গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ মারা যাওয়া ইস্তক তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং অতি-চর্চিত 'ম্যাজিক রিয়্যালিজম' নিয়ে বিস্তর লেখালিখি হয়েছে, এবং হয়ে চলেছে৷ হওয়ারই কথা৷ কারণ তিনি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন সাহিত্যে৷ ১৯৮২ সালে৷ কিন্ত্ত সত্যিই কি 'গাবো' ওরফে গ্যাব্রিয়েল সাহিত্যিকই হতে চেয়েছিলেন? নাকি, তাঁর স্বপ্ন ছিল ভুবনবিখ্যাত চলচ্চিত্রকার হওয়ার? অন্তত ইতিহাস তো তেমনই বলছে৷

তিনি নাকি লেখক হওয়ার আগে হতে চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রনির্মাতা৷ ইতিহাস হয়ে যাওয়ার পরে গার্সিয়া মার্কেজের নেপথ্যের অন্য গল্প খুঁজে দেখলেন অনিরুদ্ধ ধর


বছর দুয়েক আগে 'স্প্যানিশ সিনেমাথেক স্টেট ফিল্ম ইনস্টিটিউট' গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা একটা ফিল্ম ট্রিটমেন্ট খুঁজে পায়৷ এবং জানা যায়, গ্যাব্রিয়েল এই ট্রিটমেন্ট নোট-টি পাঠিয়েছিলেন সাররিয়্যালিস্ট চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েল-কে৷ সেটা ১৯৬২ সাল৷ এই ছোট্ট অথচ বিস্ফোরক সংবাদটি প্রকাশিত হয় 'এল পায়াস' সংবাদপত্রে৷ সংবাদপত্রের সাংবাদিককে সিনেমাথেকের কিউরেটর হেভিয়ার হেরেরা জানান, 'সম্ভবত গার্সিয়া মার্কেজ চেয়েছিলেন এই চিত্রনাট্য নিয়ে লুই বুনুয়েল যেন ছবিটি তৈরি করেন৷ কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত বুনুয়েল ছবিটি তৈরি করেননি অথবা আদৌ তিনি চিত্রনাট্য পড়ে দেখেছিলেন কি না, তা জানা যায়নি৷' 'ইটস সো ইজি, মেন ক্যান ডু দ্যাট' শীর্ষক কমেডি ছবির এই প্রপোজালটি বুনুয়েল আর্কাইভে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন৷ এই ঘটনাটা ১৯৬২ সালের৷ এর আগে খান কয়েক ছোট গল্প আর গোটা দুই ছোট উপন্যাস লিখেছিলেন গার্সিয়া মার্কেজ৷ তখনও পর্যন্ত তিনি সেভাবে লেখক হিসাবে স্বীকৃতি পাননি৷ নোবেল পুরস্কার তখনও ২০ বছর দূরে৷

আর লুই বুনুয়েল? তিনি তখন দূর আকাশের তারা৷ সেই যে সালভাদোর দালিকে নিয়ে 'অ্যান অ্যান্দালুশিয়ান ডগ' বানিয়ে চমকে দিলেন গোটা বিশ্বকে, তারপর একে একে 'দ্য গোল্ডেন এজ', 'ল্যান্ড উইদআউট ব্রেড', 'নাজারিন', 'ভিরিদিয়ানা' বানিয়ে ফেলেছেন৷ গোটা বিশ্বের চলচ্চিত্রমোদীরা তাঁকে একবাক্যে চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে চিহ্নিত করে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই৷ গার্সিয়া মার্কেজের ফিল্ম ট্রিটমেন্ট নোট তাঁর কাছে যখন এসে পৌঁছচ্ছে, তখন বুনুয়েল ব্যস্ত 'দ্য একসটারমিনেটিং এঞ্জেল' বানানোর কাজে৷ অনেক পরে 'নিউ ইয়র্ক টাইমস' এই ছবিটিকে আজ পর্যন্ত তৈরি হওয়া সেরা সিনেমায় স্থান দিয়েছে৷ এরকম একটা সময়ে গার্সিয়া মার্কেজের একটি মামুলি চিত্রনাট্যকে সময় কেন দেবেন লুই বুনুয়েল? কী ছিল সেই গল্প?

তিন যুবতী৷ ছটফটে৷ খুশিখুশি তারা তিন জনেই৷ যদিও এই তিন জনেই একে অপরের তুতো বোন, তবুও প্রত্যেকেই একে অপরের অপরিচিত৷ দেশের নানা জায়গা থেকে তারা উড়ে আসে রাজধানীতে৷ তিন জনেই উত্তেজিত৷ কারণ তাদের অবিবাহিত খুড়ো মারা যাওয়ার আগে তাদের জন্য নাকি রেখে গিয়েছে এক সম্পত্তি৷ কিন্তু সেই সম্পত্তি চোখে দেখার পর তাদের সব স্বপ্ন উধাও৷ তারা ভেবেছিল, খুড়ো বুঝি রেখে গিয়েছে এক সোনার খনি, বদলে তারা দেখল, সম্পত্তিটা একটা প্রায় না চলা পেট্রল পাম্প৷ ধাক্কাটা কাটলে তারা তিন জনে স্থির করল, দেখাই যাক না একবার এক গ্যাস স্টেশনটা চালু করে৷ কিন্তু চালু করার পর শুরু হল একের পর এক বিপদ৷ সেই বিপদ এবং বাধা অতিক্রম করে একদিন তারা সফল করে তুলল তাদের গ্যাস স্টেশনকে৷ গল্পটা কমেডির মোড়কে রাখা৷ আর গল্পের নামটাও গার্সিয়া মার্কেজ দিয়েছিলেন জব্বর৷ 'এমনকী ছেলেরাও পারবে, এতটাই সহজ'৷ অর্থাত্‍ একেবারে বিপ্রতীপ জায়গা থেকে পুরুষদের দেখা৷ এই লেখা বুনুয়েল দেখেছিলেন কি না, জানা যায়নি৷ এমনকী যখন এই ফিল্ম ট্রিটমেন্ট সিনেমাথেক থেকে আবিষ্কৃত হল, তখন ৮৪ বছরের গার্সিয়া মার্কেজ স্মৃতিবিলোপ অসুস্থতায় ভুগছেন৷ ফলে এই চিত্রনাট্য সম্পর্কে কোনও তথ্যই আর পাওয়া সম্ভব হল না৷ কিন্ত্ত এটাই যে, কেবল গার্সিয়া মার্কেজের চলচ্চিত্র সংযোগ, তা কিন্তু নয়৷



ছোট গল্প আর খানকয়েক চিত্রনাট্য লেখার আগে তিনি ছিলেন সাংবাদিক৷ এবং তিনি ছিলেন একজন চলচ্চিত্র সমালোচক৷ হাভানা ফিল্ম ইনস্টিটিউট তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাই করেননি, তিনি ছিলেন সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী পরিচালক৷ এমনকী লাতিন আমেরিকান ফিল্ম ফাউন্ডেশনের তিনি ছিলেন অন্যতম স্তম্ভ৷ যে মানুষটি পরবর্তীকালে 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অফ সলিটিউড' কিংবা 'দ্য অটাম অফ দ্য পেট্রিয়ার্ক' লিখবেন, তাঁর ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠার আগে সিনেমার প্রতি এমন আত্মনিবেদন বিস্ময়কর বৈকী! নিজের লেখা প্রসঙ্গে তিনি বারবার বলেছেন, তাঁর প্রতিটি কাহিনি অনুপ্রাণিত হয়েছে, তাঁরা নানা বয়সের দেখা ভিজ্যুয়াল ইমেজ দ্বারা৷ এবং এই প্রতিটা দৃশ্যকল্প, তাঁর নিজের ব্যক্তিজীবনকেও নানাভাবে প্রভাবিত করেছে৷ এবং এই কারণেই তাঁর রচনার মধ্যে নিহিত ভিজ্যুয়াল এবং গ্রাফিক গুণই তৈরি করেছে তাঁর নিজস্ব লেখার শৈলী৷



এমনও কী হতে পারে, যে দৃশ্যকল্পর সমাহার নিয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন, তা তাঁর মধ্যে চলচ্চিত্রকার হওয়ার বাসনা তৈরি করে দিয়েছিল? এবং চলচ্চিত্র সমালোচনা করতে করতে তাঁর কি মনে হয়েছিল, যে ধরনের সিনেমা তিনি দেখছেন, তার কোনওটিই যথার্থ অর্থেই ভিজ্যুয়াল আর্ট নয়? এর একটা বদল হওয়া উচিত ভেবে নিজেই চলচ্চিত্রকার হওয়ার বাসনায় চিত্রনাট্য রচনার কাজে হাত দিয়েছিলেন? এবং এমনই একটা চিত্রনাট্য তিনি পেশ করেছিলেন তত্‍কালীন শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েলের কাছে, যাঁর পরাবাস্তব দৃশ্যকল্প গার্সিয়া মার্কেজের পছন্দ হয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত মার্কেজ চলচ্চিত্রকার হননি, হয়েছেন সাহিত্যিক, যিনি উপহার দিয়েছেন পৃথিবীকে 'ক্রনিকল অফ দ্য ডেথ ফোরটোলড', 'নো রাইটস টু দ্য কর্নেল', 'লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা' কিংবা 'মেমারিজ অফ মাই মেলানকোলি হোরস'-এর মতো উপন্যাস৷



প্রতিটা উপন্যাসেই শুধু মামুলি গদ্য নয়, রয়েছে অত্যন্ত স্পষ্ট ভিজ্যুয়াল প্রোজ৷ আর এই কারণেই তাঁর উপন্যাস নিয়ে ছবি করাটা প্রায় দুরূহ হয়ে উঠেছে যে কোনও চলচ্চিত্রকারেরই কাছে৷ ১৯৮১ সালে 'প্যারিস রিভিউ'-এ এক সাক্ষাত্‍কারে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আজ পর্যন্ত তাঁর কোনও উপন্যাসই কি সঠিকভাবে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, তার উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, 'আমি আজ পর্যন্ত একটি সিনেমার কথাও ভাবতে পারছি না, যেটা মূল ভালো উপন্যাসকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছে৷ কিন্তু আমি অনেক ভালো সিনেমার নাম উল্লেখ করতে পারি, যেগুলো তৈরি হয়েছে খুব খারাপ উপন্যাস থেকে৷' না, নিজের কোনও উপন্যাসর প্রসঙ্গে এই কথাগুলো তিনি বলেননি৷ কিন্তু এই উত্তরের মধ্যে যে ইশারা নিহিত আছে, তা খুবই স্পষ্ট৷



'এরেন্ডিরা'র মূল চিত্রনাট্যটি মার্কেজ লেখেন ১৯৭২ সালে৷ একটা সময় সেই চিত্রনাট্য খোয়া যায়৷ কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিচালক রুই গেরা-র জন্য তিনি আরও একবার স্মৃতি থেকে লিখে দিয়েছিলেন ছবির চিত্রনাট্য৷ এটি তাঁর লেখা তৃতীয় চিত্রনাট্য৷ স্মৃতি থেকে তিনি প্রথমে লেখেন একটি অণুউপন্যাস এবং তার থেকে তৈরি করেন চিত্রনাট্য৷ মেক্সিকোতে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮৩ সালে৷ ১৯৮৭ সালের ইতালিয় চলচ্চিত্রকার ফ্রান্সেসকো রোসি পরিচালনা করেন 'ক্রনিকল অফ আ ডেথ ফোরটোলড'৷ ছবিটির সমালোচনা করতে গিয়ে এম্পায়ার কাগজের সমালোচক গ্যাভিন বেনব্রিজ লেখেন, 'গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কোনও রচনা থেকে ছবি তৈরি করাটা কখনও খুব একটা সহজ কাজ নয়৷' শেষ পর্যন্ত তাঁর বক্তব্য, ব্যাপারটা দাঁড়ায়নি৷ ১৯৯৯ সালে কান চলচ্চিত্র উত্‍সবে প্রথম প্রদর্শিত হয় আরট্যুরো রিপস্টেইনস-এর 'নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল'৷ হাজার দিনের যুদ্ধ লড়ে আসা এক প্রাক্তন মিলিটারি কর্নেলের গল্প৷ অনেকের মতে, নোবেল প্রাইজ জেতা লেখকের এটিই শ্রেষ্ঠ অ্যাডাপটেশন৷



গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাস অবলম্বনে এর পরের ছবি ২০০৭ সালে তৈরি হয় 'লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা'৷ ফার্মিনা-ফ্লোরেনতিনো-ডক্টর জুভেনাল উর্বিনো-- এই তিন চরিত্রকে ঘিরে ত্রিভূজ প্রেমের গল্প৷ ছবিটির পরিচালনা করেছিলেন মাইক নেওয়েল৷ ছবির প্রযোজক ছিলেন স্কট স্টাইনডর্ফ৷ প্রায় তিন বছরের সাধ্য সাধনা করে স্কট এই উপন্যাসের স্বত্ত কিনেছিলেন মার্কেজের কাছ থেকে৷ স্কট নাকি মার্কেজকে বলেছিলেন, তিনি কাহিনির চরিত্র ফ্লোরেনতিনোর মতো, যে ৫০ বছর অপেক্ষা করেছিল প্রেমিকা ফার্মিনাকে পাওয়ার জন্য৷ অতএব তিনি ততদিনই অপেক্ষা করবেন, যতদিন না মার্কেজ তাঁকে কাহিনির রাইট দিচ্ছেন৷



এই প্রথম লাতিন আমেরিকার বাইরে হলিউড স্টুডিওতে তৈরি হল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাস নিয়ে ছবি৷ ছবি তৈরির শেষে মুক্তির আগে ছবিটি দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মার্কেজকে৷ মেক্সিকোতে বসেই তিনি ছবি দেখলেন৷ যতক্ষণ ছবিটা চলেছে, ততক্ষণ তিনি কোনও কথা বলেননি৷ ছবি শেষ হলে মৃদু হেসে তিনি নাকি একটিই শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন, 'ব্রাভো'৷ এই শব্দটির নিহিত অর্থ কী, তা অনুমান সাপেক্ষ৷



২০১২ সালে স্পেন-ডেনমার্ক-মেক্সিকো থেকে তিন জন প্রযোজক একসঙ্গে প্রযোজনা করেন গার্সিয়া মার্কেজের শেষ রচনা 'মেমারিজ অফ মাই মেলানকোলি হোরস'৷ পরিচালনা করেন ডেনমার্কের পরিচালক হেনিং কার্লসেন৷ ছবিটি মালাগা স্প্যানিশ চলচ্চিত্র উত্‍সবে স্পেশাল ইয়াং জুরি প্রাইজ পায়৷ ছবিটি ২০১৩ সালের কলকাতা চলচ্চিত্র উত্‍সবে প্রদর্শিতও হয়েছিল৷ কিন্ত্ত মার্কেজ-পড়া বাঙালি ছবিটিকে বিশেষ পছন্দ করেনি৷

(লেখক : কলকাতার কথা সাহিত্যিক

(ওএস/এইচ/এপ্রিল ২৫, ২০১৪)