দেবেশ চন্দ্র সান্যাল


২৫ মার্চ’৭১ পাকি হায়েনাদের নৃসংশতম ক্রাকডাউন বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করেছিল। আমি আমাদের আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এ্যাড জনাব মো: আব্দুর রহমান স্যার ও অন্যান্যদের  কাছ থেকে তদানীনন্তন বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর এর ৭ মার্চের পরোক্ষ ও ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরের স্বাধীনতার ঘোষণা মুক্তিযুুদ্ধে অংশ গ্রহণের আহ্বান ও পাকিস্তানি সৈন্যদের জ্বালাও পোড়াও, হত্যা, গণহত্যা, নারী নির্যাতন,ধষর্ণ সহ অন্যান্য মানবতা বিরোধী নৃশংসতার কথা শুনে জাতির জনকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জীবন পণ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই। 

২৩ জুলাই’৭১ শুক্রবার অন্যান্য আরো ২২ জন একত্রে ভারতে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। ভারতে কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্প, কুড়মাইল, মালঞ্চ, প্রতিরাম ও শিলিগুড়ি জেলার পানি ঘাটা নামক হায়ার ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেই। আমার এফ.এফ নং-৪৭৪২ গেজেট নং-১৬৭৯। ৭ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র নিয়ে জনাব এম.এ মান্নান স্যারের গ্রুপাধীন একটি গেরিলা গ্রুপের সাথে দেশের অভ্যন্তরে এসে যে সকল গেরিলা/ সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করে ছিলাম। তাহলো-

বেলকুচি থানা আক্রমণ : ২৪ অক্টোবর কমান্ডার স্যার এবং আরো ৩ জন বেলকুচি থানা রেকি করলেন। সিদ্ধান্ত হলো তাদের দলের ২১ জন থানা এবং অন্য ১৭ জন মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিনের বাড়ি আক্রমণ করবে।
পরিকল্পনা অনুসারে বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ সান্যাল ও রতনসহ ২৭ জন কমান্ডার মো. আব্দুল মান্নান স্যারের কমান্ড অধীন হয়ে থানার পশ্চিম পার্শ্বে আক্রমণ করল। মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিনের বাড়ি আক্রমণে নেতৃত্ব দেবেন তাদের দলের রবীন্দ্র নাথ বাগচী। পরিকল্পনা অনুসারে রাত ৩টায় তারা একযোগে বেলকুচি থানা ও আব্দুল মতিনের বাড়ি অ্যাম্বুশ করে। ক্রলিং করে তাদের দল থানার সম্মুখস্থ সেন্ট্রির সামনে যায়। কমান্ডার স্যার কমান্ড করলেন, তারা গুলি ছুড়ল, গুলি খেয়ে সেন্ট্রি ঢলে পড়ল। ২ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে তারা বিজয়ী হয়ে থানার মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঢুকে দেখে ৩ জন রাজাকারকে গুলি চালিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়ে থানার পুলিশ মিলিশিয়া ও অন্যরা যমুনা নদীতে অবস্থিত স্পিড বোট ও লঞ্চে পালিয়ে গেছে। আমরা ৩ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে এসে ছিলাম। মতিন সাহেবের বাড়িতে আক্রমণ করে মতিন সাহেবকে ধরা যায়নি। তিনি পালিয়ে গেছেন। বিজয়ী হয়ে তারা দুই দল একত্রিত হয়ে বিজয় উল্লাস করে। সকাল আটটা পর্যন্ত বিজয় উল্লাস করে কমান্ডার স্যারের তামাই গ্রামের বাড়িতে শেল্টার নেন। এই যুদ্ধে ১ জন পাকি মিলিশিয়া ও ৩ জন রাজাকার মারা গিয়েছিল।

কালিয়া হরিপুর অপারেশন : ৪ নভেম্বর ১৯৭১ বীর মুক্তিযোদ্ধারা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশনসংলগ্ন ব্রিজ পাহারারত রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন করে। তাদের এই যুদ্ধের গাইডার ছিলেন সিরাজগঞ্জ সদরের এম.এন.এ জনাব মোতাহার হোসেন তালুকদারের ভায়রা ঝাউল গ্রামের মো. আব্দুল হামিদ তালুকদার। রাত নয়টায় সমেশপুর থেকে হাঁটা পথে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নেয় রেললাইনের পূর্বদিকে। ঐ রাতে তাদের পাসওয়ার্ড ছিল জবা ও গোলাপ। সিদ্ধান্ত ছিল যুদ্ধ করতে গিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে সবাই একত্রিত হব তামাই গ্রামের তাদের কমান্ডার স্যার জনাব মো. আব্দুল মান্নানের বাড়িতে। দুঃসাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ সান্যাল ক্রলিং করে রেললাইনে মাইন পুঁতে রেখে এসে তারটি কমান্ডার স্যারের হাতে দেন। রাত নয়টা পঁচিশ মিনিটে একদল আর্মি ও রাজাকার টহল দিতে গেলে তাদের পায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাইনের তার লেগে বিদ্যুৎ সংযোগ অবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাকি হানাদাররা টর্চলাইট মেরে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে আর বারবার বকাবকি করতে থাকে। পাকি আর্মি ও রাজাকারদের সংখ্যাধিক্য থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার স্যার গুলি করতে নিষেধ করলেন। মুক্তিযোদ্ধারা ক্রলিং করে পিছিয়ে এসে নিরাপদ আশ্রয়ে একত্রিত হয়ে কল্যাণপুর চলে আসে। পরদিন সিরাজগঞ্জ সদর থেকে শতাধিক আর্মি এসে কালিয়া হরিপুর স্টেশনসংলগ্ন ৩টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়।

কল্যাণপুর যুদ্ধ : সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলাধীন বেলকুচি সদরের ৭ কি. মি. দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত কল্যাণপুর গ্রাম। ৫ নভেম্বর ’৭১ রাত একটায় কালিয়া হরিপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপটি দুই গ্রুপে বিভক্ত করে কমান্ডার স্যার এক গ্রুপ নিয়ে যমুনা নদীতে থাকা নৌকায় চলে গেলেন। আর ১১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ বাগচীর কমান্ডাধীনে পায়ে হাঁটা পথে রওনা হয়ে ভোর ৫টায় এসে পৌঁছে কল্যাণপুর গ্রামে। তারা এক বাড়িতে অবস্থান নেয়। সকালে রাইফেলে ফুলতুরী মেরে মাঠে প্রকাশ্যে পিটি প্যারেড করে। পিটি প্যারেড শেষ করে তারা পর্যায়ক্রমে সকালের জলখাবার খেতে থাকে। পর্যায়ক্রমে সেন্ট্রি রাখা হয়।

সকাল ১০.৩০ মি. সেন্ট্রি রতন কুমার দাস ও মো. নজরুল ইসলাম এসে বলল পাকি হানাদার আসছে। কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগচীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কল্যাণপুর রাস্তার দক্ষিণ পার্শ্বে বাঁশঝোপের মধ্যে পজিশন নেয়। দুজন মুখ বাঁধা স্বাধীনতাবিরোধী পাকি দালাল পথ দেখিয়ে বওড়া গ্রামের মধ্যে দিয়ে কল্যাণপুর নিয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকি হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকারদের ফলো করে কল্যাণপুর মাদ্রাসার কাছের রাস্তার পার্শ্বে বাঁশঝোপের মধ্যে পজিশন নেয়। পাকি হানাদাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছাকাছি আসতেই কমান্ডারের কমান্ড পেয়ে ফায়ার শুরু করে। পাকি হানাদাররা লাফ দিয়ে রাস্তার উত্তর পার্শ্বে পজিশন নিল। গোলাগুলির সংবাদ পেয়ে কল্যাণপুর বিল এলাকা, ধুলের চর ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য গ্রামে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলো তাদের দিকে মার্চ করল। তারা তাদের অবস্থান থেকে পাশ ওয়ার্ডভিত্তিক গুলি ছুড়ে নিশ্চিত করল। তারা আরো সাহসী হয়ে সম্মুখ যুদ্ধ করতে থাকে। ঘণ্টাব্যাপী সম্মুখ যুদ্ধ চলল। পাকি হানাদাররা কভারিং ফায়ার করতে করতে বওড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কামারপাড়া হয়ে বেলকুচি থানায় গিয়ে আশ্রয় নিল। উক্ত যুদ্ধে একজন রাজাকার ও একজন পাকি হানাদার গুলিবিদ্ধ হয়েছিল।

ধীতপুর যুদ্ধ : সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক গ্রামে সংগঠিত যুদ্ধে আমাদের গ্রুপ অংশগ্রহণ করে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। টাঙ্গাইলের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাকি হানাদাররা নৌকায় পার হয়ে মালিপাড়া এসে পায়ে হেঁটে কৈজুরী ওয়াপদা বাঁধ দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপসহ শাহজাদপুর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সব মুক্তিযোদ্ধা দল একত্রিত হয়ে তাদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটা ছিল ২৫ নভেম্বর ’৭১। মুক্তিযোদ্ধারা কৈজুরী থেকে তাদের পিছু ধাওয়া করে। পাকি হানাদাররা সংখ্যায় ছিল ৩০/৩৫ জন। ধীতপুর নামক স্থানে গিয়ে ওরা পজিশন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি চালানো শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধারাও পজিশন নিল। মুক্তিযোদ্ধা দলের অবস্থান হলো ওয়াপদা বাঁধের পশ্চিম পার্শ্বে। দুই ঘণ্টার মতো সম্মুখ যুদ্ধ হলো। এর মধ্যে সূর্য অস্তমিত হলো। অন্ধকারে গুলি চালালে পাকি হানাদারদের গায়ে না লেগে সাধারণ গ্রামবাসীদের গায়ে লাগতে পারে ভেবে মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মাঝে দুই একটা আকাশমুখী গুলি ছুড়তে থাকে। পাকি হানাদারদের পক্ষ থেকেও দুই-একটা গুলি আসছিল। এভাবে সারা রাত পজিশন অবস্থানে থাকল মুক্তিযোদ্ধারা। ভোর হলে ক্রলিং করে দুঃসাহসিকভাবে ধীতপুর সারের গুদামের কাছে যায়। ওরা ধীতপুরের সার গুদামে অবস্থিত ডিসপেনসারিতে শেল্টার নিয়েছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ সান্যালের হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল তার বাম পাশে কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগচী ও ডান পাশে আমার মেজো দাদা সমরেন্দ্রনাথ সান্যাল , রতন কুমার দাস, মো: নজরুল ইসলাম, মো: শামসুল হক ও প্রভাকর লাহিড়ী সহ ১৭ জন সহযোদ্ধা। তাদের গ্রুপের পেছনে পেছনে আরও পাঁচ-সাতটি গ্রুপের পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। পাকিহানাদার শেল্টারে গিয়ে দেখে দুজন রাজাকার গুলি চালাচ্ছে।

কমান্ডার তাদেরকে সারেন্ডার করার কমান্ড করলেন। তারা উপায় না পেয়ে সারেন্ডার করল। এই রাজাকার দুজনের নাম ছিল লতিফ ও কালাম। ওদের কাছ থেকে জানা যায় ওদেরকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়ে পাকি হানাদাররা রাত ১টার পর বেড়া খেয়াঘাট পার হয়ে বেড়া নগরবাড়ি হয়ে পালিয়ে গেছে। এই যুদ্ধে আমির হোসেনের গ্রুপের বৃশালিখা গ্রামের মো. আব্দুল খালেক শহিদ হয়েছিলেন। দুইজন সাধারণ মানুষ মারা গিয়েছিল। সকল যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা জামিরতা হাই স্কুলে ক্যাম্প করে থাকতে থাকলাম।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, উল্লাপাড়া।