রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : নৌকায় ভোট দেওয়ায়  জামায়াত সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র হামলায় সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার কাঁকড়াবুনিয়া গ্রামের এক কলেজ পড়ুয়া মেয়েসহ তার বাবা ও মাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করার ঘটনার সাত দিনেও মামলা নেয়নি পুলিশ। ফলে হামলাকারিরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

এদিকে সন্ত্রাসী হামলায় জখম আশাশুনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন সত্যজিৎ মণ্ডল তার স্ত্রী মহারানী মণ্ডল ও তাদের মেয়ে রুপা মণ্ডলকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সত্যজিৎ মণ্ডল জানান, গত ৫ জানুয়ারি শ্রীউলা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা নৌকা প্রার্থী আবু হেনা শাকিলকে ভোট দেন। ৫ জানুয়ারি রাত ৯টার দিকে আবু হেনা শাকিল ভোটে পরাজিত হওয়ার খবর জানতে পারেন তিনি। এরপরপরই বল প্রতীকে পরাজিত ইউপি সদস্য প্রার্থী অলিউল্লাহ অলুর বাড়ির পাশে এক পথসভা করে নৌকায় ভোট দেওয়ার অভিযোগে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের উপর হামলার হুমকি দেওয়া হয়। ঘোষণা অনুযায়ি পরদিন সকালে তার বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। বাড়ির টিউবওয়েলটিও ভেঙে ফেলা হয়। এ হামলার নেপথ্যে ছিলেন গাজীপুরের বাবলু ও তাদের গ্রামের জামায়াত কর্মীরা।

সত্যজিৎ মণ্ডল আরো জানান, সহোদর রাধাপদ মণ্ডল ও সাধন মণ্ডলের সঙ্গে তার জল নিষ্কাশনের নর্দমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। বিষয়টি ১০ ফেব্র“য়ারি মীমাংসা করে দেন আওয়ামী লীগ নেতা মুকুল সরকার। এতে খুশী হননি স্থানীয় জামায়ত কর্মীরা। এরই জের ধরে ১১ ফেব্র“য়ারি রবিবার সকাল ৮টার দিকে তিনি বাড়ির পাশে যৌথ মালিকানাধীন ঘের হাজী ফিস এর বাসায় যাওয়ার সময় সেখানে আগে থেকে লুকিয়ে থাকা আফছারের ছেলে স্থানীয় জামাতের সাবেক রুকন আরিফুল, রমজান সানা, জহুরুল আকুঞ্জি, ইসরাফিল, আশাশুনি উপজেলা রাজারের ২১ নং তালিকাভুক্ত সোহরাব হোসেনের ছেলে গাজীপুর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানসহ ১৮/২০জন তাকে দা’ লাঠি, লোহার রড, লাবনা নিয়ে ধাওয়া করে।

একপর্যায়ে তার মাথায় ও ডান বাহুসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে জখম করা হয়। তার আত্মচিৎকালে মেয়ে সাতক্ষীরা সরকারি মহিলা কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী রুপা মণ্ডল তাকে রক্ষায় এগিয়ে এলে তার মাথার ডান পাশে ও পায়ে মাটি কাটার কাজে ব্যবহৃত লাবনা দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়। এরপর তার স্ত্রী মহারানী মণ্ডল ছুঁটে এলে তাকেও বিবস্ত্র করে পিটিয়ে ডান উরুসহ শরীরের বিভিন্ন স্তান জখম করা হয়। সেখান থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে বাড়ি আসার চেষ্টাকালে কয়েকজন হামলাকারি তাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে হাসপাতাল বা থানায় যাওয়ার চেষ্টা করলে খুন করার হুমকি দেয়।

বিষয়টি আশাশুনি থানাকে অবহিত করার চেষ্টা করলে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফোন রিসিভ না করায় তিনি ট্রিপল নাইনএ ফোন দেন। এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপপরিদর্শক নুরুন্নবী তাদেরকে উদ্ধার করে আশাশুনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখানে এসেও তাদেরকে হমকি দেয় হামলাকারিরা। বেগতিক বুঝে বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পারিবারিক বিরোধকে কাজে লাগিয়ে ঘটনাস্থলে না থাকা ভাই রাধাপদ মণ্ডলকে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় আহত দেখিয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি করে।

অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাদের তিনজনকে বুধবার বিকেলে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১১ জানুয়ারি তিনি বাদি হয়ে রমজান আলী ও জহুরুল আকুঞ্জিসহ ছয়জনের নাম উল্লেখকরে অজ্ঞাতনামা আটজনকে আসামী করে থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। জামাতা মহিষাডাঙা গ্রামের তুষার মণ্ডলের মাধ্যমে তিনি এজাহার থানায় পাঠান। এরপর ঘটনার তদন্তে আসা উপপরিদর্শক নুরন্নবী তাদের দেওয়া মামলা রেকর্ড করতে হলে প্রতিপক্ষের দেওয়া মামলাও রেকর্ড করা হবে বলে তাকে সতর্ক করেন। এমনকি হামলাকারিদের দারা প্রভাবিত হয়ে সংখ্যালঘু নেতা পরিচয়ে নীলকণ্ঠ সোম ও রণজিৎ বৈদ্য অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য তাকে বিভিন্ন ভাবে চাপ সৃষ্টি করেন।

সরেজমিনে বুধবার দুপুরে কাকড়াবুনিয়া গ্রামে যেয়ে দেখা গেছে থমথমে পরিস্থিতি বিরা করছে। ঘটনার কথা বলতেই কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না । তবে বিকাশ মণ্ডল, বিজলী মণ্ডল, আসাদুজ্জামান, শহীদুল ইসলামসহ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নৌকায় ভোট দেওয়ায় পারিবারিক বিরোধকে কাজে লাগিয়ে নব্য আওয়ামী লীগার বনে যাওয়া জামায়াত কর্মীরা ১১১ফেব্র“য়ারি রবিবার সকালে সত্যজিৎ মণ্ডল ও তার পরিবারের সদস্যদের উপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছে। পুলিশ না এলে তাদের চিকিৎসা দেওয়া কঠিন হতো। হামলার প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে পারিবারিক বিরোধকে কাজে লাগানো হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য কামরুল হুদা মিলন বলেন, গত সাত দিনেও মামলা না নেওয়ায় পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

রমজান সানা বলেন, পারবারিক বিরোধের জের ধরে হামলার শিকার হওয়া সত্যজিৎ পরিবার বিষয়টি অন্যখাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ আসাদুজ্জামান জানান, সত্যজিৎ মণ্ডল ও তার মেয়ে রুপার মাথা, হাতসহ বিভিন্ন স্থানে ভারী ও ধারালো জিনিস দিয়ে আঘাত করায় গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে ভারী জিনিস দিয়ে আঘাতের ফলে মহারানী মণ্ডলের ডান উরুসহ বিভিন্ন স্থানে বড় ধরণের জখম করা হয়েছে। তাদের সুস্থ হতে সময় লাগবে।

এ ব্যাপারে বৃহষ্পতিবার বিকেল তিনটায় আশাশুনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোমিনুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি ১১ ফেব্র“য়ারি সত্যজিৎ মণ্ডলের এজাহার পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, তার ভাই রাধাপদ মণ্ডলও একটি এজাহার দিয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়ে সত্যতা পেলে মামলা নেওয়া হবে। তবে ১১ তারিখের ঘটনার পরপরই উপপরিদর্শক নুরুন্নবী ঘটনাস্থলে গেলেও অভিযোগ প্রাপ্তির সাত দিন পর মামলা না নিয়ে আবার নতুন করে পুলিশ পাঠিয়ে ঘটনার সত্যতা যাঁচাই করার কোন কারণ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

(আরকে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২২)