স্টাফ রিপোর্টার : গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৩ অনুযায়ী, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকে সপ্তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে ছিল অষ্টম। মন্ত্রী, স্পিকার, এমপি, মেয়র, রাষ্ট্রদূত, বিচারপতি, উপাচার্য ছাড়াও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি এখন লক্ষ্যনীয়।

এছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতি, রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীর অবদান ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। পাশাপাশি সামরিক বাহিনী, পুলিশ, আইটি বিশেষজ্ঞ, ড্রাইভিংসহ বিভিন্ন অপ্রচলিত ও টেকনিক্যাল পেশায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।

সোমবার সকাল ১০টায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয় আয়োজকদের পক্ষ থেকে। দাতা সংস্থা সুইস ডেভেলপমেন্ট ফর কো-অপারেশনের (এসডিসি) সহায়তায় ‘অপরাজিতা’ প্রকল্পের আওতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন স্টেপস্ স্টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের উদ্যোগে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

সেমিনারে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সুপারিশ তুলে ধরে বলা হয়, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জেন্ডার সংবেদনশীল ও জনগণের কাছে আরও দায়বদ্ধ করে তুলতে হবে। নারী নেতৃত্ব বিকাশে রাজনৈতিক দলগুলোর আরও বেশি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা ও বাজেট আরও বেশি নারীবান্ধব করার পাশাপাশি নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা কমানোর জন্য বিশেষ কর্মসূচি ও বরাদ্দ রাখতে হবে।

নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনে প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি মিডিয়া ও শিক্ষাব্যবস্থা কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেওয়ারও সুপারিশ তুলে ধরা হয় সেমিনারে।

পিপ ট্রাস্টের আরমা দত্তের সভাপতিত্বে সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন খান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট রোকসানা খন্দকার। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্টেপস্ স্টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন কর্মকার। সবশেষে বক্তব্য রাখেন ডেমোক্রেসি ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক তালেয়া রহমান।

সেমিনারে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নূহ-উল আলম লেনিন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের কার্যকরী সভাপতি মাঈনুদ্দিন খান বাদল এমপি, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, গণসাস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা জাহান লিটা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আহসান হাবিব লাবলু, জেন্ডার অ্যালায়েন্স ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মহসীন আলী, দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মনিরুজ্জামান ও মহিলা পরিষদের নেতা নারীনেত্রী মালেকা বানু।

সেমিনারের শুরুতেই স্টেপস্ নির্মিত ‘রাজনৈতিক নারী’ শীর্ষক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

নারী ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা
সেমিনারে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলির সভাপতি নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, আমাদের সংবিধান, নারী নীতিতে নারীর যে অধিকার দেওয়া আছে তা জেনে অধিকারের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। না জানাটা আমাদের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। নারী নীতি প্রনয়ণ একই সঙ্গে আদর্শিক ও একটি আইনি লড়াই। জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো সরকারের শিল্পনীতি, কৃষিনীতির বিরোধিতা না করলেও নারী নীতি, শিক্ষা নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারা বিরোধিতা করছে। আর রাজনৈতিক আন্দোলন করতে গিয়ে একজন ধর্মীয় নেতা তেতুল তত্ত্ব দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন।

আমি এ বিলের বিরোধিতা করবো
১৬ বছরে বিয়ের বিষয়ে সরকারের প্রস্তাবিত বিল পাস হবে না মন্তব্য করে জাসদের কার্যনির্বাহী সদস্য মাঈনুদ্দিন খান বাদল এমপি বলেন, এই বিল সংসদে উঠলে আমি এর বিরোধিতা করবো। অর্থনৈতিক সক্ষমতা নারীকে স্বাধীনচেতা করে তুলছে। তাই সবার আগে অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব অর্জনের জন্য নারীকে লড়াই করতে হয়।

নারীর অধিকার সংরক্ষিত করা হয় কেন?
সেমিনারে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এদেশে নারীর ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা প্রমাণিত। সুফিয়া কামাল, রোকেয়া বেগম, প্রীতিলতা ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেটা প্রমাণিত। চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে ক্ষমতায়নের। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারী। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো একজন নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারেনি। সেদিক থেকে আমরা অনেক এগিয়ে।

তৃনমূল থেকে নারী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের দু’টি দিক হলো, অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব। অংশগ্রহণে নরীরা কিছুটা এগোলেও অংশীদারিত্বের বিষয়টিতে এখনো আমরা পিছিয়ে রয়েছি। গ্রাম-গঞ্জে ১৮ বছরে মেয়ের বিয়ের বিষয়টি মেনে নিয়েছে। তাহলে কেন সেটা কমিয়ে ১৬ বছর করা হবে? নীতি-নির্ধারকরা কি বিষয়টা বুঝছেন না?

রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে
সিপিবির সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য আহসান হাবিব লাবলু বলেন, সুইচ টিপলেই নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে না। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে।

অর্থনেতিক মুক্তি ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়
সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা জাহান লিটা বলেন, অর্থনেতিক মুক্তি ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। ক্ষমতায়নের চ্যালেঞ্জটা নারীকেই নিতে হবে। ধর্মীয়, সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়তে হলে একজন নারীকে প্রথমে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হতে হবে।

নারী অধিকার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো নীতি মেনে চলছে না
জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যালায়েন্সের সদস্য মহসীন আলী বলেন, সংবিধানে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হলেও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তা মেনে চলছে না। নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়নের প্রশ্নে দলগুলো সবসময়ই রক্ষণশীল ভূমিকা পালন করছে।

সভাপতির বক্তব্যে আরমা দত্ত বলেন, স্থানীয় সরকার বিষয়ে সরকারের যে নীতি আছে তার পরিবর্তন জরুরি। অর্থনৈতিক মুক্তি না এলে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারবো না। এর জন্য তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে। তবে সরকারের নীতি সাংঘর্ষিক হলে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সংগ্রামে আমরা পিছিয়ে পড়বো।

সেমিনারে সব পর্যায়ে জেন্ডার বৈষম্যে অসমতা দ‍ূর করা, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ত্বরান্বিত করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতাযন অংশগ্রহণ এ ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে দেশের চারটি বেসরকারি সংস্থা ডেমোক্রেসি ওয়াচ, খান ফাইন্ডেশন, পিপ ট্রাস্ট ও স্টেপস্ স্টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট ২০১১ সাল থেকে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ‘অপরাজিতা’ কর্মসূচি পারিচালনা করে আসছে। দাতা সংস্থা সুইস ডেভেলপমেন্ট ফর কো-অপারেশন (এসডিসি) এর সহায়তায় পরিচালিত এ প্রকল্পের আওতায় দেশের মোট ৪০টি জেলার ৫৬টি উপজেলা, ৪৪টি পৌরসভা ও ৫২১টি ইউনিয়নসহ ৬২৮টি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ চলছে।

সেমিনারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নারী জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ইসরাত জাহান সোনালী, বগুড়ার শেরপুর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বেগম সালমা ইসলাম শিফা, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার, মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নার্গিস সুলতানা, গাইবান্ধার ভারতখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শামসুল আজম শীতল, নরসিংদীর সাল্লাবাদ ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য শাহিদা আক্তার, মেলান্দহ ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য আনোয়ারা বেগম ও কোটালিপাড়া আমতলী ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য স্বপ্না আক্তার মিনি প্রমুখ।

(ওএস/এএস/সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪)