| প্রবীর বিকাশ সরকার |

|

আমার ৫৫ বছরের জীবনে ৩৮টি বছরই কেটেছে লেখালেখি নিয়ে। প্রথমে ছড়া। তারপর কবিতা। এরপর সমকালীন বিষয়াদি নিয়ে প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস এবং বিস্মৃত ব্যক্তিদের তথ্যালোচনা। কবে কোন্ পত্রিকায় কি লিখেছি সব সংগ্রহে নেই। হারিয়ে গেছে অনেক লেখা। এখনো অনেক লেখা সম্পাদকদের অনুরোধে লিখে দিয়েছি যথরীতি প্রকাশিতও হয়েছে কিন্তু সৌজন্য সংখ্যা দূরঅস্ত।

আমার বিশ্বাস, আমার প্রজন্মের লেখক বা সাহিত্যচর্চকদের মধ্যে সবচে কম পড়াশোনা ও পড়ালেখাকৃত ব্যক্তি আমি। কোনো বিষয়ের বিশেষজ্ঞ আমি নই, যখন যা মনে ধরেছে লিখেছি। সেগুলো আদৌ লেখা, রচনা বা সাহিত্য হয়েছে কিনা যাঁরা পড়েছেন তাঁরাই বিচার করতে পারবেন। বিচার করবে মহাকাল।

কিন্তু কী যে লিখেছি এতটা বছর নিজেই ভালো করে জানি না। কেবল লিথেই গেছি। সদ্যস্বর্গযাত্রী পরম পূজনীয় পিতা বার বার বলেছে, “কী হল কী হল না সেটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। লেখার কাজ বড় কঠিন, সবার দ্বারা তা সম্ভব নয়। তুমি যা লিখছ সেসব আমি পাঠক হিসেবে অসাধারণ মনে করি। বিশেষ করে ইতিহাস ও জাপান নিয়ে তোমার কাজ অমরত্ব পাবে। নিঃসন্দেহ থাকো। পাঠক হিসেবে যদি ভালো না লাগত, আমার জানার কৌতূহল না জাগাত, আকৃষ্ট না করত তা হলে বহু আগেই বলতাম, ভুতের বেগার খেটে লাভ নেই বাবা অন্যপথ ধরো! লেখক হিসেবে তোমার কাজ লিখে যাওয়া। মনে করো তুমি সাহিত্য জগতে একজন কেরানি। কলম পিষে যাও। এটাকে তুমি হবি বা খেলা হিসেবেও নিতে পারো। জেতাজেতি, হারাহারির কোনো দরকার নেই। ব্যাস, তোমার কাজ তুমি করে যাও।”

পিতৃবাক্য শিরোধার্য! বৃটিশ আমলের মেট্রিকপাশ বাবার ছিল বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অসামান্য দক্ষতা। আইনি গ্রন্থের পাশাপাশি ইতিহাস, সাহিত্য ও জীবনী পড়েছে বিস্তর। রবীন্দ্রনাথের ‘শাহজাহান’ কবিতাটি অনর্গল বলে যেতে পারত। কোন্ বিখ্যাত ব্যক্তি কোন্ সময় কোন্ মন্তব্য করেছেন বা লিখেছেন মাঝেমাঝে আমাকে পরীক্ষা করার জন্য জিজ্ঞেস করত। না পারলে বলে দিত। অঙ্কে ছিল চিরকালই খাসা। শেষ বয়সে এসে পত্রিকা আর বই ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। বাবার পরিত্যক্ত বইপত্রের ভেতরে নানা টুকিটাকি মন্তব্য, তথ্য এবং পেপারকাটিং খুঁজে পেয়েছি। চিরকালের জ্ঞানেন্বষক বাবা যখন উপরোক্ত মন্তব্য করেছে তখন প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়ে প্রবাসী জীবনে শতব্যস্ততার মধ্যেও লিখে গেছি। পড়াশোনার চেয়ে বরং লিখেছিই বেশি। যখন সময় পেয়েছি গ্রন্থাগারে ছুটেছি। আর অধিকাংশ সময় ট্রেনে বসেই গ্রন্থাদি, পত্রিকা বা কপি পড়ে নোট রেখেছি। সম্ভবত প্রবাসী লেখকদের মধ্যে ১৯৮৪ থেকে এই ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিতভাবে লিখতে পেরেছি আমিই---আমার যতখানি মনে হয়। সেই তুলনায় অবশ্য প্রকাশিত গ্রন্থাদি খুবই কম। পাণ্ডুলিপি পড়ে আছে।

ছড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছি সেই দুদশক আগেই। কারণ মোবাইল ডিভাইসের যুগে ছড়ায় নতুন কিছু দেয়ার নেই। বরং সমকালীন সংস্কৃতি ও ইতিহাস একুশ শতকের সবচে আকর্ষণীয় বিষয়। আর এদুটো বরাবরই আমাকে টেনেছে আর সেইসব লেখার চেষ্টা করেছি, এখনো করে চলেছি। জীবিতকালে বাবা সংশোধনও করে দিয়েছে বেশকিছু। জাপান-রবীন্দ্রনাথবিষয়ক লেখা ঠিকঠাক করে দিয়েছেন প্রয়াত অধ্যাপক কাজুও আজুমা। আজ দুজনেই নেই- বড় অসহায় মনে হয়।

(ছবি: জাপান রেডক্রসের প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক পতাকাগবেষক অধ্যাপক ফুকিউরা তাদামাসার সঙ্গে আমি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি বাংলাদেশে কাজ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর লিখিত গ্রন্থ ‘চি তো দোরো তো বাংরাদেশু দোকুরিৎসু নো হিগেকি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর। তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক কালেরকণ্ঠে। ফুকিউরার সঙ্গে গ্রন্থবিনিময় করার সময় এই ছবিটি তুলেছেন তাঁরই অফিসে কর্মরত এক তরুণী।)

লেখক : জাপান প্রবাসী