আবীর আহাদ


যাঁদের সীমাহীন শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে সংঘটিত হয়েছিলো জাতীয় স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধ সেই মুক্তিযুদ্ধের বীরসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বা তাঁদের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো সংগঠনের সাথে কোনোপ্রকার সংশ্রব না রেখে বা কোনো পরামর্শ না করে যারা অপরিপক্ক আন্দোলনের অজুহাতে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্মের ব্যানারে মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সামাজিক বিতৃষ্ণা সৃষ্টির ইন্ধন জোগায়, তাদের সম্পর্কে প্রশ্ন থেকে যায়। ইতোমধ্যে এ ধরনের কতিপয় সন্তান সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের দাবির বহর নিয়ে আন্দোলনের নামে রাজপথে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ডেকে এনে উস্কানিমূলক কর্মতৎপরতা সৃষ্টি করলে পুলিশ নির্বিচারে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বেধড়ক লাঠি চার্জ, জলকামান নিক্ষেপ ও অন্যান্যভাবে হামলা চালিয়ে অপমান-অপদস্ত করেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক অধিকার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বিতাড়ন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, চিকিত্সা সেবা, মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল, গৃহঋণসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া বিষয়ে আন্দোলন সংগ্রাম ও অন্যান্য পন্থা অবলম্বনের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদেরই সংগঠন রয়েছে। সেসব সংগঠনের কোনো কার্যক্রম বা প্রয়াসের সাথে তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্ম বিষয়ক সংগঠনকে কোনো সম্পৃক্ত হতে দেখা যায় না। মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও প্রজন্মের নামে যে যেমন করে পারছে, ব্যাঙ্কের ছাতার মতো সংগঠন তৈরি করতে গিয়ে প্রায় ৪০০ সংগঠনের জন্ম দিয়ে একেকজন 'গায়ে মানে না আপনি মোড়ল' সেজে নেতা নামে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে এধার-ওধার নানান ধান্দাবাজি করে বেড়ায়। গত কিছুকাল পূর্বে আমি উপযাজক হয়ে বেশকিছু সন্তান সংগঠনের সাথে ধারাবাহিক মতবিনিময় করে তাদেরকে একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরমে নিয়ে আসার প্রয়াস নিয়েছিলাম। আমার অভিজ্ঞতা হলো, নিজেরা কোনোকিছু না করতে পারলেও কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নয়। বিশেষ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিশাপ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদের ব্যাপারে এদের কারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এতেই বুঝা যায় 'ডালমে কুচ কালা হ্যায়'! এতে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যে, এদের অধিকাংশই বা যারা নেতৃত্বে আছে, তাদের সিংহভাগই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তান! আরো স্পষ্ট করে বলা যায় , এরা শতশত সংগঠনের নামে, একেঅপরের প্রতি প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে আসল বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সন্তানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে প্রকারান্তরে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ক্ষতিই করে চলেছে!

সম্প্রতি আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ৮ দফার একটা স্মারকলিপিতে সারাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গণস্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করার সময় দেখেছি ও বুঝেছি যে, বিশেষ করে "ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদ" দাবিটা থাকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়ার কারিগরদের পাশাপাশি কতিপয় তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংগঠন সেই গণস্বাক্ষর অভিযানের বিরোধিতা করেছিলো। তবে বিচ্ছিন্নভাবে স্বতস্ফূর্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় কিছু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সন্তান স্মারকলিপির স্বাক্ষর অভিযানে সহযোগিতা করেছিলো।

আসলে এরা কারা, কী এদের উদ্দেশ্য?

এর আগেও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, মুখে 'জয়বাংলা' ও 'জয় বঙ্গবন্ধু' শ্লোগান দিয়ে বুকে-মুখে রাজাকারের স্তুতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করে ঢাকার রাজপথে একদল বিভ্রান্ত ছাত্রসমাজ তাণ্ডবের হলাহল সৃষ্টি করেছিলো!
যার ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটাটি আমরা হারিয়েছি!

আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথ কেনো, গোটা দেশ কাঁপিয়ে দিতে পারি। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে দেশী-বিদেশী শক্তির সংমিশ্রণে এমনতর সব জটিল ও কুটিল বৈশিষ্ট্য ও ইস্যু বিরাজিত হয়ে আসছে, যার ফলে, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা সমাজের বড়ো ধরনের আন্দোলনের মুখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি বা সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এ-সমূহ সম্ভবনার কারণে আমরা বলা চলে মাটি কামড়ে রয়েছি। তবে আমরা সহনীয় পর্যায়ে থেকে আমাদের দাবির সপক্ষে আন্দোলনেই রয়েছি ।

সুতরাং যে কর্মসূচি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে খর্ব ও বিপদগ্রস্ত করে, তেমন বিধ্বংসী কর্মসূচি, বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত অপশক্তির চলমন সরকার ও দেশবিরোধী আন্দোলনের সাথে তাল মিলিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি আদায়ের আন্দোলন নিয়ে রাজপথে নামা কোনো চক্রান্তের সাথে হাত মেলানো কিনা, তা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখতে হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।