আমি মোঃ আজিজুল হক। আামি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের দহকুলা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করি ১৯৫৩ সালের ১০ অক্টোবর। আমার বাবা আজগর আলী, তিনি ছিলেন একজন কৃষক। মা জমিলা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। আমরা দুই ভাইবোন আমি বড়। আমি ১৯৬৯ সালে মোহনপুর হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে, শাহজাদপুর কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হই।  আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী ছিলাম ১৯৭১ সালে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চে ভাষন দেন ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় জন্য প্রস্তুত থাকো’। 

এই বক্তব্যের মাধ্যমে আমি উদ্বুদ্ধ হই। এবং তার ডাকে সাড়া দেই। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। আমরা আমাদের দহকুলা গ্রামের একটা দল করি, যুদ্ধে যাবার জন্য, যারা ছিলাম তারা হলেন- “আমি সহ তায়জাল হোসেন, ছরাফ আলী, আব্দুল রশিদ, শামসুল হক,আবুল কাশেম,মুজিবুল হক, মাজেদ আলী”। আমরা যুদ্ধের জন্য তৈরী হতে থাকি। আমরা নিজ গ্রামে প্রাথমিক ভাবে ট্রেনিংও নেই। আমাদের সে সময় প্রাথমিক ট্রেনিং দেন ‘বেলাল দারোগা‘। প্রাথমিক ট্রেনিং শেষ করে আমরা ভারত ট্রেনিং নিতে চলে যাই। সিরাজগঞ্জ রান্ধনী বাড়ী থেকে আমরা ভারতে যাবার জন্য নৌকায় উঠি। ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে আমরা মানকাচর পৌঁছাই। আমাদের ভারত যেতে সময় লাগে দুই দিন। রৌমারীতে মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুট ক্যাম্প ছিল। রৌমারী ছিল মুক্ত এলাকা। আমরা চলে যাই রৌমারীতে। রৌমারী থানার কমান্ডার ছিল সিরাজগঞ্জ কলেজের ভিপি ইসমাইল হোসেন। সেখানেই আমরা অবস্থান করি। রৌমারীতে অবস্থান করার পরে, উচ্চতর ট্রেনিং এর জন্য আমরা ১৬০ জনের দল তুরা শহর থেকে বিমানে দিল্লীতে চলে যেতে চাই। কিন্তু ভাগ্যের ক্রমে ওখানে ট্রাক এক্সিডেন্ট হয়। পরে আমাদের আর যাওয়া হয় না।

সেখানে স্থানীয় ভারত আর্মি ক্যাম্পে একদিন অবস্থান করি। সেখান থেেেক আমাদের পাঠিয়ে দেয় মেঘলায় রিক্রুট ক্যাম্পে । সেখানে অবস্থান করি, এবং ট্রেনিং করি । তার পর আমরা কার্তিক পাড়া অবস্থান করি । সেখান থেকে আমরা দেশের মধ্যে চলে আসি। তিন মাস বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনিং নেই আমরা । আমাদের শবে বরাত, রমজান ,ঈদ সব ভারতেই কাটে। ঈদের পরে আমরা দেশের ভিতরে ঢুকি। আমাদের প্রথমে ময়মনসিংহ যেতে বলা হয়। কিন্তু অপরিচিত জায়গার জন্য আমরা সেখানে যেতে চাই না। অবশ্য আমাদের একটা দল ময়মনসিংহ যুদ্ধ করে। পরে আবার আমাদের সাথে যোগ দেয়। আমরা যখন দেশের ভিতরের রাস্তায় ডুকে পড়েছি। সে সময় লতিফ মির্জা নৌকার সাথে আমাদের দেখা হয়। লতিফ মির্জা নৌকা বহর নিয়ে ভারত যাচ্ছে। আর আমরা দেশে মধ্যে চলে আসতেছি। তাদের সাথে আমরা দেখা করি । তারপরে চলে আছি আমরা নিজ গ্রামে , গ্রামে এসেছে ক্যাম্প স্থাপন করি রাজমানে। রাজমানে আমাদের ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন আব্দুল ছামাদ। আর আমরা ছিলাম যারা তারা হলেন, আমি ও তায়জাল হোসেন, ছরাফ আলী, আব্দুল রশিদ, শামসুল হক,আবুর কাশেম,মুজিবুল হক, মাজেদ আলী । আমরা ছোট ছোট অপারেশন করতে থাকি।

উল্লাপাড়ার, শ্রীফলগাঁতী রাজাকারের কমান্ডার ছিলেন মোসলেম উদ্দিন , তার পরিবারের ২২ জন্য রাজাকার ছিলেন, তার ভাই ভাতিজা,ছেলে, ভাগ্নে সহ অনেকে। আমরা মোসলেম উদ্দিনের বাড়ি ঘেরাউ করি । এবং তাকে আমরা ধরি নিয়ে আসি। তাকে ধরে নিয়ে আসার সময় আমরা তার বাড়ি থেকে কিছু মালামালও নিয়ে আসি। আমাদের ক্যাম্পের জন্য। যাতে আমাদের কোন সম্যসা না হয় খাওয়া দাওয়াতে। আমার মোসলেম উদ্দিন রাজাকারকে মেরে ফেলি।
এর পরে আমরা আবার একটা রাজাকারের তথ্য পাই। আমাদের পার্শ্ববর্তী থানার একটি গ্রামে। সাধারন মানুষদের নানা ভাবে অত্যাচার করতো তারা । যেদিন রাতে রাজাকার বাড়িতে অবস্থান করে, সেইদিন সাধারন মানুষ আমাদের রাজাকার টি খোঁজ দেয়। কমান্ডার সহ আমি, তায়জাল মাষ্টার, শামসুল সহ কয়জন মিলে রাজাকারে বাড়ি ঘেরাউ করে রাজাকারকে আমরা হত্যা করি।

এদিকে উল্লাপাড়া থেকে মোহনপুর বাজারে কয়েকজন মিলিটারি প্রতিদিন রেললাইন দিয়ে হেটে আসতো । আমরা তাদের কে প্রতিহিত করার জন্য শ্যামপুর ব্রিজে বাধা সৃষ্টি করি। ছোট একটা যুদ্ধ হয়। সেখানে একজন মিলিটারিকে আমরা মারতে সক্ষম হই এবং তার চাইনিজ অস্ত্রটা আমি নিয়ে আসি। আর অন্য মিলিটারিরা পালিয়ে চলে যায়।
রাজাকারদের দমন করার জন্য দহকুলা ব্রিজ অপারেশন করি আমরা। এবং যুদ্ধ হয়। দহকুলা ব্রিজে অপারেশন চালাই। লতিফ মির্জার দলের সাথে পরিকল্পনা করে আমরা যুদ্ধ করি। আমরা থাকি দহকুলার হাটে আর মির্জার দল থাকে উত্তর দিকে । আমরা হাটে দিকে আগেই পজিশন করে থাকি। রাজাকাররা হাটের দিকে আমাদের দিকে আক্রমন করে গুলি করে ,কিন্তু আমরা গুলি করি না। আমরা চুপচাপ থাকি রাজাকাররা আমাদের দিকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসতে থাকে। আর আমাদের দিকে আসলেই আমরা রাজাকারদের ধরে ফেলি। ঘটনা স্থানে কয়েকজন রাজাকার মারাও যায়। আমরা তাদের অস্ত্র নিয়ে নেই। এভাবে চলতে থাকে আমাদের যুদ্ধ। আমি-থ্রিনটথ্রি, মিলিটারিদের চাইনিজ রাইফেল , মার্ক ৪,দ্বারা যুদ্ধ করতাম।

যুদ্ধ শেষ, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা কয়েক দিন পরেই সিরাজগঞ্জ কলেজ মাঠে প্রবাসী সরকারের অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীর কাছে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আনুষ্ঠানিক ভাবে অস্ত্র সমর্পণ করি।

যুদ্ধ শেষে আজিজুল হক ফিরে যান কলেজে। ১৯৭২ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে পাবনার ভাংগুড়া কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু ডিগ্রিটা শেষ করা হয় না তার । তারপর শিক্ষকতায় পেশায় যোগ দেন মোহনপুর হাইস্কুলে। ১৯৭৪ সালে মমতাজ বেগমকে বিয়ে করেন। পাচঁ সন্তানদের জনক। পুত্র: আব্দুল মালেক ও কন্যা: ফাতেমা, হালিমা, খাদিজা পারভীন, আরজিনা পারভীন। শিক্ষকতা থেকে আজিজুল হক ২০১৩ সালে অবসর নেন। বর্তমান ঠিকানা: দহকুলা, মোহনপুর, উপজেলা: উল্লাপাড়া, জেলা: সিরাজগঞ্জ।

অনুলিখন : ইমরান হোসাইন, গণমাধ্যম কর্মী।