উপস্থিতি নিশ্চিত করে প্রকৃতিকে আলিঙ্গনের দৃশ্যমান উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়েছে ।

সূত্রটি আরো জানায়, স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ২০ শয্যার এ হাসপাতালের নকশা তৈরি করেছেন। নকশা প্রস্তুতের সময় বাতাসের গতিপথ বিবেচনায় হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোর অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিপুর্বে বাংলাদেশের এ স্থপতির নকশাকৃত গাইবান্ধার আরবানা ভবনটি আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল।

হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডের সামনে উঠানের মত খালি জায়গা রাখা হয়েছে। পলেস্তারা ছাড়াই ভবনসমূহের দেয়াল ও ছাদে শুধুমাত্র ইটের গাথুনী আর ঢালাইয়ের উপস্থিতি শোভা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে লবনাক্ততার ক্ষতিকর প্রভাব এড়ানোর চেষ্টায় স্বাক্ষী হয়েছে। ভবনসমূহের বিভিন্ন স্থানে সামঞ্জস্যমতে নানান প্রজাতির ফলজ ও বনজ গাছ লাগিয়ে মুল নকশায় পরিপুর্নতার অপুর্ব মিলন ঘটনো হয়েছে। চারপাশে ঘিরে থাকা লবন পানির উপস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে স্থাপনার মধ্যে লবনাক্ত পানি শোধনে ট্রিটমেন্ট প্লান্ট্রের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

আরও দেখা যায়, মনোরম স্থাপত্য শৈলীর মাধ্যমে হাসপাতালের ইনডোর ও আউটডোরের ক্ষেত্রে দুই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। জায়গা স্বল্পতার কথা বিবেচনায় নিয়ে সীমানা প্রাচীরের পরিবর্তে বিভিন্ন অংশে ১০ ফুট চওড়া জলাধান নির্মাণ করা হয়েছে। লবনাক্ততার প্রভাবমুক্ত রাখতে বিশেষ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে এ স্থাপনার যাবতীয় ভবন এক ও দোতলায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।

ভবনসমুহের একাধিক অংশে ইট ও কাঁচের সমন্বয়ে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থাসহ প্রশস্থ জানালার উপস্থিতি- গোটা স্থাপত্যে দৃষ্টি কেড়েছে। বিদ্যুৎ এর বিকল্প হিসেবে সুপরিসর করিডোর আর বিস্তর প্রাকৃতিক আলো বাতাসের উপস্থিতির বিষয়টি স্থাপত্য শৈলী গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ভবনসমূহের তলদেশ দিয়ে আধুনিক পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি পাশের কল্যাণপুর খালের মাধ্যমে মাদার নদীতে নিস্কাশনের ব্যবস্থা স্থাপনা শৈলীর আলাদা মাত্রা যোগ হয়েছে।
শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল রিবা অ্যাওয়ার্ড জয় করায় সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান ফ্রেন্ডশিপের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক রুনা খান।

তিনি বলেন, “সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাবিত লবনাক্ত এলাকায় অবস্থিত এ হাসপাতাল নির্মান করেছে উন্নয়ন সহযোগি সংস্থা ‘ফ্রেন্ডশিপ’। ২০ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাবিত স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আমরা কাজ করে দেখেছি এবং এতে আমার বিশ্বাস হয়েছে যে, নিজেদের ছোট ছোট সমস্যা সমাধানেও দরিদ্র মানুষকে বেগ পেতে হয়।

কাশেফ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের। তিনি স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে দক্ষতার প্রমান দিয়েছেন। গুনগত মান নিশ্চিত করেছেন এবং ফ্রেন্ডশিপের মান-সম্মানকে আরও বাড়িয়েছেন। পর্যাপ্ত আলো, বাতাস, মাটি, পানির সমন্বিত পরিবেশে শ্যামনগরের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের সৌন্দর্য হয়ে উঠেছে আরও জীবন্ত। জলবায়ু প্রভাবিত কিছু মানুষের জন্য এই ধরণিতে নতুন করে এবং ভালভাবে বাঁচার আশা নিয়ে এসেছে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল।
৬ জনচিকিৎসক, ১২জন নার্স এবং অন্যান্য সহকারীর সমন্বয়ে ৮০ শয্যার হাসপাতালে রয়েছে ৪টি ওয়ার্ড। ৩টি অপারেশন থিয়েটারের মাধ্যমে বেশিরভাগ অস্ত্রপচার হচ্ছে এখানে। প্রত্যন্ত এলাকায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ এবং অ্যাম্বুলেন্স সুবিধায় হাসপাতালের জরুরী বিভাগ খোলা থাকে ২৪ ঘন্টা।

প্রতিদিন হাসপাতালের বহির্বিভাগ বা আউটডোর সার্ভিস খোলা থাকে সকাল ৮.৩০টা থেকে বিকাল ৪.৩০টা পর্যন্ত। দন্ত, চোখেরছানি, জরায়ুক্যান্সার, হৃদরোগ, ঠোটের তালুকাটা, বার্ণ, অর্থপেডিক, ডায়াবেটিক, ফিজিওথেরাপি, স্ত্রীরোগ এবং শিশুরোগ নিয়ে বছরে ১২ থেকে ১৫টি বিশেষ ক্যাম্প পরিচালিত হয় ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের উদ্যোগে। শুধু হাসপাতাল কমপ্লেক্স নয়, শ্যামনগরের বিভিন্ন ইউনিয়নে ছাত্র-ছাত্রী এবং বাড়ীর মহিলাদের নিয়ে আয়োজন করা হয় ম্বাস্থ্য ক্যাম্প।

শ্যামনগর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বে থাকা এহসানুল হক জানান, শ্যামনগর উপজেলা সদর থেকে দুই কিলো মিটার দুরে ২০১৪ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে এ হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের ২২ জুলাই কাজ সম্পন্নের পর সেখানে উপকূলীয় জনপদের সেবা প্রত্যাশীদের চিকিৎসা সেবা শুরু হয়। মুল স্থাপনার মধ্যে পাঁচটি ভবন আবাসিক ও ১৫টি স্বাস্থ্য সেবার কাজে ব্যবহৃত হয় জানিয়ে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন সুবিধা এ স্থাপনার বিশেষত্ত্ব।

আধুনিক স্থাপত্য শৈলী দৃষ্টিনন্দন হাসপাতাল ভবনটি’র খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বে। স্থানীয় প্রকৃতি এবং আবহাওয়া বিবেচনায় স্থপতি কাশেফ চৌধুরীর নকসায় নির্মিত ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল জিতে নিল ২০২১ সালের রয়্যাল ইন্সটিটিউট অব বিট্রিশ আর্কিটেক্ট -রিবা অ্যাওয়ার্ড। হাসপাতালের পরিচালক অসিম রোজারিও জানান, শুধু সাতক্ষীরা জেলার নয়, ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ রয়েছে দেশের যে কোন জেলার বাসিন্দাদের।

স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার অন্যতম শ্যামনগর। সেখানে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা রেখে একটি হাসপাতালের নকশা তৈরীর সময় স্বল্প বাজেটের কথা বিবেচনায় নিতে বলা হয়। পারিপাশির্^ক অবস্থার পাশাপাশি সর্বোচ্চ আধুনিকতার ছোঁয়া এবং প্রাণ ও প্রকৃতির সাথে জীব বৈচিত্রের কথা মাথায় রেখে এ স্থাপনার নকশা তৈরী করা হয়।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ২৭, ২০২২)