মো. আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : ডিজিটাল বাংলাদেশে গ্রাম হবে শহর, এটিই বর্তমান সরকারের অন্যতম পরিকল্পনা। এটি বাস্তবায়নে সরকার কর্তৃক দেশব্যাপী সড়ক, ব্রীজ কালবার্টসহ রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। এমন সময়ে গ্রামাঞ্চলের অনেক জায়গায় কাদাজল মারিয়ে এখনো প্রতিদিন হাজারো মানুষ তাদের গন্তব্যে ফিরতে হয়। এরকম একটি অবহেলিত সড়ক মৌলভীবাজার সদর উপজেলার নাজিরাবাদ ইউনিয়নের আটঘর এলাকার আটঘর পয়েন্ট থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়ন্ত্রনাধিন ওয়াবদা বাঁধ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ কাঁচা সড়ক।

সড়কটি ২০১১ সালের দিকে প্রয়াত সমাজকল্যাণ মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী মৌলভীবাজার-৩ আসনের তৎকালিন সংসদ সদস্য থাকাকালে তাঁর সহায়তায় এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে রাস্তা পাকা করণের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এর অর্ন্তভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে আটঘর পয়েন্ট থেকে ওয়াবদা বাঁধ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তা পাকা করণের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করা হলেও শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি। রাস্তাটি দীর্ঘদিন যাবত পাকা না হওয়া বর্ষায় হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। বিষয়টি নিয়ে ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ বিরাজ করছে।

সরেজমিন সূত্রে জানা যায়, নাজিরাবাদ ইউনিয়নের আটঘর, নারাইনপাশা,মানিকপুর,কৈল্যানপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েকহাজার মানুষ প্রতিদিন চলাচল করেন আটঘর পয়েন্ট থেকে ওয়াবদা বাঁধ পর্যন্ত নির্মিত কাঁচা রাস্তা দিয়ে। জেলার তিনটি বড় হাওরের মধ্যে হাইল হাওরের পার্শ্ববর্তী ও স্থানীয়দের কাছে মানিক হাওর হিসেবে পরিচিত হাওর যেতে হয় ওই সড়ক দিয়েই। প্রত্যেক বছর বোরো মৌসুমে হাজার হাজার মণ বোরো ধান হওরের কৃষি জমি থেকে সংগ্রহ করতে হয় ওই রাস্তা দিয়েই। কিন্তু কাঁচা রাস্তা হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে রাস্তাটি বর্ষার পানিতে জমাট হয়ে চলাচলের অনুপযোগী যায়। সৃষ্টি হয় পুরো রাস্তাজুড়ে কাদাজল। ওই কাদাজল মারিয়েই হাইল হাওর ও মানিকহাওর থেকে সদর উপজেলার আমতৈল ও আপারকাগাবালা ইউনিয়ন এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নসহ দুই উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের শতশত কৃষক তাদের উৎপাদনকৃত বোরো ধান সংগ্রহ করতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হন। বিশেষ করে হাওর পাড়ে বসবাস করা কয়েকশ পরিবারের জন্য ওই সড়কটি এক দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে আনছে যোগ যোগ ধরে। বর্ষা মৌসুমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা চলাচল করতে গিয়ে দুর্ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছেন পথচারীসহ এলাকাবাসী। হঠাৎ করে কোন দূর্ঘটনা কিংবা গর্ভবতী নারীদের সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌছানোও বেশ কষ্টসাধ্য। রাস্তাজুড়ে কাদাজল সৃষ্টি হওয়ায় বর্ষায় রুগীবাহী এম্বুল্যান্সসহ কোন যানবাহনই চলাচল করতে পারেনা। সড়কটির গুরুত্ব এ অঞ্চলের মানুষের কাছে যেকারনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ওই সড়ক পার হলেই বিশাল বিশাল বিল, গবাদিপশুর খামার, কৃষি আর নানা জলজ সম্পদে ভরপুর বৃহত্তম হাইল হাওর ও মানিক হাওর রয়েছে এখানে। হাওরে পৌঁছতে হলে এ সড়কটিই একমাত্র অবলম্বন। এছাড়াও কাঁচা ওই সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, কৃষক, জেলে, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার কয়েকহাজার মানুষ যাতায়াত করেন। আর এটিই তাদের যাতায়াতের একমাত্র সড়ক। হাওর আর কৃষি কেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ যাদের একমাত্র পেশা তারাও ওই সড়ক দিয়ে যাতায়াত করেন নিয়মিত। এলাকাবাসীর দাবি রাস্তাটি পাকা হলে বদলে যাবে ওই এলাকার মানুষের সামগ্রীক জীবনমান উন্নয়নের চিত্র। হাওর জুড়ে বাড়বে কৃষি উৎপাদনসহ মৎস আহরণ।

স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মহসিন আহমদ বলেন, ২০১৪ সালে ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি মো. আমজদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি দ্বায়িত্বে থাকাকালে রাস্তাটি পাকা করণের জন্য এলাকাবাসীর পক্ষে আবেদন করেও ব্যর্থ হই। আমরা অবহেলিত, এর অবসান চাই।

স্থানীয় কৃষক মো. আতাউর রহমানসহ কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়,রাস্তা সমস্যার কারনে হাওর ও হাওর পাড়ের শতশত কৃষকের গবাদিপশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য দূর থেকে পাইকারদের আসতে বেশ সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। এতে করে অনেকটা কম দামে গবাদিপশু বিক্রয় করতে বাদ্য হন কৃষকরা,ফলে অনেকেই গবাদিপশু পালন এক প্রকার বাদই দিয়ে দিয়েছেন। হাওর থেকে হাজার হাজার মণ ধান উৎপাদন হলেও যাতায়াতের সমস্যা থাকায় সেগুলোও অনেকটা কম দামে বিক্রি করতে হয় স্থানীয় কৃষকদের।

কৃষক রুহেল মিয়া বলেন,হাওরে এবছর বোরো ধানের ফলন ভাল হলেও যানবাহন সমস্যার কারনে প্রতি মন ধান অন্তত দু’শ টাকা কম মূল্যে বিক্রি করতে হয়, তবে রাস্তা পাকা হলে শুধু কৃষি নয় সব ক্ষেত্রে সূফল ভোগ করবে এঅঞ্চলের কৃষক আর হাওরের জেলেরা।

দীর্ঘ কয়েকযুগ যাবত হাওরে গবাদিপশু পালন করেন কৃষক আনিছ আলী,ক্ষোভ জানিয়ে তিনি বলেন, বর্ষায় এ রাস্তায় চলাচল করা সম্ভব হয়না। হাটু পর্যন্ত দেবে যায়,বিকল্প হিসেবে তখন নৌকা দিয়েই চলাচল করতে হয়। তাঁর ক্ষোভ সব জায়গায় রাস্তাঘাটের ব্যপক উন্নয়ন ও পরিবর্তন হলেও আমরা অবহেলার শিকার হচ্ছি যোগযোগ ধরে।


নাজিরাবাদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান দাবি করে বলেন,১৯৭৮ সালে আমি ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলাম,ওই সময় সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী হিসেবে সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী প্রয়াত এম সাইফুর রহমান মন্ত্রী থাকাকালে প্রয়াত মন্ত্রীর সহায়তায় মানিক হাওরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধিন তিনকিলোমিটার ওয়াবদা বাঁধ মাটি দ্বারা ভরাট করার উদ্যেগ নেই,পরবর্তীতে বাঁধ নির্মাণও করা হয়। তবে আটঘর পয়েন্ট থেকে বাঁধের সংযোগস্থল পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তাটি পাকা করণের জন্য বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই।

এদিকে দীর্ঘদিনের অবহেলিত ওই রাস্তাটির বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে নাজিরাবাদ ইউনিয়নের সদ্য নির্বাচিত বর্তমান চেয়ারম্যান মোঃ আশরাফ উদ্দিন বলেন, রাস্তাটি এলজিইডির হলেও দুই বছর পূর্বে স্থানীয় এলাকাবাসীর নিজ অর্থায়নে কাঁচা রাস্তাটি সংস্কার করা হলেও বর্ষার পানিতে ফের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমি এর আগেও এ রাস্তাটি পাকা করণের জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, সামনে ইউনিয়নের বার্ষিক বাজেট রয়েছে। বাজেট পরবর্তী সময়ে মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ এমপি মহোদয়ের মাধ্যমে ডিও লেটার পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আমার সর্বোচ্চ চেষ্ঠা থাকবে যাতে শীঘ্রই রাস্তাটির পাকাকরণ সম্পন্ন হয়।

সদর উপজেলা এলজিইডি’র প্রকৌশলী মো. আলমগীর হোসেন বলেন, বর্তমানে সদর উপজেলায় এলজিইডির কোন প্রকল্প নেই,আগামীতে একটি উন্নয়ন প্রকল্প আসার সম্ভাবনা রয়েছে,তখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে রাস্তাটি পাকাকরণের ব্যবস্থা নেব।

(একে/এএস/মে ২৮, ২০২২)