রিপন মারমা, রাঙামাটি : মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য  প্রচলিত এই কথার ভিত্তিতে সময়ে -অসময়ে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে কাপ্তাই ইউএনও মুনতাসীর জাহান সেসময় তিনি বলেছেন, যুগে যুগে একটি বার্তাই দিয়েছে যে মানবতাই শক্তি, মানবতাই মুক্তি।

তিনি আরো বলেন, এখনও যুদ্ধ নয়, মানবতা দিয়েই পৃথিবী গড়তে চায় অনেক মানুষ। মানুষ জানে শুধু নিজের জন্য বেঁচে থাকাই বেঁচে থাকা নয়, অসহায় মানুষের চোখের পানি মুছে দিয়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যারা মানুষের পাশে আস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তারাই মানবতার কারিগর। সমাজের ঝামেলাহীন মানুষের সাথে এখনো কিছু মানুষ আছে যারা জীবন বলতে বোঝে শুধু নিজের জন্য বেঁচে থাকা নয় আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। তাঁরা দাঁড়িয়ে আছে মানবতার প্রশ্নে। তাঁরা নিজেদের অবস্থান থেকে সাধ্যমত এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

স্বামী সন্তান হারা অন্ধ লক্ষী রাণী দে। রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতালে বারান্দায় গত ১৭ বছর ধরে তিনি বসবাস করে আসছেন। হাসপাতালের বারান্দা ছাড়াও মিশন হাসপাতাল গেইট এবং চন্দ্রঘোনা দোভাষী বাজারে ও কেপিএম কলাবাগান এলাকায় দিনরাত কাটে তার । কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা কিংবা উৎসব পার্বন কখন যে চলে যায় তার জীবনে এই সবের কোন কিছু আসে যায় না। প্রতিদিন একবেলা আহার পেলেই চলে যায় তার দিবারাত্রি।

রাঙামাটির রাজবাড়ি এলাকায় তার বাবার বাড়ী। তার বাবার নাম ক্ষিতিশ বিশ্বাস। কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার ফলে তাদের পৈত্রিক বাড়ী কাপ্তাই হ্রদের তলিয়ে যাবার পর স্বাধীনতার আগে তারা স্ব- পরিবারে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা হিন্দু পাড়ায় মামার বাড়ীতে চলে আসেন। সেখান থেকে তার বিয়ে হয় রাউজান উপজেলার উনসত্তর পাড়া গ্রামের মানিক চন্দ্র দে’এর সাথে। সুখেই চলছিল তাদের জীবন। স্বামী কৃষি কাজ করে সংসার চালাতো। এরই মধ্যে তার ২ সন্তান পৃথিবীতে ভুমিষ্ট হয়। কিন্ত সবার কপালে কি সুখ আর সয়। তার প্রথম সন্তান লিটু দে মাত্র ১২ বছর বয়সে দূরারোগ্য ব্যধিতে রোগে মারা যান পাহাড়তলি শ্বশুর বাড়ীতে। তার বড় ছেলে লিটু মারা যাবার পর ৭ বছর পর আর এক ছেলে সুজয় দে মাত্র ১৩ বছর বয়সে সেখানে মারা যান। ছেলে হারা লক্ষী রাণী জীবন যেন এক বিভীষিকায় পরিনত হয়।

কথাই আছে “মরার উপর খাড়ার ঘাঁ”। ছেলে হারানোর ৮ বছর পর পুত্রশোক সইতে না পেরে লক্ষী রাণী দে’এর স্বামী মানিক চন্দ্র দে সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। স্বামী মারা যাবার পর তার জীবনে নেমে এসে আরোও চরম দূর্বিসহময় দিন শুরু হয়। শুশুর বাড়ীর লোকজনের অত্যাচারে তিনি এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে চন্দ্রঘোনা হিন্দুপাড়া মায়ের ঘরে চলে আসেন। সেখানেও তার সুখ পাখি যেনো অধরা হয়ে রইল। সহায় সম্বল যা ছিল তা নিয়ে তার এক ভাই চলে যান অন্যত্র।

এরপর তিনি চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতাল এর চিকিৎসক ডা: মনোজ বড়ুয়ার বাসায় কাজ নেন। ডা: মনোজ বড়ুয়া ছাড়াও মিশন এলাকার অনেকের বাসাবাড়ীতে ঝি এর কাজ করে কোন রকমে তার জীবন চলতো।

এরই মধ্যে তার জীবনে আসে আরো একটি দুঃস্বপ্ন। ১৯৯২ সালে চোখে দেখা দেয় তার কঠিন রোগ। অপারেশন করতে গিয়ে তিনি হারান তার দু’চোখ। চোখ হারানোর পর অনেকের বাসায় তার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন মানুষের দেওয়া অন্ন বস্ত্রে তার জীবন চলে। যেদিন পায় সেদিন খায়, না পেলে কখনোও কখনোও পানি খেয়ে হাসপাতাল এর বারান্দায় ঘুমিয়ে যান লক্ষী রাণী দে।

বিভিন্ন সময় পত্র পত্রিকায় লক্ষী রাণী দে’ কে নিয়ে বিভিন্ন হ্রদয়বিদারক সংবাদ প্রচারিত হয়। এই সব সংবাদ নজরে আসার পর এগিয়ে আসেন কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) মুনতাসির জাহান। তিনি বেশ কয়েকবার মিশন হাসপাতাল গেইট এলাকায় এসে লক্ষী রাণীকে খোঁজ খবর নেন এবং তাঁকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। সেইসময় ইউএনও মুনতাসির জাহান তাঁকে ঘর করে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। ইউএনও এর এই উদ্যোগে এগিয়ে চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা মংচিং মারমা। তিনি এক গন্ডা জায়গা দেন লক্ষী রাণী দে কে ঘর করে দেবার জন্য। সেই জায়গার উপর কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির জাহান স্থানীয় উদ্যোগে মে মাসে ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন।তিনি কথা দিয়েছিলেন ভরাবর্ষার আগেই লক্ষীরাণী ঘরে উঠবে। কথা রেখেছেনও তিনি।

অবশেষে বুধবার (১ জুন) বেলা সাড়ে১২ টায় কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির জাহান ঐ জায়গায় এসে অন্ধ লক্ষী রাণী দে ‘ কে নিজে এসে নতুন ঘরে চাবি তুলে দেন।লক্ষীরাণী জন্য নতুন কাপড়,খাবার-দাবার,ঘরের সরঞ্জামাদিসহ নিয়ে আসেন তিনি।এসময় উপস্থিত সকলকে মিস্টিমুখ করিয়ে লক্ষীনিবাসের যাত্রা শুরু করা হয়। এইসময় কাপ্তাই উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রুহুল আমিন, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নাজমুল হাসান, বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ বি কে দেওয়ানজী, চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা সজল বিশ্বাস এবং গণমাধ্যমসহ স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।

(ওএস/এসপি/জুন ০১, ২০২২)