স্টাফ রিপোর্টার : ফলমূল থেকে শুরু করে লবণ- সবকিছুতেই এখন ভেজাল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা দেশের সর্বাধুনিক খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেশের ৪০ শতাংশ খাদ্যেই ভয়ংকর সব ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রমাণ মিলেছে।

এক প্রতিবেদনে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়, দেশে কিডনি, লিভার ও ক্যান্সার রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে খাদ্যে এসব বিষাক্ত রাসায়নিক বা ভেজালের উপাদান প্রয়োগ। সরকারের উচিত এই গবেষণার আলোকে কালবিলম্ব না করে খাদ্যে বিষ প্রয়োগ বন্ধে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেওয়া। নয়তো এসব বিষাক্ত উপাদান থেকে দেশে মানবদেহে বেশ কিছু দুরারোগ্য রোগের মহামারি পরিস্থিতি দেখা দেবে।

জাতিসংঘের ফাও ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে সম্প্রতি দেশি-বিদেশি একদল গবেষক ৮২টি খাদ্যপণ্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মহাখালী, গুলশান এলাকাসহ আরো বেশ কিছু বড় বড় মার্কেট থেকে এসব খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এতে গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে তিন থেকে ২০ গুণ বেশি বিষাক্ত উপাদান শনাক্ত হয়।

ওই গবেষণার ফল বলছে, ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছে। এছাড়া আম ও মাছের ৬৬টি নমুনায় পাওয়া গেছে ফরমালিন। চালের ১৩টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়াসম্পন্ন আর্সেনিক, পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। হলুদের গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় মিলেছে সিসা ও অন্যান্য ধাতু। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০ থেকে ৫০ গুণ বেশি ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। মুরগির মাংস ও মাছে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এ ছাড়া চারটি প্যাকেটজাত জুসে পাওয়া গেছে বেনজয়িক এসিড।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমাদের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ২০১২ সালে পাঁচ হাজার ৩১২টি খাবারের নমুনা পরীক্ষা করে এর মধ্যে দুই হাজার ৫৫৮টিতে অর্থাৎ ৪৯ শতাংশ খাদ্যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ভেজাল উপাদান পাওয়া গেছে।’

প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহামুদুর রহমানের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ডিডিটি, অ্যালড্রিন, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা- সবই মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে কৃষিজাত খাদ্যে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এখন দেশের জনস্বাস্থ্যকে বিশাল ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। কৃষিপণ্যকে কীটনাশক থেকে রক্ষা করা গেলে মানুষ অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে।

এদিকে মৎস্যসম্পদ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাছে ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে ৬০ শতাংশ চরম বিষাক্ত, ৩০ শতাংশ একটু কম বিষাক্ত এবং মাত্র ১০ শতাংশ বিষাক্ত নয়। আর কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্রায় ২৫ শতাংশই ওই জমিসংলগ্ন জলাশয়ের পানিতে মিশে যায়। এ ছাড়া ওই কীটনাশক প্রয়োগের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি বা উপকরণ পরিষ্কার করতে গিয়ে আরো কিছু কীটনাশক পুকুর বা নালার পানিতে চলে যায়। এতে একদিকে যেমন সরাসরি মাছ ও মাছের ডিমের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, অন্যদিকে পানিতে থাকা ফাইটোপ্লাংকটন (উদ্ভিদকণা)ও জুপ্লাংকটন (প্রাণিকণা) তাৎক্ষণিক মরে যায়। ফলে জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাছের খাদ্য নষ্ট হয়, পানিও নষ্ট হয়। মাছ কমে যাওয়া বা প্রজনন বাধাগ্রস্ত হওয়া কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার এখন প্রধান কারণ বলে ধরা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে প্রতিবছর বৈধভাবেই প্রায় ২৭ হাজার টন কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে। তবে এ পরিমাণ আরো বেশি হতে পারে বলে বেসরকারি পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বিশ্বব্যাংকের ২০০৭ সালের এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি তুলে ধরে ওই সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশেরও বেশি কৃষক ফসলে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, খাদ্য নিরাপত্তায় এখন সরকারের দিক থেকে আরো কঠোর হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে গত বছর খাদ্যে ভেজাল বা বিষ প্রয়োগের অপরাধে ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন ২০১৩’ প্রণীত হয়েছে, তবে এখনো বিধি হয়নি; যদিও ওই আইনের আওতায় খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ করা হয়েছে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায়। তবে ওই উদ্যোগ আরো কার্যকর করা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা

(ওএস/এটি/এপ্রিল ২৬, ২০১৪)