দেওয়ান পারভেজ : ভালোবাসা দিবসে ভারতজুড়ে মুক্তি পেয়েছে প্রিয়াঙ্কা-রনবীর সিং জুটি অভিনীত বহুল আলোচিত ‘গুণ্ডে’ ছবিটি। যদিও ছবিটি মুক্তি দেয়ার আগেই মন্দির প্রাঙ্গণে অশ্লীল দৃশ্য ধারণ এবং তা ছবিটিতে প্রদর্শনের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগ ওঠে পরিচালক আলি আব্বাস জাফর এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান যশরাজ ফিল্মসের বিরুদ্ধে।

পাশাপাশি প্রথমবারের মতো বলিউডের কোনো ছবি বাংলায় ডাবিং করে পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি দেয়ার কারণে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের প্রতিরোধের মুখেও পড়ে। তবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের রাজনীতিতে পাকা খেলোয়ার বলে পরিচিত যশ রাজ ফিল্মস দুটো প্রতিবন্ধকতা থেকে খুব ভালোভাবেই পার পেয়ে যায়। ফলস্বরূপ গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় প্রেক্ষাগৃহগুলোতে মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের এর পটভূমিতে নির্মিত ‘গুণ্ডে’ ছবিটি।

কিন্তু ছবিটি মুক্তির পরপরই শুরু হয় নতুন বিতর্ক। তাও আবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। ছবিটির পাইরেটেড কপি এখন ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রপ্রেমীরাও ছবিটি দেখতে শুরু করেছে। আর এখানে অভিযোগ উঠেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির। ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছবিটির এই ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে।

ফেসবুক ব্যবহারকারী সিডাটিভ হিপনোটিক্স লিখেছেন, ‘নোবডি পয়েন্টস দ্য ফিঙ্গার অ্যাট আওয়ার লিবারেশন ওয়ার। কেউ ম্যানিপুলেশন করতে পারে না আমাদের ইতিহাস। কড়া প্রতিবাদ চাই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। নয় মাস পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পর বলিউড যখন প্রচার করবে এটা ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ, আমার মনে হয় না আর মিন মিন করার কোন উপায় আছে। ইতিহাস বর্গা দেই নাই, যে যার খুশি মতো, তা বদলাবে।’

তিনি আরো লিখেছেন, ‘ব্যক্তি পর্যায় থেকে প্রতিবাদ করলাম এই ইতিহাস ধর্ষণের। আমরা হতে পারি খুব ছোট্ট একটা দেশ, কিন্তু আমাদের অহম তোমাদের ভূমির আয়তনের থেকেও বড়।’

সাংবাদিক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব অঞ্জন রায় লিখেছেন, ভারতীয় গুণ্ডে চলচ্চিত্রটি আমি দেখিনি। লোকমুখে এটির কাহিনীর কিছু অংশ শুনেই হতবাক হয়ে গেছি। যারা এটি দেখেছেন তাদের কাছে থেকে জানলাম, এখানে বলা হয়েছে- ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধে ভারত জয়ী হয়। ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে! ভারত এই যুদ্ধে জয়ী হয় এবং ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়!

এটুকু শুনেই আমি হতবাক। এই ইস্যুতে আপোষ করতে জানি না, করবো না কোনদিন। আর সেই কারণেই এই বিষয়ে দাবি করছি সরকারি শক্ত বক্তব্য। এই ইস্যুতে দেখতে চাই তাদেরই প্রতিবাদ, যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। আশা করি, কোনো দলীয় সীমারেখার মধ্যে নয়, সবাই সোচ্চার হবেন। একই সাথে যারা এই ইস্যুটিকেও ক্যাশ করে চেষ্টা করবেন ভারত বিরোধী রাজনীতির ধুয়া তুলে পানি ঘোলা করার, তাদের প্রতিও নজর রাখতে হবে। কারণ দেশের প্রতি অসম্মানের প্রতিবাদে আমরা সোচ্চার হতে দ্বিধান্বিত নই, কিন্তু আমরা তাদেরও চিনি যারা এই ইস্যুগুলোকে নিয়ে নষ্ট খেলা খেলেন- যারা আমাদের আবেগের পিঠে সওয়ার হয়ে নিজেদের আখের গোছান।

ওয়ারিশ আজাদ নাফি লিখেছেন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা মিথ্যাচার দিয়ে শুরু হয় মুভিটা, সোজা কথা বাংলাদেশ হচ্ছে ইন্ডিয়ার সৃষ্টি। বাংলাদেশের জন্ম নিয়ে এই জঘন্য মিথ্যাচার ওদের সেন্সরবোর্ড আটকে দেয়নি। তার মানে ভারতীয় সরকারের এতে কোন প্রবলেম নেই। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে এমন অপমান আর কেউ করেনি।

আরেকটা প্রশ্ন- ভারতীয় সরকারের অনুমতিতে মুভিটি প্রদর্শিত হচ্ছে, তাহলে বাংলাদেশ সরকার কি আনুষ্ঠানিকভাবে এর ব্যাখ্যা চাইবে না? সরকারের কাছ থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ চাই। মুভির ওই সিকোয়েন্সটি বাদ দেয়ার দাবি জানানো হোক। এর জন্যে দরকার হলে একলা ব্যানার নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়াব। মানুষে পাগল বলে বলুক।

আদনান সাদেক লিখেছেন, তারা কি মনে করে সেটার চেয়ে আমাদের দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে কতটুকু সন্মান করে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। এখনও রাজাকারদের রক্ষার জন্য বা ক্ষমতায় থাকার জন্য আমরা পাকিস্তান বা ভারতের পা চাটি। আমাদের আগে নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হতে হবে, সেটা হলে অন্যরা ঠিক ইতিহাসের যোগ্য সন্মান দিতে শিখবে।

আসিফুজ্জামান পৃথিল তার ফেসবুকে লিখেছেন, গুণ্ডে নিয়ে সবার আলোচনা দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ছবিটা না দেখে কোন মন্তব্য করবো না। তাই রাতেই যশ রাজ ফিল্মসের নতুন মুভিটা দেখলাম। প্রথমেই বলি, ইতিহাস বিকৃতি ধারাবাহিকভাবেই হচ্ছে। এটা তারই ধারাবাহিকতায় তৈরি ছবি। প্রথমেই বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নাকি ভারত-পাকিস্তান তৃতীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারত জিতলে নাকি জন্ম হয় বাংলাদেশের!

সবার এই জায়গাতেই আপত্তি! কিন্তু পুরোটা দেখলে বুঝবেন আমাদের কি সূক্ষ্মভাবেই না অপমান করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ অস্ত্র চোরাচালানসহ নানামুখী অপরাধে মেতে উঠেছিল!

এই দেশের মানুষ কয়লা চোর! শেষ অবধি এই দেশের মানুষ নিজেদের ভারতীয় মনে করে এবং নাগরিকত্ব পেতে সবকিছুই করতে পারে। এর প্রতিবাদ চাই। তীব্র প্রতিবাদ।

আমিনুল ইসলাম শাওন লিখেছেন, যশ রাজ ফিল্মস নাকি চেয়েছিল ‘গুণ্ডে’ মুভিটা বাংলাদেশের হলগুলোতে মুক্তি দিতে। সেজন্য মুভিটা বাংলায় ডাবিংও করা হয়েছে। আর এমনটা যদি হতো তাহলে বাংলাদেশের যে হল ঐ ছবি প্রদর্শন করবে ঐ হলে আগুন দিতাম আমি সবার আগে।

জানি আমার মতো সামান্য ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রতিবাদে হয়তো তেমন কিছুই হবে না, তবুও বলছি আমি এই ভুলের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। পরিশেষে যারা হিন্দি ও ইন্ডিয়ান চলচ্চিত্র দেখে লাফালাফি করেন তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে বলছি, প্লিজ ভারত চলে যান তারাই আপনাদের মাতা-পিতা।

সৌজন্যে - বাংলা মেইল।