কামরুল বাহার আরিফ : রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় এক স্বচ্ছ আপষহীন মানুষ। যিনি একইসাথে কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক। একজন প্রাজ্ঞ পাঠকও বটে! নানামুখি পাঠে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। পাঠের ভাণ্ডার ঈর্ষা করার মত। আমার পাঠ সে হিসেবে অতি সামান্য। আর আমি এমন ঋদ্ধ পাঠককে সব সময় ভয় পাই নিজের অজ্ঞতার জন্য। আমি যাঁর কথা বলছি তিনি আমার অনুজ, কবি মানিক বৈরাগী। প্রচণ্ড ধারালো বক্তব্যে তিনি সদাসোচ্চার। তাঁর ৫১তম জন্মদিনে অশেষ শুভকামনা ও ভালোবাসা। আপোষহীন মানুষ হিসেবে যেমন তিনি অনেকের প্রিয় তেমনি ধারালো সত্য বক্তব্য বা সমালোচনার জন্য তিনি সমানভাবে বিরাগভাজন একজন। তাই তো তিনি বারবার প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আজ পঙ্গুত্বের অসহনীয় জীবন নিয়ে বেঁচে আছেন। কেনো এই প্রতিহিংসা কবির জীবনে সে ইতিহাস বড় দীর্ঘ ও নির্মম। এই প্রতিহিংসা তাঁর আদর্শের বিরোধীদের দ্বারা যেমন, তেমনি আদর্শের ঘরেও কম নয়। চির প্রগতিশীল চিন্তাধারার এই সাহসী মানুষটি দেশের প্রান্তিক সমুদ্রেঘেরা শহর কক্সবাজারে ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন পারিবারিক ধারায়।

পারিবারিক রাজনীতি থেকে তিনি সত্য ও ত্যাগের মহিমায় নিজেকে গড়ে তোলেন। ছাত্র নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে। সে ধারাবাহিকতায় তিনি মুক্তির জন্য বিপ্লবকে বেছে নেন জীবনে। সেই বিপ্লবকে জানতে তিনি আশ্রয় নেন বঙ্গবন্ধু, লেনিন, সুভাষ, ফিডেল কাস্ট্র, মাও-সেতুং, নেলসন মাণ্ডেলাসহ বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবীদের পাঠ থেকে। একই সাথে মানবিক মানবের পাঠও নিয়েছেন এইসব মহামানবের থেকে। তিনি ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে পাঠ নিয়েছেন ধর্মগ্রন্থ সমূহ থেকে। তাই তিনি একজন প্রকৃত ধার্মিকও বটে। এখানেও তাঁর বিশ্বাস অটুট ও আলোময়।

তিনি মনে-প্রাণে যৌক্তিক। ধর্মে ও আদর্শে। অন্ধত্ব দিয়ে আলোকে জানা যায় না। যে কোনো আদর্শ, তা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় হোক না কেনো তা হতে হবে মানবিক ও মানব কল্যাণের জন্য। এই যুক্তিতে তিনি তার পাঠকে সমৃদ্ধ করে নিজেকে শাণিত করেছেন। তাঁর এই যুক্তিবাদিতা ও আলোময় আদর্শ ধর্মান্ধরা কখনো মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি সামরিক লেবাসের স্বৈরশাসকেরা। তাই ছাত্রাবস্থাতেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকা কালিন সময়ে মৌলবাদিদের দ্বারা আক্রমণের স্বীকার হতে হয়েছিল। মৌলবাদী জঙ্গী ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির তাঁকে তাঁর হাতও পায়ের রগ কেটে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রায় পঙ্গ হয়ে যান। তারপরও থেমে থাকেননি মানিক। মানিক যেনো তার আলো আরও ছড়িয়ে দিতে চাইলেন অন্ধকার তাড়াতে।

এবার স্বীকার হলেন ক্ষমতাসীদের রোষানলে। তাকে গ্রেফতারের নামে অত্যাচার করে তাঁর কোমরের হাড় ভেঙে দিয়ে চিরতরে পঙ্গু করে দিলো! বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নিজ দলের সুবিধাবাদী ও আদর্শহীন রাজনীতিবিদদেরও বিরাগভাজন হন এই কবি। আর এইসব সুবিধাবাদী ও আদর্শহীন রাজনীতিবিদদেরা এক সময় দলে সংখ্যাগরিষ্ট হওয়ায় তিনি রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েন। দলের এই নিগ্রহও তাঁকে আদর্শ থেকে একচুলও সরাতে পারেনি। ব্যক্তিগত জীবনে চরম অস্বচ্ছল এই মানুষটার ত্যাগ কেউ মনে রাখেনি যা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য জনক। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পরে যে কটি মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন, নির্যাতিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মানিক বৈরাগী অন্যতম। অথচ বঙ্গবন্ধুর দল ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থেকেও এমন আদর্শিক ও বিরোধী দলের দ্বারা সুপরিকল্পিতভাবে নির্যাতিত নেতা-কর্মিরা কেনো সরকারের দৃষ্টির বাইরে আজও সেটা ভাবতে কষ্ট হয়। সাগরপাড় কক্সবাজারের মানিক বৈরাগী আজ নির্মম বাস্তবতার নিত্য সঙ্গী।

আমরা জানি বারবার নির্যাতনের ফলে তার শারীরীক যন্ত্রণার কথা। তিনি প্রায়শই বিছানাগত থাকেন। অথচ নিজের চিকিৎসা করার সামান্য সামর্থও তাঁর নেই। তিনি তাঁর দুরাবন্থা ও চিকিৎসার জন্য সরকারের দৃষ্টি আনতে কক্সবাজার শহীদ মিনারে অনশন করেছিলেন। এমনকি ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করারও ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরা জানি তখন মানবিক মানবী, মাদার অব হিউমিনিটি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কবি মানিক বৈরাগীকে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে শান্তনা দেন ও তাঁর যাবতীয় চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই সহায়তার প্রতিশ্রুতি কয়েকটি বছর পেরিয়ে গেলেও কাদের হস্তক্ষেপে থেমে আছে জানি না। মানিক বৈরাগীর অবস্থার আরো অবনতি ঘটছে দিনদিন।

আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যারা নিয়োজিত আছেন তাঁরা বিষয়টি নজরে এনে কবি মানিক বৈরাগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করবেন এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে নির্যাতিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এই সৈনিকের বেঁচে থাকার সংগ্রামে এগিয়ে আসবেন। আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলাকে দেখতে চাই যেখানে কবি ও শিল্পীরা তাঁদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা পায়। কবি লেখকরা একটা দেশের মুখচ্ছবি। তাঁদের পেটে ভাত না থাকলে, তাঁরা বিনা চিকিৎসায় ভুগতে থাকলে আমরা সভ্য বলে দাবী করতে পারবো না।

বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে কবি, শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা বলেছেন বারবার। তিনি এটা মনে প্রাণে ধারণও করতেন। তার প্রমাণ পাই ভারত থেকে আমাদের জাতীয় কবিকে দেশে নিয়ে এসে আমাদের জাতিকে গর্বিত করেছেন। এমন উদাহরণ তাঁর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বহু দেয়া যাবে। পাকিস্তান শাসনামলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক জনসভায় তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহম্মদ, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন আহম্মদ। সে যাত্রার বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু আব্বাসউদ্দিন আহম্মদ সম্পর্কে আক্ষেপ করে বলেন, ‘তাঁর গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে ছিল তাঁর নাড়ির সম্মন্ধ। দুঃখের বিষয়, সরকারের প্রচার দপ্তরে তাঁর মত গুণী লোকের চাকরী করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছিল।’

শিল্পী লেখকদের নিয়ে এমন ভাবনা ছিল আমাদের জাতির পিতা। শিল্পের প্রতি তাঁর এই মনোভাব আমাদেরকে গর্বিত করে। আমরা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর গ্রন্থসমূহে বারবার বলতে শুনি, ‘কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না।’ আমারা বিশ্বাস করি, কবি মানিক বৈরাগীর আজীবনের ত্যাগও বৃথা যাবে না। আমি বিশ্বাস করি, মানিক বৈরাগী একজন কথার শিল্পী, কবি, অসংখ্য গ্রন্থের সৃষ্টাা। এবং বাংলাকে ভালোবাসা পিতা মুজিবের সত্যিকারের আদর্শের একজন অসাম্প্রদায়িক ও সততার প্রতীক। সর্বোপরি একজন মানবিক মানুষ।

আবারও ৫১তম জন্মদিনে কবি মানিক বৈরাগীর সার্বিক মঙ্গল কামনা করে তাঁর চিকিৎসা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য দেয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি দ্রুত পূর্ণ হবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি। জয় হোক কবির কবিতা ও জয় হোক কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের।

(কে্‌এ/এসপি/জানুয়ারি ২৮, ২০২২)