মোহাম্মদ মিজানুর রহমান: ‘ভালোবাসা’  বিষয়টি একটি বিশাল ব্যাপার। তাইতো কোন একজনের ভালোবাসা পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার বৈকি! আসলে ভালোবাসা সম্পূর্ণ অন্তর্জাত একটা বিষয়। এটাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না কিন্তু অনুভব-অনুভুতি দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। এটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারও বটে। অর্থাৎ ভালোবাসা বিষয়টিকে কে, কিভাবে দেখে এখানে সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ  ব্যাপার। আসলে এখানে সত্য-মিথ্যার বিষয়টি অতীব প্রবল। কেননা ভালোবাসি, ভালোবাসি বললেই তো ভালোবাসার প্রকৃত প্রকাশ ঘটে না। এটা আসলেই পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের বিষয় নয় শুধু, এটা দেয়া-নেয়ার বিষয়ও বটে।

এ দেয়া-নেয়ার মধ্যে আবার ‘ত্যাগের’ প্রশ্নটি জোরালোভাবে থাকে। আবার ত্যাগের সাথে মহত্বের বিষয়টিও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। কেননা ৫০ : ৫০ দেয়া-নেয়ার বিষয়টি কেউ যদি মুখ্য করতে চায় তবে সেক্ষেত্রে আর যাই হোক ভালোবাসা জিনিসটা হয় না। এছাড়া শতাংশের নিরিখে যদি ভালবাসা মাপা হয় তাতে ত্যাগের মাধ্যমে মহত্ত্ব প্রকাশের সুযোগটিই আর থাকেনা। তবে এটা ঠিক যে ভালোবাসা বিষয়টি আপেক্ষিক অর্থাৎ আপেক্ষিকতার সুত্রে এটা সদা বাঁধা রয়। এখানে কে, কাকে, কিভাবে পেতে চায়-এ বিষয়টি তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আবার এ চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা খুব জরুরী একটা বিষয় বটে। এ ক্ষেত্রে একপাক্ষিকতার সুযোগ ও স্থান কোনটাই নেই, থাকতে পারেনা। আর তাইতো ‘ভালোবাসা’ বিষয়টি দ্বৈত সত্ত্বার একটি একক রূপের মতো। এখানে পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ ও নির্ভরতাই নিয়ামক। তবে এখানে স্বার্থপরতা নেই তাও কিন্তু ঠিক নয়। স্বার্থই যদি না থাকে তবে তা ইহজাগতিক কোন কাজ নয় নিশ্চয়ই। এ ক্ষেত্রে এটা বলতে পারি যে এখানে স্বার্থ বলতে পারস্পরিক স্বার্থটাই থাকবে অর্থাৎ ভালোবাসার ক্ষেত্রে কিছু কমন ইন্টারেস্ট থাকতে হয় যা অর্জনের মাধ্যমে উভয়ই পরিতৃপ্ত হয়। আসলে ভালোবাসা বিষয়টা ঠুনকো কোন ব্যাপার নয়। সত্যি এটা একটা বিশাল ব্যাপার যার ক্ষেত্র ও বিস্তৃতি অনেক বড়ো। আর এর মহিমা যে শাশ্বত ও চিরন্তন তাতো সবারই বুঝার কথা, যদি তৃতীয় নয়ন কাজ করে, যদি চোখ মুদে উপলব্ধি করা যায়।

ভালোবাসা এমন এক মানবীয় গুণ অ শক্তি বিশেষ যা দিয়ে রীতিমত যুদ্ধ করা যায়। জীবন যুদ্ধের ক্ষেত্রটি আসলেই বিশাল। তাই ভালোবাসার বিষয়টিও বুহুমাত্রিক অ বহুপ্রকারের। ভালোবাসা কখনো প্রকাশ্য কখনো লুকানো থাকে। দৃশ্যমান- অদৃশ্যমান সব ভালোবাসার মধ্যেই রয়েছে নানান প্রকারভেদ। তবে কোন সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে ভালোবাসাকে নিয়ে আসা একটা কঠিন কাজ বৈকি! তারপরও অগ্রাধিকার বিবেচনায় আমরা কয়েক প্রকার ভালোবাসার কথা বলতে পারি। যেমন- পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসা, ভাইবোনের ভালোবাসা, স্বামীস্ত্রীর ভালোবাসা, প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা, বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ইত্যাদি। এ ছাড়া আল্লাহ-রাসুল, অলি-আউলিয়া আর গুরুশিষ্য সাধু সন্যাসির পারস্পরিক আত্মিক টান বা আকর্ষণও ভালোবাসার প্রকরণের মধ্যে পড়ে।আর দেশের প্রতি, মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা তো অনেক অনেক বেশি মহিমান্বিত একটা ব্যাপার।

আজকাল অনেকে ভালোবাসা শব্দটি শুনলে পরে নাক সিটকান, নানান মন্তব্য করেন, ভ্রু কুঁচকান। তারা এটা করেন কারণ ভালোবাসা শব্দটির মধ্যে উনারা ভালগারের গন্ধ খুঁজে পান। বিষয়টা আসলে সে রকম নয় কিছুতেই। ভালগার মানে কদর্যতা, যা মুলত দৈহিক/ জৈবিক আসক্তিজনিত একটা ব্যাপার।এটা কখনো ভালোবাসা হতে পারেনা। আবেগ নির্ভর কোন পদক্ষেপ, প্রচেষ্টা কিংবা অভিব্যক্তির প্রকাশই ভালোবাসা নয়। এটা স্রেফ ক্ষুদ্র ও সাময়িক স্বার্থ নির্ভর শারীরিক প্রণোদনা বিশেষ। শতাংশের বিচারে এটা সমাজস্থিত মানুষের মধ্যে ৫%-১০% এর বেশী দেখা যাবেনা। তাই ‘ভালগার’ প্রসঙ্গটি ভালোবাসা বিষয়ক আলচনায় এনে ভালোবাসার প্রকৃত সৌরভ ও পবিত্রতা নষ্ট করার কোন মানে হয়না। মোটকথা ভালোবাসার প্রসঙ্গটি শুধু ভালোবাসা দিয়েই বিবেচনা করতে হবে। এটা সত্য যে মানুষের সত্ত্বার মধ্যে মানবীয় গুণ যেমন আছে, তেমনি দানবীয় দোষও আছে। পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ এ দুটি বিষয়কে প্রস্ফুটিত ও নিয়ন্ত্রন করার মধ্য দিয়েই কিন্তু যুগে যুগে মানব সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে নীতি- নৈতিকতা ভিত্তিক এক ধরণের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই যে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, সভ্যতার বিকাশ ঘটানো- সব কিছুর মুলে রয়েছে এক ধরণের দায়বোধ যেখান থেকে দায়বদ্ধতার সূত্রটি গ্রথিত করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে এই দায়বোধ আসে ভালোবাসার স্বর্গীয় আবহ থেকে। এটা ঠিক যে মানুষ প্রথমত নিজেকে তথা নিজের জীবনকে ভালোবাসে। এটাও ঠিক যে – যে মানুষ নিজেকে তথা নিজের জীবনকে ভালবাসতে পারেনা সে কখনো অন্যকে বা অন্য কিছুকে ভালবাসতে পারেনা। এই পৃথিবীতে মানুষে মানুষে ভালোবাসা যদি না থাকতো তবে দানবীয় মূর্ততায় পৃথিবীটা ভরে যেতো, মানুষের জন্য এই পৃথিবীটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেতো। তখন আর এই পৃথিবীটারে এতোটা সুন্দর মনে হতোনা। কবিও বলতেন না ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।‘ ব্যতিক্রম বাদে এই পৃথিবীর সব মানুষই ভালোবাসা পেতে চায়, ভালোবাসা পেয়ে, ভালোবাসা দিয়ে ও নিয়ে সুখী হতে চায়। ভালোবাসার রূপ, রস, গন্ধ পিয়ে মানুষ পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সার্থক, অর্থবহ ও সৌন্দর্য মণ্ডিত করে তোলে। ভালোবাসার মাধুর্য তাই শাশ্বত ও চিরন্তন। মানবীয় যতোসব সদ্গুন রয়েছে তার সবকটি ভালোবাসার সুত্র থেকে উৎসারিত। সত্যি কথা হল, আপনার অন্তরে যদি ভালবাসা নাই-ই থাকতো তবে আপনি আপন- স্বজন, প্রিয়জন কারো প্রতি কোন দায়িত্ব ও কর্তব্য করতে পারতেন না। আপনি এসব করেন ভালোবাসার টানে। এইজন্যই ভালোবাসা এতোটা ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর থাকে। এই যে মানুষ কায়ক্লেশে সংসারের ঘানি টানে, স্ত্রী-পুত্র- পরিজনকে সুখী করতে নিরন্তর ছুটে চলেছে মানুষ তা কি মানুষ শুধু নিজের জন্যই করে? নিশ্চয়ই না। এই যে মানুষ দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে, বিলিয়ে দেয় নিজেকে তার পিছনে কোন স্বার্থটা কাজ করে? চোখ মুদে অনুভব করলে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে আশাকরি। আসলে সব কিছুর উৎস মূলে আছে ভালোবাসা। তাই, আবারো বলি; আপনি উত্তম সন্তান, উত্তম পিতা বা মাতা, উত্তম ভগ্নি-ভ্রাতা, উত্তম বন্ধু, উত্তম অভিভাবক, উত্তম শুভানুধ্যায়ী, উত্তম প্রতিবেশী, উত্তম কর্মকর্তা ও উত্তম দেশপ্রেমিক কখনই হতে পারবেন না যদিনা আপনার বুকে ভালোবাসা সঞ্চারিত থাকে। তাই ভালোবাসার সূত্রটি সার্বজনীন, হউক না তা অগাণিতিক। এটা আপনার, আমার, সবার জীবনে সত্য।

ভালোবাসাকে যদি মানব জীবনের মৌলিক অনুসঙ্গ বলা হয় বোধ করি তাতে কোন ভুল হবেনা। মোট কথা ভালোবাসা স্বর্গীয় সুধা সম এমন এক বন্ধন সুত্রতা যা কিনা মানুষকে একাত্ম হতে, একত্রিত ও একাকার হতে, সর্বোপরি জীবনকে অর্থবহ ও মাধুর্যময় তুলতে, মানুষকে পূর্নাঙ্গ মানুষ হিসাবে বিকশিত হতে সাহায্য করে। এ জন্যই ভালোবাসার জন্য জীবন নাকি জীবনের জন্য ভালোবাসা- এমন প্রশ্ন জোরালোভাবে বিদ্যমান আছে। প্রশ্নটির একক উত্তরও পাওয়া যায়না। কেননা ভালোবাসা জিনিসটা এমনই জীবন ঘনিষ্ঠ যে জীবনের নানান পর্যায়, ধাপ ও স্তরে ভালোবাসার দ্যোতনা ভিন্ন মাত্রায় মানুষের মন মন্দিরে সঞ্চারিত হতে পারে। এতে কিন্তু ভালোবাসার মাহাত্ম একটুও কমেনা বরং তা ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা দেয়। সুতরাং ভালোবাসা নামের শব্দটিকে, বিষয়টিকে আপনি ছেড়ে- ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবেন না কখনো, কিছুতেই। প্রতিটি ক্ষণ- অনুক্ষণে এটা আপনার সঙ্গের সঙ্গী। এই যে স্নেহ, মায়া-মমতা, আদর- সোহাগ, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদি যেসব বিষয়গুলো মানবিকতা, নীতি- নৈতিকতা, ও মুল্যবোধের সহিত জড়িত তার কোন কাজটা হয় বা হবে ভালোবাসা বিহনে? আসলে ভালোবাসাকে এড়িয়ে যাবার কি কোন সুযোগ আদৌ আছে? না, নেই। এটাকে এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই এ কারণেই যে মানব জীবনের সব কিছুতেই ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। তাইতো ভালোবাসারা মানুষের কাছে জড়িয়ে জড়িয়ে আসে, গড়িয়ে গড়িয়ে আসে। জীবন সংসার নামক দু’দিনের এই খেলাঘরে মানুষ কোন জিনিসটা পাবার জন্য বেশি উদগ্রিব থাকে? ভালোবাসার জন্য নয় কি? তাই যদি হয় তবে ভালোবাসাকে জীবনের সবচেয়ে বড় একক অনুসঙ্গ তো বটেই ভিত্তি বললেও ভুল হবে কি? বোধ করি ভুল হবেনা। আর একটা কথা। নানান সম্পর্কে গড়া মানব জীবনের ক্ষেত্র ভুমিতে বিভিন্ন ধরণের সম্পর্কগুলোকে পাশাপাশি এনে বিবেচনা করলে ভালোবাসার সম্পর্কগুলো কি পারস্পরিক সাংঘরসিক বলে মনে হয়? নিশ্চয়ই নয়। আসলে এক একটা সম্পর্ক আলাদা, মাত্রাও আলাদা। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সম্পর্কগুলো বরং পরস্পরের পরিপুরক। এখানে শুধু দরকার একটু ধৈর্য, একটু সহিষ্ণুতা, একটু উদার দৃষ্টিভঙ্গি। মায়ের জায়গায় মা, স্ত্রীর জায়গায় স্ত্রী অর্থাৎ যার যার অবস্থানে তাকে রেখে যদি সম্পর্কগুলোকে বিন্যস্ত করা হয় তবে সমস্যা হবার কথা নয়, নিশ্চয়ই। যদি আমরা আমাদের অনুভব-অনুভুতির পরতে পরতে ছড়িয়ে দিতে পারি ভালোবাসার সৌন্দর্য, মাধুর্য আর রূপ- সুষমা তবে ভালোবাসার মাহাত্ম আমরা ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারবো। ভালোবাসা জিনিসটাকে আমরা যদি শুভ্র-শুচিতায় ভরে দিতে পারি তবে এর সৌরভ ছড়িয়ে যাবে বহুদূর যেটাকে আমরা শক্তি হিসাবে অনায়াসেই ব্যবহার করতে পারি যা কিনা কল্যণকামিতার ধারাটিকেও করবে অধিকতর সমৃদ্ধও, মজবুত, দৃঢ় এবং শক্তিশালী। সত্যি কথা কি, ভালোবাসার শক্তি অফুরান-অফুরন্ত। ভালোবাসার শক্তির চেয়ে এমন কোন বড় শক্তি নেই যা নিখরচায় মানুষের মনকে জয় করতে পারে। সুতরাং মানুষের মন জয় করার জন্য ভালোবাসা একটা মোক্ষম অস্ত্রও বটে। সবচেয়ে বড় কথা ভালোবাসা বিলাতে কোন অর্থ লাগেনা। এটা শুভ্র-শুচিতায় আকীর্ণ এমন এক মানবীয় গুণ বিশেষ যেখানে কদর্যতার কোন স্থান নেই, জৈবিক তাড়নার কোন কোন বিষয় নেই; ভালগারের কোন আশ্রয় নেই। এই জন্যই বলা হয় ‘সাধু তুমি ভালবাসা’। এই জন্যই যুগে যুগে, কালে কালে ভালোবাসার জয়গান গেয়েছেন কবি সাহিত্যিকরা, কল্যাণকামী মানুষেরা, সাধক মানুষেরা।

পরিশেষে শুধু এই কথাটিই বলবো যে সব মানুষই ভালোবাসার কাঙ্গাল, সব মানুষই ভালোবাসা পেতে চায়, ভালোবেসে সুখী হতে চায়। এই জন্যই মানুষ ভালোবাসার জন্য জীবনপাত করে। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে ভালোবাসাহীন জীবন কোন জীবনই নয়। তাই ভালোবাসার মহত্তম দিকটি সবার কাছে, সবার জীবনে ফুটিয়ে তোলা দরকার। কেননা জীবন সংসারে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইলে সকলকে ভালোবাসার দীক্ষাটা আগে নিতে হবে বৈকি!