স্টাফ রিপোর্টার, সালথা : মুজিববর্ষ উপলক্ষে ফরিদপুরের সালথায় ভূমিহীনদের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহার সরকারী ঘর পেয়ে খুশি অনেকেই। সেই সরকারি ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ও জব্দ করা গাছের কাঠ ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠেছে। পচা ইট, খোয়া, নিম্নমানের রড, সিমেন্ট ও বালু দিয়ে চলছে ঘর নির্মাণের কাজ। ঘরের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রশাসনের জব্দ করা সরকারি গাছের নিম্নমানের কাঠ। আবার অনেক স্থানে ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। যা বসবাসে অযোগ্য।

বিনা পারিশ্রমিকে উপকারভোগীদের দিয়ে ঘরের ফ্লোর ভরাটসহ লেবারের কাজ করানো হচ্ছে। এমনকি সরকারি কর্মচারীদের ঘরের কাজে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করছেন। যেকারণে তারা ঠিকমত অফিসের কাজ করতে পারছেন না। সাধারন অসহায় মানুষের নিজস্ব টাকায় মাটি ভরাটকৃত দখল করা খাস জায়গা উদ্ধারে হিংসাত্মক উদ্যোগ ও চরম স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ রয়েছে। খাস জমি খালি করার নামে শতশত বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে বিক্রি করা হয়েছে।

গৃহ নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা: তাছলিমা আক্তার তার স্বামী মো. শাহেদ চৌধুরীকে অঘোষিতভাবে ঠিকাদার নিয়োগ করে এসব ঘর নির্মাণে যা খুশি তাই করে রীতিমত নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। নিয়মনীতি আর শৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করেই একের পর এক ঘর তৈরী করে গেলেও যেন দেখার কেউ নেই। এতে ইতিমধ্যে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে উপকারভোগীসহ সাধারন মানুষ। ঘর নির্মাণ নিয়ে ইউএনওর এমন কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রতিবাদ জানিয়ে স্টাটাসও দিয়েছেন অনেকে।

জানা গেছে- সালথায় তৃতীয় ধাপে মোট ২৩৩টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে মাঝারদিয়া ৯৩টি, গট্টি ৪৭টি, ভাওয়াল ৩২টি, যদুনন্দী ২৮টি, সোনাপুর ২১টি, রামকান্তুপুর ৮টি ও আটঘর ইউনিয়নে ৪টি ঘর রবাদ্দ দেওয়া হয়। প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫শ’ টাকা বরাদ্দ রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৩৫ টি ঘরের কাজ শেষ করে উপকারভোগীদের কাছে হস্তান্তারও করা হয়েছে। হস্তান্তরকৃত এসব গৃহ নির্মাণেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ।

জানা যায়- চলমান গৃহ নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আর সেক্রেটারী করা হয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে। সদস্য করা হয়েছে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও উপজেলা প্রকৌশলীসহ উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের। অভিযোগ রয়েছে এসব সরকারি কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যানদের নাম মাত্র গৃহ নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটিতে রাখা হয়েছে। ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের কোন পরামর্শও নেয়া হচ্ছে না। ইউএনও তার স্বামীকে দিয়ে সব কাজ করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গৃহ নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটির কয়েকজন সদস্য অভিযোগ করে জানান- ইউএনও সালথায় যোগদানের পর থেকেই তার স্বামী মো. শাহেদ চৌধুরীকে নিয়ে আসেন। শাহেদ বেকার হওয়ায় তাকে ঘর নিমার্ণের সকল দায়িত্ব দিয়ে কাজে লাগিয়ে দেন ইউএনও। এরপর ইউএনওর গাড়ি নিয়ে শাহেদ নিয়মিত ঘরের কাজ দেখাশোনা শুরু করেন। একপর্যায় স্বামীর পরামর্শে ঘর নির্মাণে শুরু করেন নানা অনিয়ম।

বেশিরভাগ ঘরেই নিম্নমানের ইট, খোয়া, বালু, রড, সিমেন্ট ও কাঠ দিয়ে কাজ শুরু করেন। ঘর নির্মাণে এতটাই নিম্নমানের সামগ্রী আনা হয় যা কাজ বন্ধ করে দিয়ে মাঝে মাঝে মালামাল ফেরত দেওয়া হয়। এক গাড়ি ভাল ইট-খোয়া আনলে, তিন গাড়ি খারাপ ইট-খোয়া এনে কাজ করছে। যেসব ঘর সড়কের পাশে বা সদরে সেসব ঘরে ভাল মানের ইট ব্যবহার করলেও গ্রামের ভিতরের ঘরগুলোতে বেশিরভাগ পচা ইট-খোয়া ব্যবহার করছে।

তারা জানান- সাবেক ইউএনওর জব্দকৃত বন’বিভাগের যেসব গাছ উপজেলা চত্বরে রাখা ছিল। সেই সব গাছগুলো বন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়াই ঘরের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়াও কাগদী এলাকার রাস্তার পাশে থাকা বেশ কিছু মেহেগুনি গাছ ও তুগুলদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি বড় মেহেগুনি গাছ কেটে ঘরের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্নস্থানে পরিকল্পনা ছাড়া ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। হাটা-চলা করার মত জায়গা ছাড়া ঘরের আশপাশে কোন জায়গা খালি রাখা হয়নি। যেখানে শাক-সবজি চাষ করে উপকাভোগীরা খাবে, সেই জায়গা পর্যন্ত রাখা হয়নি। ফলে এসব ঘরে বসবাস করতে অনেকেই অনীহা প্রকাশ করেছেন।

তারা আরও জানান- বিনা পয়সায় উপকারভোগীদের দিয়ে ঘরের ফ্লোর ভরাটসহ লেবারের কাজ করানো হয়। নাটর ও পাবনা থেকে শ্রমিক ও মিস্ত্রি এনে ঘরের কাজ করছেন। এতে এই এলাকার শ্রমিক ও মিস্ত্রিদের হক নষ্ট হচ্ছে। এমনকি উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারী দিয়ে শ্রমিকের কাজ করছেন। তাদের দিয়ে নির্মাণাধীন ঘরের ওয়ালে পানি পর্যন্ত দেয়ানো হচ্ছে। ফলে তারা অফিসের কাজ ঠিকমত করতে পারছেন না। আর এসবই করছেন ঘরের কাজ থেকে টাকা বাঁচাতে। ঘর নির্মাণকারীর টার্গেট প্রতিটি ঘরে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বাঁচিয়ে কোটি টাকা বাণিজ্য করার।

গৃহ নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটির সেক্রেটারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা পরিতোষ বাড়ৈ গণমাধ্যমকে বলেন- উপজেলার জয়ঝাপ এলাকায় গৃহ নির্মাণ কাজে কিছু নিম্নমানের সামগ্রী আনা হয়েছিল। উপকারভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সেগুলো ফেরত পাঠানো হয়। এ ছাড়া আর কোনো অনিয়মের বিষয় আমি অবগত নই।

গৃহ বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য উপজেলা প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম বলেন- গৃহ নির্মাণ কাজে আমাদের সেইভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি, এটা আপনারা জানেন। আমি একদিন ইউএনও ও পিআইওর সাথে জয়ঝাপ গিয়েছিলাম। সেখানে নিম্নমানের খোয়া পাওয়া গেলে তা ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। গৃহ নির্মাণ কাজে বিভিন্নস্থানে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে কি না- এটা আমার চেয়ে আপনারা ভাল জানেন। আমি এ বিষয় আর কিছু বলতে চাই না।


একাধিক উপকারভোগী অভিযোগ করে বলেন- ঘর নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের বিষয় ইউএনওকে জানানো হলেও কোন লাভ হয় না। মাঝে মাঝে খারাপ ইট-খোয়া ফেরত দিলেও আবার যা আনে তা সেই আগের মতই। তাই মুখ খুলে বেশি কথাও কই না। বেশি অভিযোগ দিলে যদি ঘরের তালিকা আমাদের নাম কেটে দেয়, এই জন্য চুপ থাকি।

ঘরের কাজে কর্মরত মিস্ত্রিরা বলেন- নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করলেও আমাদের কিছু করার নেই। আমাদের যেসব মালামাল এনে দিবে আমরা তাই দিয়ে কাজ করবো। এর বাহিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

উপজেলা ও ইউনিয়ন ভুমি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেন- ঘর নির্মাণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তা দিয়ে সম্পন্ন কাজ করা সম্ভব। তারপরেও আমাদের ঘরের কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। অফিসের কাজ রেখে প্রতিদিন আমাদের ঘর নির্মাণের কাজে সহযোগিতা করা লাগে। এমনকি ঘরের ওয়ালও পানি দিয়ে ভিজাতে হয় আমাদের। এতে আমরা অফিসের কাজ ঠিকমত করতে পারছি না। ইউএনওর স্বামী আমাদের যেভাবে চালাচ্ছে, আমরা সেই ভাবে চলছি। মনে হয়’ সে-ই যেন ইউএনও।

সরেজমিনে গেলে স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি ও সাধারন মানুষ জানান- উপজেলার গট্টি ইউনিয়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রচুর পরিমান অব্যবহৃত জমি থাকার পরেও লক্ষনদিয়া গ্রামে এজাজ আহমেদ নামে তরুণ এক উদ্যোগক্তার একটি গরুর ফার্ম ভেঙ্গে সেখানে ঘর নির্মাণ শুরু করেন। ফার্মটি ভেঙ্গে ফেলায় ৩০ লাখ টাকা ক্ষতিসহ ভেঙ্গে চুড়মার হয়ে যায় ওই তরুণ উদ্যোগক্তার স্বপ্ন।

মাঝারদিয়া ইউনিয়নের কুমারপট্টি এলাকায় কুমার নদের পাড়ের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য মতিয়ার রহমান বলেন- আমার বাড়ির পাশে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০ শতাংশ নিচু জমি ৩০ হাজার টাকার মাটি কেটে ভরাট করে সেখানে গাছ লাগাই। আমার মত স্থানীয় বাসিন্দা সাদিমান মোল্যা ৪০, মাওলানা সামাদ ৩০, আকরাম আলী ৪০, ফারুক মাতুব্বর ৩০, দুলাল মাতুব্বর ৩০, শাহিদ শেখ ২০, আব্দুর রহমান ১৫, মুরাদ মোল্যা ২৫ ও রনি শেখ ২৫ শতাংশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিচু জমি দখলে নিয়ে অন্তত ১০ লাখ টাকার বালু-মাটি দিয়ে ভরাট করে সেখানে গাছ লাগান। গাছগুলো অনেক বড় হয়ে উঠে। এরই মধ্যে রিজিউম না করে জনসাধারণের দখলে থাকা এসব জমি উদ্ধারে নামেন ইউএনও।

বিষয়টি নিয়ে তখন এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। তারপরেও এসব জমিতে থাকা মেহেগুনিসহ প্রায় ৩ শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে বিক্রি করে দিয়ে জায়গা খালি করে সেখানে ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। অথচ কুমারপট্টিতে অনেক অব্যবহৃত খাস জমি রয়েছে। কারণ হিসেবে জানা যায়, কুমাপট্টি যেসব খাস জমি রয়েছে সেগুলো অনেক নিচু। তাই জনসাধারণের নিজস্ব টাকায় ভরাটকৃত উচু জমিগুলো উদ্ধার করে ঘর নির্মাণ করছেন ইউএনও।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন- সরকার ঘর তৈরী করে দিচ্ছেন জনসাধারণের উপকারের জন্য, অসহায় মানুষের মাথা গুজার ঠাই দেওয়ার জন্য। সরকার তো বলে নাই যে, একজনের ক্ষতি করে আরেকজনের উপকার করতে। সাধারন মানুষের ক্ষতি হয় এমন স্থান বাছাই করে গৃহ নির্মাণ করায় এলাকাবাসী হতাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অনিয়মের মাধ্যমে তৈরী এসব ঘর কতখানি স্থায়ী হবে তা নিয়ে স্থানীয় সচেতন মহল বলেন- গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য ঘর নির্মাণে সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে বরাদ্দ কম দিলেও তৃতীয় ধাপে পর্যাপ্ত রবাদ্দ দিয়েছেন। যা দিয়ে ভাল মানের কাজ করা সম্ভব। কিন্তু ঘর নির্মাণ কাজের দায়িত্বরত সরকারি কর্মকর্তারা নিম্নমানের সামগ্রী কিনে অর্থ বাঁচিয়ে পকেটভারি পায়তারা করার ফলে ঘরগুলো কতটুকু টিকসই হবে তা নিয়ে নানা ধরণের কথা রয়েছে।

অভিযুক্ত ইউএনওর স্বামী মো. শাহেদ চৌধুরীর সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়ে তাকে পাওয়া সম্ভব হয়নি।

ঘর নির্মাণের অনিয়মের বিষয় বক্তব্য নেওয়ার জন্য গৃহ নির্মাণ বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা: তাছলিমা আক্তারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

ফরিদপুর জেলা প্রশাসক অতুল সরকার গণমাধ্যমকে বলেন- গৃহ নির্মাণের বিষয় অনিয়ম হলে লিখিত অভিযোগ দেন। বিষয়টি আমি তদন্ত করে দেখছি। অনিয়মের সত্যতা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(এএনএইচ/এএস/মে ১৪, ২০২২)