শেখ এনামূল হক বিদ্যুৎ, সোনারগাঁ : মুকুলের মৌ মৌ গন্ধে মুগ্ধ হয়ে উঠছে প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ের বিভিন্ন এলাকা। থোকায় থোকায় লিচুর মুকুল দুলছে বসন্তের মাতাল হাওয়ায়। সবুজ পাতার ফাঁকে হলদেটে সোনালী মুকুল গুচ্ছ যেনো হাসছে। সেই হাসিতে মাতাল হয়ে মৌমাছিগুলো উড়ছে তো উড়ছেই। বাগানের সুনসান নীরবতা চিরে একটানা গান শোনাচ্ছে ঝিঁ ঝিঁ পোকা।

গাছে মুকুল আসার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। তারা এবার বাম্পার ফলনের আশা করছেন। তাদের আশা, গত বছর লিচু বিক্রি করে যে লোকসান হয়েছিল তা এ বছর পুষিয়ে উঠবেন। কৃষিবিদরা বলছেন,এবার শীত দীর্ঘায়িত হওয়ায় ও তাপমাত্রা কম থাকায় গাছের বৃদ্ধি কম হয়েছে। তাই এবার পুস্পমঞ্জুফরী আগাম এসেছে।

সাধারণত মার্চ মাসের প্রথম দিকে লিচু গাছে মুকুল আসতে শুরু করে। আর লিচুর মুকুল ফুটে মার্চের মাঝামাঝি সময়ের পরে। তবে চলতি মৌসুমে প্রায় ১৫ দিন আগেই মুকুল এসেছে। ইতিমধ্যেই অনেক গাছের মুকুল ফুটতেও শুরু করেছে। কৃষকরা এবার ভাল ফলনের পাশাপাশি ভাল দামেরও আশা করছেন। গত বছরে যে সময় লিচু পরিপক্ক হয়ে বাজারে উঠেছিল ওই সময়টা ছিল রমজান মাস। তাই অনেকেই আশানুরুপ দাম পাননি, অনেকেই সেবার লোকসান গুনেছেন। এরই মধ্যে স্বপ্নে বিভোর লিচু চাষীরা ব্যস্ত বাগানের পরিচর্যায়। আগেই কিনে রাখা বাগান দেখে যাচ্ছেন মৌসুমী ফল ব্যবসায়ীরা।

শিলা বৃষ্টি বা কালবৈশাখীর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের থাবায় না পড়লে সোনারগাঁয়ে এবার লিচু উৎপাদনে রেকর্ড হবে বলে মনে করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের ১টি পৌরসভা ও ৫টি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায় রসালো ফল লিচু গাছের প্রত্যেকটিতেই মুকুল এসেছে।

বাগান চাষি কিংবা গাছ মালিকদের সোনালী স্বপ্ন উঁকি মারছে সবুজ পাতার ফাঁকে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে আগামী মাসে লিচুর মৌসুমে প্রচুর লিচু বাজারজাত করতে পারবে, এমন আশাবাদ বাগান চাষিদের।

এরইমধ্যে ভাল ফল পাওয়ার আশায় বাগান চাষিরা লিচু গাছের পরিচার্যা শুরু করেছে। মুকুল আসা শুরু থেকেই গাছের গোড়ায় পানি দিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর ফুল ঝড়ে পড়ে তা থেকে লিচুর গুটি বের হবে। তখন কীটনাশকসহ বিভিন্ন ভিটামিন জাতীয় স্প্রে করবে কৃষকেরা।

লিচুর বাগান দেখতে গিয়ে কথা হয় এলাকার লিচু চাষী মিঠু আহমেদের সঙ্গে। দৈনিক বাংলা ৭১"কে তিনি বলেন, দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়, রসালো ফল লিচু। সুগন্ধ ও টকমধু স্বাদের জন্য ছোট-বড় সবার কাছেই প্রিয় এ ফলটি। এবার গাছে প্রচুর মুকুল এসেছে। ভালো ফলন পেতে নিয়মিত গাছের পরিচর্যা করছি।

লিচুর মুকুল থেকে ফুল ফুটতে প্রায় ১৫ দিন সময় লাগে। সেই ফুল থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ লিচুর আকার পেতে সময় লাগে আরও ৩০ দিন। সেই আকার থেকে পরিপক্ক হয়ে বাজারজাত করতে সময় লাগে ৩৫ থেকে ৪৫ দিন। মুকুল থেকে বাজারজাত করা পর্যন্ত লিচুর জাত ভেদে প্রায় তিন মাস পর্যন্ত সময় লাগে। মুকুল আসার আগ থেকে ফল আসা পর্যন্ত প্রায় তিন মাস সঠিক পরিচর্যা খুবই জরুরি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার রেকর্ড পরিমাণে লিচু উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন এই লিচু চাষি। আগের বছরগুলোর মতো, এবারও দুই বিঘা জমিতে লিচু চাষ করেছেন তিনি।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়,সোনারগাঁ উপজেলার পানাম, গোয়ালদী, বৈদ্যের বাজার, ভট্টপুর, গাবতলী, হারিয়া, অর্জুন্দী, গোবিন্দপুর, কৃষ্ণপুরা, বাগমুছা,হাতকোপা, দত্তপাড়া, খাসনগর, দীঘিরপাড়, চিলারবাগ, দৈলরবাগ, দরপত, টিপরদী, হরিষপুর, তাজপুর, সাদীপুর, ইছাপাড়া, দুলালপুর, বারদী, সেনপাড়া, বালুয়া এলাকার বাগানে পাতি, কদমী আর বোম্বাই এই তিন প্রজাতির লিচুর ফলনই বেশি দেখা যায়।

তবে এর মধ্যে পাতি লিচুর ফলন সবচেয়ে বেশি হয়। তা ছাড়া এ প্রজাতির লিচু সবচেয়ে আগে আসে বাজারে । সোনারগাঁ পৌরসভার দিঘীর পাড় এলাকার লিচু চাষি মনির হোসেন বলেন, বাগান কয়েক ধাপে বিক্রি হয়। গাছে মুকুল আসার আগেই এবং লিচু গুটি হওয়ার পরে বাগান বিক্রি হয়। লিচু পাকার আগেই বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয় বাগানের মালিকানা। তবে অনেক বাগান মালিকরা লাভের আশায় নিজেই শ্রম দেন। অনেক সময় খরার কারণে লিচুর আকার ছোট হয়ে যায়। আবার অনেক সময় বৈশাখী কালবৈশাখী ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড হয় লিচু বাগান। তখন ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় লিচু চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

সোনারগাঁ উপজেলার কৃষি অফিসার মনিরা আক্তার জানান, চলতি মৌসুমে এবার উপজেলায় বসতবাড়ি সহ বিভিন্ন স্থানে ১o০ হেক্টর জমিতে লিচুর গাছ রয়েছে। আমরা লিচু চাষি সহ বসত বাড়িতে থাকা লিচুর উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গাছ মালিকদের সেবা দিয়ে আসছি। এখন লিচুর মুকুল এসেছে তাই গাছের গোড়ায় পানি দেওয়াসহ বাগানে কীটপতঙ্গ, মাকড়সা দূর করার জন্য বালাইনাশক স্প্রে করা সহ গাছ ও মুকুলের যত্ন নেওয়ার বিষয়ে গাছ মালিকদের সঠিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া উপজেলা কৃষি উপ-সহকারী, জনবল নিয়ে লিচুর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মাঠে কাজ করছেন।

(এসএএইচবি/এএস/মার্চ ১৮, ২০২২)