চৌধুরী আ. হান্নান : টাকার প্রতি মানুষের আকর্ষণ দুর্নিবার। যে কোন উপায়ই হোক টাকা উপার্জন করা চাই। কিন্তু পরিশ্রম না করে হাত বাড়ালেই যদি টাকা পাওয়া যায়, তা অনেক মজার। কিছু লোকের হাত অনেক লম্বা, তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এবং ক্ষমতার বলয়ে নিরন্তর অবস্থানকারী। তারা টাকার জন্য হাত বাড়ায় ব্যাংকের দিকে, যেখানে জনগণ তাদের টাকা গচ্ছিত রাখে-আমানত রাখে। এ অর্থের পাহারাদার সরকার। সরকারের পক্ষে দায়িত্ব পালন করে ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ।

নিকট অতীতে দু’টি সরকারি ব্যাংকের (সোনালী ও বেসিক) পরিচালনা পরিষদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ, কেলেংকারীর বোঝা মাথায় নিয়ে তারা বিদায় নিয়েছেন। প্রায় আট হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, লোপাটে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। যতদূর জানা যায় বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ন পরিচালনা পরিষদ ভেঙ্গে দিতে সুপারিশ করে আসছিল কিন্তু অর্থমন্ত্রনালয় কাজটি সময়মত করেনি। এ বিলম্বের কারণ কী?

প্রায় সাড়ে তিনহাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় (হলমার্ক) সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদকে দায়মুক্তি দিয়ে দিয়েছে দুর্নীতিদমন কমিশন। কিন্তু অর্থমন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাননীয় মন্ত্রী তাঁরই নিয়ন্ত্রনাধীন মাত্র দু’টি প্রতিষ্ঠান থেকে আট হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ঘটনা থেকে তিনি কিভাবে দায়মুক্ত হবেন?

দুর্নীতিতে বিশ্বে প্রথম সারির একটি দেশের অর্থমন্ত্রী তিনি কিন্তু শত্রুরাও তাঁর ব্যাক্তিগত সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। তিনি একজন সংস্কৃতিমনা সাদামনের মানুষ। শিক্ষাগত যোগ্যতা আকাশ সমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে তিনি পড়াশুনা করেছেন এবং ১৯৫৪ সালে বি এ (অর্নাস) এ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তিনি অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অধ্যায়ন করেছেন। জনাব মুহিতের যে দিকে তাকানো যাবে সব দিকেই উজ্জ্বল আলো।

কিন্তু তাঁরতো বয়স হয়েছে। তিনি একজন বয়োবৃদ্ধ মানুষ। অশীতিপর বৃদ্ধ। অতিবৃদ্ধের কথা মত কাজ করা যায় না কারণ তাঁরা শিশুর মত। ৮০ বছর বয়সের একজন মানুষ-তার একান্ত ব্যক্তিগত কাজগুলো অন্যের সাহায্য ছাড়া সম্পন্ন করা কঠিন। এ বয়সে তিনি সরকার প্রধানকে কী পরামর্শ দেবেন? তাঁর এখন সময় হয়েছে সাবেক অর্থমন্ত্রী হিসেবে বড় বড় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথির আসন অলংকৃত করে মূল্যবান ভাষণ দেওয়া এবং সকলের মধ্যমনি হয়ে থাকবেন। আর উজ্জ্বল-বর্ণাঢ্য অতীতের স্মৃতিচারণ করে নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করবেন।

সম্প্রতি সুনামগঞ্জের হাওরে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠানের জন্য সি এস আর ফান্ড থেকে অর্থ বরাদ্ধের জন্য অর্থমন্ত্রী জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের নিকট সুপারিশ করেছিলেন বলে জানা যায়। সি এস আর (কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা) খাতে বরাদ্ধকৃত তহবিল মানবিক কারণ বিবেচনায় ব্যয় করা হয়। নৌকাবাইচ কোন মানবিক বিষয় নয় বরং বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড। জনতা ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল বারাকাত নৌকা বাইচে সি এস আর ফান্ড থেকে অর্থ বরাদ্ধ দেননি। এখানে নৈতিকতার বিজয় হয়েছে।

আমাদের অর্থমন্ত্রী অসংলগ্ন কথা বলার জন্য অতীতে অনেক বার সমালোচনার মুখে পড়েছেন, সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎকে ‘বেশি টাকা নয়’ বলায় জাতীয় সংসদেও তোপের মুখে পড়েন তিনি। মাননীয় সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও ক্ষোপ প্রকাশ করে বলেছিলেন-‘ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আপনার কাছে অল্প হতে পারে, আমাদের কাছে অনেক টাকা।’

সেখানেও বলা হয়েছিল-তাঁর তো বয়স হয়েছে। আশির দশকে সোনালী ব্যাংকে লুৎফর রহমান সরকার (এল আর সরকার) নামে বেতিক্রম ধর্মী-উদার মনোভাবের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আগমন ঘটেছিল। তিনি সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়েছিলেন। তিনি ছাত্রদের জন্য প্রথম শিক্ষাঋণ প্রবর্তন করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা বেকার যুবকদের সাময়িক কর্ম সংস্থানের জন্য ‘বিকল্প’ নামে একটি ঋণ কর্মসূচী চালু করেছিলেন। নতুন নতুন কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড উদ্ভাবন করে ব্যাংকিং জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। এ সব কর্মসূচী সামাজিক দায়বদ্ধতার বিবেচনা থেকেই এসেছিল। কিন্তু বিধি বাম! তৎকালীন এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ‘বিকল্প’ ঋণ কর্মসূচী তাঁর সুপারিশকৃত তালিকা অনুযায়ী দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এল আর সরকার ঋণ মঞ্জুরীতে রাজনৈতিক বিবেচনা মেনে নেননি। তারপর এদেশে যা হবার তাই হলো। তাঁকে ফাঁসানোর জন্য সোনালী ব্যাংক নানা তদন্ত শুরু করে দেয় বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু তাঁকে শাস্তি দেওয়ার মত কোন কিছু পায়নি। কিন্তু তাতে কী? পানি ঘোলা করার গল্প আছে না! অবশেষে ব্যাংকের আপ্যায়ন খাতে অধিক ব্যয় করা হয়েছে-এমন অভিযোগ তুলে তৎকালে চলমান সামরিক আদালতে ‘বিচার’ করে লুৎফর রহমান সরকারকে জেলে পাঠানো হয়েছিল।

যাহোক,পরবর্তী সরকার তাঁকে পুরস্কৃত করেছিল। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ অলংকৃত করেছিলেন।


ইতিমধ্যে ব্যাংকের সি এস আর ব্যয় খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নির্দেশ দিয়েছে অর্থমন্ত্রনালয়। এ নির্দেশনা নৌকা বাইচ অনুষ্ঠানে অর্থ বরাদ্ধ না দেয়ার ফল বলে অনেকেই বিশ্বাস করবেন। এ ধরণের ঢালাও নির্দেশনার ফলে ব্যাংক গুলো এ খাতে ব্যয় করার আগ্রহ হারাবে। এমনিতেই ব্যাংক কোন অলাভজনক কাজে বিনিয়োগ করতে চায় না। দারিদ্র বিমোচন, দরিদ্র মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান, প্রতিবন্ধীদের পুর্নবাসন ইত্যাদি সি এস আর কার্যক্রমে ব্যাংক গুলোর অংশ গ্রহণ রীতিমতো একটা প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে চলে এসেছিল। এখাতে ব্যাংকগুলো তাদের বার্ষিক লভ্যাংশের একটা সামান্য অংশ ব্যয় করে থাকে।

অপরদিকে ব্যাংক থেকে হরহামেশা হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ, লোপাট হচ্ছে সে দিকে ব্যাংকের রেগুলেটরি বডির কার্যকর কোন ভ্রুক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকারি ব্যাংক বহু কেলেংকারীতে জর্জরিত, ক্ষেত্র বিশেষে দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত। বলা যায় ব্যাংক পাড়া প্রায় অরক্ষিত। লম্বা হাতওয়ালারা ব্যাংক থেকে কেবলই টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংক ব্যবস্থা অকাযৃকর হবার আশংকা সৃষ্টি হবে। এখনই বেসিক ব্যাংকের এল সি কেউ গ্রহণ করছে না। অর্থাৎ বেসিক ব্যাংকের কমিটমেন্টের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে।

বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বয়োবৃদ্ধ নয়, একজন শক্ত-সমর্থ নেতার দরকার এবং কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ভরসা না করে বিশিষ্ট ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, অর্থনীতিবিদের পরামর্শ গ্রহণ করে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এসেছে।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার


(এএস/সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪)