মুনিফ আম্মার : ঘোষণাটি প্রথম আসে ফেসবুকে। সে ঘোষণার সঙ্গে যুক্ত হয় কয়েকজন। জড়ো হয় শাহবাগে। গুটিকয়েক সে মানুষগুলোর তখন একটি ব্যানার ছিল ‘ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক’। এ ব্যানারের পেছনে দাঁড়ানো সবাই অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন না। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী আর মুক্তবুদ্ধি চর্চার কিছু মানুষও ছিলেন সে সারিতে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। মানুষগুলোর অবস্থান নড়ে না। ক্রমেই বড় হতে থাকে দল। ৬০ জনের সঙ্গে যুক্ত হয় দ্বিগুণ। সিদ্ধান্ত হয় রাত কাটবে শাহবাগেই। দাবি একটাই- ‘যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি’।

গোল হয়ে বসে পড়লো সবাই। শাহবাগের মূল চত্বর দখল করে নিলো। মুখে মুখে চলছে স্লোগান। থেকে থেকে সম্মিলিত সুরে ছড়িয়ে পড়ছে দেশাত্ববোধক গান। না, কোনো মাইক কিংবা শব্দযন্ত্র ছিল না। উদ্যাম তারুণ্য খালি গলাতেই গাইতে থাকে সব। রাত পেরুতেই পাল্টে গেলো দৃশ্যপট। মৌমাছির ঝাঁকের মতো মানুষের স্রোত ছুটলো শাহবাগের দিকে। কী ওখানে? অমন প্রশ্ন ছিল অনেকের মুখেই। কিন্তু উত্তরের আগেই প্রতিবাদে উত্তাল শাহবাগের খবর ছড়িয়ে পড়লো সবখানে। কোনো নেতা নেই, নির্দেশক নেই, ছিল না পৃষ্ঠপোষকও। ছিল তারুণ্য, সীমাহীন দেশাত্ববোধ, অফুরাণ শক্তিমাখা ফাঁসির দাবি। প্রথম দিনেই বহুমাত্রিক প্রতিবাদের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে শাহবাগ থেকে। ব্যানার ফেস্টুনের দাবি ছাপিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদী অঙ্কন, সুবিশাল স্বাক্ষরাভিযান, সাপ লুডু খেলায় কাদের মোল্লার ফাঁসি চাওয়া হয়। দু একদিনেই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রতিবাদের আরো অনেক রঙ। নিরবে বসে ‘অপেক্ষা’, খাঁচার ভেতর বন্দিত্বের প্রকাশ আর ফাঁসির মঞ্চও যুক্ত হয় এ প্রতিবাদে। দল বেঁধে প্রতিবাদী গান, মুক্তিযুদ্ধের নাটক, চলচ্চিত্রেও ছিল শক্তিশালী প্রতিবাদ। ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই মানুষের স্রোত এসে মিশে শাহবাগে। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থী, অফিস ফেরত যুবক কিংবা খেটে খাওয়া মধ্য আয়ের মানুষও দেখা গেছে সে আন্দোলনে। আন্দোলনের অভিমূখ তখনও সবার কাছে অজানা। তবে এটুকু সবাই জানতো, কাদের মোল্লাসহ অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিই এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী অবস্থানের ঘোষণা এলো। তবুও মানুষ কমছে না, বরং বাড়ছেই। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখেই চলছিল আন্দোলন। দু’দিন পর ৮ ফেব্রুয়ারি মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হলো। কোত্থেকে যে এতো মানুষের ঢল নেমেছে, কেউ বলতে পারছে না। মানুষ আসছে আর আসছে। শাহবাগ কেন, মানুষে মানুষে ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। প্রথম সমাবেশেই সভাপতিত্ব করেন ইমরান এইচ সরকার। বক্তব্য দেন শিক্ষাবীদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। সমাবেশের শেষের দিকে ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন ইমরান। তার পরেই এ আন্দোলনের নাম দেয়া হয় ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ আর শাহবাগের নাম দেয়া হয় ‘প্রজন্ম চত্বর’। সেদিনই ঘোষণা আসে ছয় দফা দাবির। চলতে থাকে আন্দোলন। প্রতিদিন হাজারো মানুষের ভীড় জমে শাহবাগে। কী দিন, কী রাতে। মধ্যরাতেও জেগে থাকে। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল আন্দোলন চলতেই থাকে। যেনো দাবি আদায় করেই ফিরবে। এক সপ্তাহ পর ১৫ ফেব্রুয়ারি আবার সমাবেশের ডাক দেয়া হয় শাহবাগে। ততোদিনে শাহবাগ আন্দোলনের রূপরেখা ঠিক করা হয়ে গেছে। ইমরান এইচ সরকারই গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সেদিনের সমাবেশে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন। সমাবেশ শেষে রাতের দিকে পরদিন থেকে আন্দোলনের নতুন দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু সে রাতেই ঘটে ঘটনাটা। আন্দোলনের অন্যতম কর্মী ব্লগার রাজিব হায়দারকে (থাবা বাবা) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। আন্দোলনে নতুন মোড় নেয়। আবার গর্জে ওঠে শাহবাগ, ফুঁসে ওঠে সবাই। বাড়ি ফিরতে গিয়েও আবার সবাই জড়ো হয় শাহবাগে। পরদিন বিকেলে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে রাজিবের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় শাহবাগেই। এরপর একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা চলে শাহবাগের আন্দোলন। ওইদিন বিকেলে ২৬ মার্চ পর্যন্ত সরকারকে আলটিমেটাম দিয়ে প্রতিদিন বিকেলে জমায়েতের ঘোষণা দিয়ে শাহবাগ মোড় খুলে দেয়া হয়। তারপর রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চলে গণজাগরণ সমাবেশ। কেবল সমাবেশ আর রাজপথে প্রতিবাদ নয়, গণজাগরণ মঞ্চ তাদের প্রতিবাদের দাবি ছড়িয়ে দেয় সবখানে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছেও নিয়ে যায় ছয় দফা প্রস্তাব। গণস্বাক্ষরতা অভিযান চালায় পুরো দেশব্যাপী। এককোটি স্বাক্ষর নিয়ে স্পিকারের কাছে পৌঁছে দেয় তারা। নিজেদের দাবি নিয়ে দেশ ও বিদেশে গড়ে তোলে তীব্র আন্দোলন। আর এই আন্দোলনের মুখেই সংশোধন হয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন। আরো শক্তি নিয়ে চলতে থাকে গণজাগরণ মঞ্চের এ আন্দোলন। তাদের দাবির মুখে এক সময় হাইকোর্ট যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় দেন। সেদিন বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ে শাহবাগের আন্দোলনকারীরা। বিজয়ের পথে এগুতে থাকে গণজাগরণ মঞ্চ। ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় কাদের মোল্লাকে। একবছর জুড়ে গণজাগরণ মঞ্চ তাদের আন্দোলনের প্রথম সফলতা পায়। তবে সব যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চালিয়ে যাবে তারা। এরই মধ্যে রোডমার্চ, স্বাক্ষরতা ও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ তাদের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।