তামান্না সেতু : সায়েন্সের ছাত্রী হয়েও আমি অল্প কথায় কিছু প্রকাশ করতে পারি না । সবাক পাখি দেখি ২ লাইনে সূত্র লেখার মতো কি সুন্দর মনের সব কথা লিখে ফেলে। আমি লিখতে গেলেই রচনা হয়ে যায় । সেই লেখা যদি হয় শাহবাগের ৩৬৫ দিনের স্মৃতি নিয়ে, তবে বুঝি লিখতে লিখতেই রাত ভোর হয় ।

এক বছর আগের শাহবাগ:

আমাদের আড্ডা দেয়ার কয়েকটা জায়গার মাঝখানের একটা মোড়। প্রায়শই আজিজ মার্কেট থেকে চারুকলা হয়ে টিএসসি বা চারুকলার আড্ডার সময় আমরা শাহবাগের ওপর দিয়ে যাচ্ছি আসছি, তাই শাহবাগ চেনা মুখ- এই হল আমার কাছে এক বছর আগের শাহবাগ ।

এক বছর আগের আমি:

গৃহিণী, দুই সন্তানের মা, স্ত্রী, চাকুরিজীবী। ঘর সংসারের বাইরে অফিস আর তারও বাইরে শপিং, টিভি (বলতে লজ্জা নেই, মাঝে মাঝে স্টার প্লাসের নাটক), সাইক্লোন হলে পুরান কাপড় দেয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিলাপ করা, সংস্কৃতির পতনে দীর্ঘশ্বাস ফেলা! এই হলাম এক বছর আগের আমি।

৩৬৫ দিনের শাহবাগকে আমি ব্যাখ্যা করার আগে মাস দুয়েক আগের একটি ঘটনা বলি।

১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর হুট করে দেশের কয়েকটি স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয় । টিভিতে, ফেসবুকে যশোরের অভয়নগরের মালপাড়ার সংবাদ দেখছি আর ভেতরে ভেতরে ডুকরে কেঁদে উঠছি, অসহায় বোধ করছি, তেতে উঠছি। জানুয়ারির ৭ তারিখ সকাল তখন ১০টা মতন বাজে। ছোট এক ভাইয়ের (গণজাগরণ মঞ্চের) ফোনে সম্বিত এলো।

ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল- আপা তুমি কেমন আছ?

- ভালো না রে।

- কি করবো বল? ঢাকায় বসে আমরা কি করতে পারি?

আমি অবাক হলাম, ও কিভাবে বুঝল যে আমি মালোপাড়ার ঘটনার জন্য মন খারাপ করে আছি কে জানে?

বললাম- আমি যশোর যাবো, তুই লোকজন যোগার কর। যে কয়জন পারি রওনা হয়ে যাই।

- আপা আমিও যাবো।

আমার স্বামী অফিসে, তাকে ফোন দিয়ে বললাম- আমি যশোর যাবো, এভাবে এখানে বসে থাকা যায় না। সে সব শুনে বলল- ঠিক আছে যাও। কি আজব!! বলে দিল যাও!! সেখানে আমি একা যেয়ে কি করবো? কিভাবে করবো তার কিছু সে জানে না। বলে দিল যাও। কারণ তার ভেতরও একি অসহায়ত্ব কাজ করছিল। পরিচিত ৫/৬ জন মঞ্চ কর্মীকে ফোন দিলাম, ওরাও দেখি সব কান্না কান্না গলায় মালোপাড়া যেতে হবে সেই কথাই বলছে। প্রায় ৮/১০ জন যাবো যাবো করছি। আমি ভাবলাম মঞ্চের সিদ্ধান্ত কি এ বিষয়ে, জানা দরকার। বাঁধন কে ফোন দিয়েই বললাম- যশোরে কি হচ্ছে শুনেছ তো? ওরা মার খাবে, আর আমরা বসে থাকব?

ওপাশ থেকে উত্তর এল- আপা আমরা ১০ তারিখ সকালে মঞ্চ থেকে মালোপাড়া রওনা হচ্ছি।

আমি দেখলাম, বুঝলাম, আমি আমরা, একা নই। যা আমি ভাবি, যা আমরা ভাবি, তারা সবাই এখন এক জায়গায়। আমাদের ভাবনা এক, কান্না এক, ভালবাসা এক। আজ আর আমাকে আমার ভাবনাগুলো নিয়ে একা ঘরে বসে থাকতে হয় না, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয় না । শাহবাগ আমার চিন্তাগুলোকে আজ বাস্তবায়িত করার পথ দিয়েছে, পথের অসংখ্য সঙ্গি দিয়েছে।

৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩:

হাজার সয়ে যাওয়া, আপস করায় যখন ভেতরটা ক্ষত বিক্ষত, তখন একটা মাত্র আলোর আশা হয়ে সামনে ঝুলেছিল ’৭১ এর রাজাকার কাদের মোল্লার রায়।

আমাদের কাঙ্ক্ষিত রায়ের সমস্ত আশার বাতি নিভিয়ে তার যাবজ্জীবন দণ্ড প্রদান করা হোল!!! আমি হতবাক, স্তব্ধ। অফিসে বসে ছিলাম- দু গাল বেয়ে অভিমানি জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি জানি না আমার কি করার আছে। ভাবছিলাম- এই তো আমার দেশ! এমনি তো হবার কথা! কেন আমি আশা করলাম যে তার মৃত্যুদণ্ড হবে?

ভাবছিলাম- সামনের বছর সব সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে না হয় ইউরোপের কোন দেশে চলে যাবো সপরিবারে। ভাবছিলাম- হায় রে আমার দেশ মাতৃকা, তোমার বদন মলিন হলে আমার জলে ভাসা ছাড়া আর কিছু যে করার নেই। রাজাকারের গাড়িতে পতাকা লাগবে, এ দেশের বাতাসে সে পতাকা উড়বে. এই তো নিয়তি। কাঁদছিলাম, বিরক্ত হচ্ছিলাম আর সব থেকে বড় সত্য, সে ঘটনার সাথেও একদিন মানিয়ে যাবো সে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

দুপুর ৩:৩০- শুনি কিছু তরুণ ছেলের দল এ রায় প্রত্যাখ্যান করে শাহবাগের মোড়ে যেয়ে বসে পড়েছে। তারা এ রায় মানে না। তারা কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফিরবে না!!! বিশ্বাস কর, আমি অফিসে বসে আবৃত্তি করলাম-

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে

মোর চোখ হাসে, মোর মুখ হাসে

মোর টগবগিয়ে খুন হাসে।

আমি আমার জীবনে প্রথম দেখতে পেলাম আমার সামনে আগাবার পথ, জানলাম শুরু করার সময় এখনো আছে, জানলাম শুরুটা হয়েছে।

এক মুহূর্ত দেরি না করে অফিস থেকে সোজা শাহবাগ। সেই যে গেলাম ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩ থেকে আজ ৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৪।

শাহবাগ আজ আমার কাছে মহাকাশ, মহাসমুদ্র।

তোমরা যারা প্রথম সেখানে বসলে:

আমায় তোমরা বাঁচালে ভাই। আমি বড় একটা নিঃশ্বাস নিতে পারলাম, আমি আমার নিঃশ্বাসে বাচলাম, আমি আমার পালিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচলাম, আমি নারী হেকে মানুষ হলাম, আমি আমার সকল শক্তি দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে চিৎকার করতে পারলাম ।

৩৬৫ দিনে আমি গর্বিত দেশ মায়ের গর্বিত সন্তান হলাম ।

লেখক: বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত।