তাপস রায়হান : পৃথিবীজোড়া চলচ্চিত্রের বিশাল ফাঁদ পাতা। কয়েকটি দেশ ছাড়া দুনিয়ায় চলচ্চিত্রের অসংখ্য দর্শক। সিনেমাহলও কম না। নির্মাণ সম্ভব না হলে দেখাতে হয় আমদানি করে। একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে - বর্তমানে প্রতিদিন পৃথিবীতে ২৫ থেকে ৩০ কোটি মানুষ সিনেমা দেখে। কিন্তু অতীতের চেহারাটা কেমন ছিল?

পূর্ণাঙ্গ সবাক চলচ্চিত্রের প্রথম প্রচলন ১৯২৭ সালে, আমেরিকায়। সেটি ছিল সাদাকাল। রঙ্গিন চলচ্চিত্রের নানা উপায় ১৯০৬ সাল থেকে উদ্ভাবিত হলেও প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের উপযুক্ত পদ্ধতির প্রচলন ১৯৩৫ সালে। আমেরিকার রুবেন মামুলিয়ান পরিচালিত বেকি শার্প ছবিতে প্রথম পূর্ণাঙ্গ রঙের ব্যবহার। বিরাট ক্যামেরার মধ্য দিয়ে তিনটি রংবাহী তিনটি আলাদা ফিল্মের সাহায্যে তখন রঙ্গিন ছবি তোলা হতো।

জর্জ মেলিয়েস। একজন ব্যবসায়ী, অভিনেতা, থিয়েটারের প্রযোজক এবং জাদুকর। তিনি শুধু সুপরিচিত ট্রিকশটের জন্মদাতাই নন, কাহিনী বর্ণনার সূত্রপাতও তার হাতে। তাঁর ভয়েজ টু দি মুন ছবির কলাকৌশলে এখনও বিস্মিত সিনেমাবোদ্ধারা। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৭। পরবর্তীসময়ে আমাদের হীরালাল সেন ও দাদাভাই ফালকে তরুণ বয়সেই নেমেছিলেন চলচ্চিত্রের সাদাকাল দুনিয়ায়।


আমাদের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’। ১৯৫৫ সালে অনেক ঝুঁকি আর স্বপ্ন নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান আব্দুল জব্বার খান। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় ছবিটি। এই বাংলায় শুরু হয় সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা। ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের এফ.ডি.সি। তখন তিনি প্রাদেশিক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রী। সেই থেকে এ পর্যন্ত যত শিল্পসম্মত ছবির পরিচালক আমরা পেয়েছি তার ৯০ শতাংশই তরুণ। জহির রায়হানের ‘ জীবন থেকে নেয়া’ বা ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবির কথা আদৌ ভোলা সম্ভব ? তখন তিনি পরিপূর্ণ যুবক।

আমাদের দেশে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের বাইরে ‘বিকল্প ধারা’ নাম দিয়ে একটি চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে ’৮০’র দশকের শুরুতে। একের পর এক মুক্তি পেতে থাকে চিন্তাশীল সব নান্দনিক ছবি। বাণিজ্যিক ছবির অশ্লীলতা, সিনেমা হলের দম বন্ধ করা নোংরা পরিবেশ মধ্যবিত্তকে সরিয়ে নেয় বাণিজ্যিক ছবি থেকে। স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র হারাতে থাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির দর্শক । অন্যদিকে, সেই মধ্যবিত্তকে কাছে টেনে নেয় বিকল্প ধারা।

১৯৮২ সালে তিন মেধাবী তরুণ শুরু করেন ৩টি চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ। তানভীর মোকাম্মেল শুরু করেন ‘হুলিয়া’, তারেক মাসুদ শুরু করেন ‘আদম সুরত’ এবং মোরশেদুল ইসলাম ‘আগামী’। হুলিয়া মুক্তি পায় ১৯৮৫ এবং আদম সুরত মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যায় আরও কিছু ছবির কাজ। তরুণদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ এবং বহুমাত্রিক উদ্দীপনার কাজ করে আন্দোলনটি। এগিয়ে আসেন বেশ কয়েকজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ।

এই আন্দোলনের প্রথম ফসল পাই ১৯৮৪ সালে। যখন মুক্তি পায় মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘আগামী’ । মোরশেদুল ইসলামের বয়স তখন ২৫। চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ। ইতোমধ্যে বিকল্প ধারার ছবি নির্মাণে কাজ করছেন বেশ কিছু মেধাবী তরুণ। এ পর্যন্ত মোরশেদুল ইসলাম তৈরি করেছেন ১৫ টি চলচ্চিত্র। পেয়েছেন দেশ-বিদেশের অনেক সম্মান ও খ্যাতি। নিঃসন্দেহে চাকা, দুখাই, দুরত্ব, খেলাঘর, প্রিয়তমেষু, পুতুল বিয়ে এবং আমার বন্ধু রাশেদ মোরশেদুল ইসলামের নান্দনিক সৃষ্টি।

আমাদের চলচ্চিত্র ভাণ্ডারে এই আন্দোলন যোগ করেছে এক অমূল্য সম্পদ। যে মানুষটির কাছে আমাদের অনেক কিছু পাবার ছিল তিনি হলেন তারেক মাসুদ। অকালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে তাঁর। ‘মুক্তির গান’ ছবির মাধ্যমে তিনি সেলুলয়েডে বেঁচে থাকবেন দীর্ঘদিন। মুক্তিযুদ্ধের জ্বলজ্বলে ইতিহাস সেলুলয়েডে এমন কাব্যিকভাবে কেউ এনেছেন কী না তা আমার জানা নেই। তার ‘মুক্তির কথা’ ছবিটিও অন্যরকম ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। আবার ‘মাটির ময়না’ ছবিটি একেবারেই অন্য ধাঁচের। ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং বাঙ্গালি সংস্কৃতির এমন আলোকিত মিশেল কোন ছবিতে চোখে পড়ে ? মাদ্রাসার ছাত্র হয়েও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ‘রানওয়ে’ ছবি নির্মাণ করে মৃত্যুর আগে তারেক মাসুদ যেন চিরস্থায়ী হয়ে গেলেন সেলুলয়েডে। ক্যামেরার কাজ, শব্দ, আলো, সংলাপ এবং পরিচালনার এমন অপূর্ব মিশেল খুব কম ছবির মধ্যেই দেখা যায়।

১৯৮৭ সালে ‘আবর্তন’ ছবির মাধ্যমে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন আবু সাইয়িদ। তারপর একের পর এক ছবি নির্মাণ করতে থাকেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কীত্তনখোলা (২০০০), শঙ্খনাদ (২০০৪), নিরন্তর (২০০৬) এবং অপেক্ষা (২০১০)। এ পর্যন্ত তিনি শর্ট এবং ফিচার ফিল্ম তৈরি করেছেন মোট ৮টি। পেয়েছেন অসংখ্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার।


বহুমাত্রিক পরিচয়ের প্রবল জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তার পরিচালিত কিছু ছবিতে আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং বাঙ্গালিত্বের গন্ধ পাই। আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, ঘেটুপুত্র কমলা আমাদের চলচ্চিত্রে নিঃসন্দেহে অনন্য সংযোজন।


আমাদের চলচ্চিত্র ঝুড়িতে জমা হয়েছে বেশ কিছু গুণমানসম্পন্ন ছবি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’, ‘লালন’, নাসিরউদ্দীন ইউসুফের ‘ একাত্তরের যীশু,’ গোলাম রাব্বানী বিপ্লবের ‘ স্বপ্নডানায়’, ‘বৃত্তের বাইরে’ এবং অভিনেতা তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’।

একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে ভেঙ্গে দিয়ে একটা বিপ্লব বা পজিটিভ পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। চলচ্চিত্র নির্মাণকে করে তুলেছিল সহজ এবং সবার জন্য উন্মুক্ত। বাংলাদেশে মুক্তভাবে সিনেমা নির্মাণের আবহ তৈরী করেছে এই আন্দোলনই। চলচ্চিত্র নির্মাণে স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই।


একটি সমাজের প্রাণশক্তি তরুণ প্রজন্ম। কারণ এরাই আগামীতে নেতৃত্ব দেবে। সমৃদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকার এই আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে-আমরা তরুণ প্রজন্মকে কোন দিকে ঠেলে দেব ? ইতিহাস বলে-বরাবরই চলচ্চিত্রে তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা। যে কারণে চলচ্চিত্র হয়ে যায় সমাজের মুখপত্র ? কারণ এর মধ্যেই পাওয়া যায় সেই সমাজের দর্শন, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে একটি দেশের ছবিই বলে দেয়, সেই দেশের সমাজ সভ্যতার কোন পর্যায়ে রয়েছে ?

আজ আমাদের দেশে চলচ্চিত্রে যে পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, যে নতুন সিনেমার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তার শুরুটা সেই ‘৮০’র দশকের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। যার পুরোভাগেই ছিল তরুণ নেতৃত্ব। এটাই বাস্তব সত্য। আর সত্যকে অস্বীকার করার কোন উপায় থাকে?

লেখক : সাংবাদিক


(এএস/সেপ্টেম্বর ২৫, ২০১৪)