পীযূষ সিকদার


অনন্যার আত্মহত্যায় আমার মধ্যে নীল কষ্ট চেপে বসেছে! বসেছিল! আমরা ভুলতে বসেছি যে, আমাদের একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসের পেছনে নারী আছে। একথা কথিত যে প্রত্যেকটা যুদ্ধের পেছনে নারী লুক্কায়িত। সত্যটা এই যে, আমরা গভীরের সত্য নিয়ে কেউ ভাবিনা! কেবল নারীকে দোষ দিতে দিতে মুখের কোণায় সাদা ফেনা তুলে ফেলি! আমার মা আছে। আমার বোন আছে। নিজের মা বোনকে দোষ দেইনা! কেবলই অন্যের নারীকে আমরা ল্যাংটা করে ছাড়ি। নারী না হলে নর অচল আবার আবার নর না হলে নারী অচল। আমরা কেবলই অচলবৃত্তে হাবুডুবু খাই! সচলতা মানুষের ধর্ম। এই চরম সত্যকে আমরা মেনে নিইনা। গ্রীস সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল নারীর কারণে!

নারীকে দোষারোপ করতে হলে প্রথম নিজের মাকে দোষারোপ করতে হবে! এটা সম্ভব নয় নারী বিদ্বেষীদের কাছে। দেবী দুর্গাকে দেখলে কাম জাগে। এই সমস্ত পুরুষদের পাথর ছুঁড়ে মারতে হবে। তোমার সুন্দরী বৌটিকে দামী কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছো! আর অন্য নারীকে হাফপ্যান্ট পড়িয়ে মনের কামনা বাসনা পূরণ করছো! একদিকে ধর্ম অন্যদিকে অধর্ম কাউকেও ছাড়ে না! ছাড়লে যে পুরুষের বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। প্রায় প্রত্যেকটি পুরুষ, নারীকে আমরা সব সময় চাবুকের তলে রাখতে পছন্দ করি। অথচ পুরুষ জানেই না নারী কৃষিকাজ আবিষ্কার করেছিল। আমরা শুধু নারীকে দুষি। আসল সত্য এই যে, আমরা কোন না কোন নারীর গর্ভজাত সন্তান। হাতে হাত মিলিয়ে আমরা না চললে একসময় আমাদের দুই হাতে বড় শূন্য এঁকে দেবে স্রষ্টা! আসলে মনে আমাদের বিষ ঢুকেছে। সে বিষ মনবেদনা আনে! তারপরও নিজের মা বোন থাকার পরও অন্যের মা বোনকে গাল দিচ্ছি। নারী পুরুষ এই বিভাজনকে-কে কবে টেনেছেন তা জানা নেই আমাদের। নারীর অধিকার নিয়ে নানান রকমের সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম হচ্ছে। তথাপি নারী অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে।

নারীকে ঘরমুখি না করে কর্মমুখী করে তোলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নারীরা নির্যাতিত হতে হতে মুখ হয়ে গেছে। তাদের মাথা নেই, কান নেই, মুখ নেই, পেট নেই, পা নেই, হাত নেই! অথচ উপরের দিকে আমরা যদি তাকাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। অনেকে বলে, নারীর শাসন ভয়ংকর! যারা বলে তারা কোন অবস্থাতেই মেনে নিতে পারছে না। আশ্চর্য লাগে এত নারী পৃথিবীর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে উঠে প্রধান প্রধান দেশগুলো নারী শাসন মেনে চলছে। নারীকে যারা ইজ্জত দেয় না তারা ভুল স্বর্গে বসত করছে! নারী পুরুষের যৌথ সংযোগই পারে একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র উপহার দিতে। নারী পুরুষের যৌথ কর্মযোগে সংসারও হয়ে উঠে মধুময়।

আমরা পারলাম না। উদাহরণ ভূরি ভূরি। তবুও পেছনে টানে আমাদের। পৃথিবীর ইতিহাস এগিয়ে চলার। শুধু পেছন আমাদের টানে। মৌলবাদীরা (কী হিন্দু কী মুসলমান ) নানা উক্তি প্রত্যুক্তি দিয়ে পেছনে ঠেলছে, পাহাড় ঠেলার মতো!
প্রগতি সবসময় সামনের দিকে এগোয়। ভাবতে খারাপ লাগে পৃথিবী কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! আর আমরা ধর্ম ধর্ম কওে নিজেরা রক্তাক্ত হচ্ছি। পৃথিবীনামক গ্রহটি মিলনের। ভালোবাসার। প্রেমের। এসব বাদ দিয়ে আমরা কেবলি পেছনে হাঁটছি। সামনের দিকে এগোতে আমাদের ভয় করে! ধর্ম গ্রন্থে থরে থরে লোভ সাজানো আছে!

একটু ভিন্ন প্রসংগে আসি যদিও কথাগুলো প্রাসংগিক। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে পথে হেঁটেছেন। সেই কাঁটা দলে কাজী নজরুলও হেঁটেছেন। নজরুল বলেছেন, তাঁর সৃজন কর্মে ‘‘...আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোন ভেদাভেদ নাই। বিশ্বে যা কিছু মহান্ সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর...।’’

‘‘...যখনই পৃথিবীর বুকে অসার কিছু নিয়মের থাবা সত্য প্রেমের পথকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে, তখনই নারীরা নদীর স্রোতের মতো ভাসিয়ে দিয়েছে সেসব অনর্থক নিয়মকে। কখনো বালিকা, কখনো যুবতী, কখনো নারীরুপে হাতে তুলে নিয়েছে বিপ্লবের আয়ুধ। আর চোখে রেখেছে দিন বদলের স্বপ্ন। সত্য প্রেমের আলোকে পাথেয় কওে তারা এগিয়ে চলেছে এক নতুন পবিত্র পৃথিবীর দিকে। অপর্না, সুদর্শনা বা নন্দিনী এদের ভিন্ন কেউ নয়। বিপ্লবের ভিন্ন ভিন্ন রুপ মাত্র।’’
প্রথমদিকে অনুশ্রী সাহা বলছেন, ভ্রুনাবস্থা থেকেই নারীজাতির সঙ্গে আমাদের নাড়ির যোগ। কখনো মা, কখনো ভগিনী, কখনো প্রেয়শী, কখনো-বা সহধর্মীনীরুপে তাঁরা ধরা দিয়েছেন।’’

যুগ যুগ ধরে নারীকে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়েছে। নারীর ক্ষমতা শুধু সন্তান উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখলো তৎকালীন ধর্ম যাজকরা। নারীর কোন স্বাধীনতা নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী শুধু সন্তান দেবার একটা মাধ্যম। নারীর কোন জাত নেই। নারীর কোন ক্ষমতা নেই। নারীর কোন বাক্য নেই!যুগ যুগ ধরে নারী অবহেলিত হয়েই আসছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কাব্যনাট্যের কথা মনে পড়ছে কচ স্বর্গ থেকে আসে শুক্রাচার্যের কাছে। যুদ্ধ বিদ্যা শেখার জন্য। অবসরে দেবযানীর ( শুক্রাচার্যের কন্যা ) সাথে কথা হয়। একসময় দেবযানী কচের প্রতি টান অনুভব করে। কচের যুদ্ধবিদ্যা শেষ। দেবযানীর ভালোবাসার কি হবে! কচতো এসেছে বিদ্যা শিক্ষার তরে! দেবযানী বলে, আমার কথা নাই বা মনে রাখলে এই যে নদী, গাছ, ধেনু। একবারও তোমার মনে পড়বে না! এক সময় দেবযানী অভিশাপ দেয়

‘‘যে বিদ্যার তরে মোরে করো অবহেলা, সে বিদ্যা তোমার তোমার সম্পূর্ণ হবে না বশ শিখাইবে কিন্তু পারিবে না করিতে প্রয়োগ।

কচ বলে আমি বর দিনু দেবী তুমি সুখি হবে ভুলে যাবে সর্ব গ্লানি বিপুল গৌরবে।’’ এ নাটকে নারী নিগৃহিত হয়েছে তার আভাস পাই।

একবার যদি নারী সাহসে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারতো তাহলে নারী একদিন পৃথিবী ঘুরাতো হাতের মুঠোয়। আবার অন্যভাবে দেখতে গেলে নারী অধীন, স্বাধীন ভাবে তাকে চলতে দিলে সে পারে না! অতি নারীবাদী হয় নতুবা অধীনতা স্বীকার করে পুরুষের কাছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা উঠে দাঁড়াতে পারে না। সকল নারীর প্রতি দীন হীনের বন্দনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের অনুসরণ হতে পারে প্রত্যেকটি নারীর অথবা সকল রমনীর।

আধুনিকতার নামে হে নারী অতি আধুনিকতার চোরা বালিতে পড়ো না! এখনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরা নারীর স্বাধীনতা চায়। নর ও নারী মিলে এমন সমাজ গড়ে উঠুক যেখানে ভেদ ভুলে অভেদ হোক। ফুলে ফলে ভরে উঠুক সাজানো বাগান। মনের কালিমা ঘুচুক আলোতে আলোতে।

মহান মুনি ঝৃষিরা সব সময়ই তারা নারীর স্বাধীনতা চেয়েছেন। পরাধীনতার শৃঙ্খলে নারী শুধু কেবলি দুই পায়ে শৃঙ্খলে জড়াবে। আমরা শুধু বিভাজন করি। ভাগ করি। ভাগ করতে করতে নারীর পায়ে বেঁড়ি আর বেঁড়ি পড়ে। এখান থেকে নারীর কি বের হবার উপায় নেই ?

উপায় আছে। নারীকে শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষার মধ্য দিয়ে নারী তার অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। নারীদের অনুকরণীয় নারী পূণ পূণ পাঠ করতে হবে। আমার বিশ্বাসÑএকদিন অন্ধকার ফুঁড়ে আলো জ্বলবেই।

লেখক : শিক্ষক ও নাট্যকার।