ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আজ শুক্রবার ১৭ জুন, বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস ২০২২। বাংলাদেশে প্রথম ১৯৯৫ সালে বিশ্ব মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। উত্তরাঞ্চলের রাজশাহীকে কেন্দ্রবিন্দু ধরে নগর থেকে ৪০ কি.মি পশ্চিমে কাকনহাটে জাতীয়ভাবে প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হয়।

১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের পক্ষ থেকে খরা ও মরুকরণের প্রতি সোচ্চার হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৭ সালে নাইরোবিতে বিশ্ব মরুকরণ বিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মলনের পরপরই মরুকরণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। রিও সম্মেলনের এজেন্ডা ২১ এর প্রস্তাবটি ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ৪৭তম অধিবেশনে গৃহীত হয় এবং ইন্টারগর্ভমেন্টাল নেগোশিয়েটিং কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি মরুকরণ সংক্রান্ত খসড়া কনভেনশন চূড়ান্ত করে।

১৯৯৪ সালের জুন মাসে কনভেনশনের দলিল চূড়ান্ত হয়। এই কনভেনশনে ৫০টি দেশ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর ১৯৯৬ সনের ২৬ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। বলা আবশ্যক যে, বাংলাদেশও এই কনভেনশন অনুমোদন করে। পরবর্তীতে খরা ও মরুকরণ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তুলতে ১৭ জুন পালন করা হয় বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস।

সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে বিশ্ব। প্রাকৃতিক দুর্যোগের নানা পরিবর্তনের মধ্যে জলবায়ুর কুপ্রভাবে বিশ্বে মরুকরণ একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা।

জাতিসংঘের এক গবেষণা বলছে, ২০ বছর পর মানবজাতির যাবতীয় চাহিদা অতিতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। সে সময়ে বর্তমানের প্রায় ৫০% বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হবে। জাতিসংঘ আশংকা করছে তখনকার চাহিদামতো প্রয়োজনীয় খাদ্য ও অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিয়ে সেটা সংকট সৃষ্টি করতে পারে। সেই সংকট গতি নিয়ে চলে যেতে পারে সংঘর্ষের দিকে। আর এই সংকটের একমাত্র কারন হবে মরুকরণ ও খরা।

ইতিমধ্যে বিশ্বের জলভূমির ৭০ শতাংশ মরুকবলিত হয়ে পড়েছে, যার পরিমাণ পৃথিবীর মোট ভূমির চার ভাগের এক ভাগ। নিষ্কাশনে অব্যবস্থা ও লবণাক্ততার কারণে সেচের আওতাধীন আবাদি জমির বিশাল অংশ অবক্ষয়ের সম্মুখীন। মরুকরণ ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য এক বিশাল হুমকি। এ জন্য মরুকরণ বিস্তার রোধ করা।

আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট গবেষক ডা.এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন...আজকের দুনিয়ায় পরিবেশের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে মরুকরণ অন্যতম। আর মরুকরণ ও খরা যেমনিভাবে বিশ্বব্যাপী মাথাব্যথার কারণ, তেমনি আমাদেরও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন আমাদের ফসলি জমি কমে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। একই সঙ্গে কমছে গাছপালা, বন-জঙ্গল। তার চেয়ে বড় বিষয়, আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য জলাধারের অবস্থাও সঙ্গিন। দিন দিন যেমন আমাদের ফসলি জমি কমছে, একই সঙ্গে খরায় উর্বরতা হারাচ্ছে জমি।আর মরুকরণের প্রধান দুটি ধাপ হচ্ছে- একটি বিস্তৃত এলাকা জুড়ে যদি সেখানকার মাটি অনুর্বর হতে থাকে এবং যদি নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বৃষ্টির অভাব ঘটে। আর বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ এ লক্ষণগুলো খুব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে কৃষিজমি সংরক্ষণ, কৃষিকাজে জৈব সার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিতকরণে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, নদীর পানি প্রবাহে যথাযথ উদ্যোগ, খাল-বিল ও জলাভ‚ মিসমূহ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ কথা ঠিক যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বিশ্বের অনেক দেশই বর্তমানে জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশে মরুকরণের ঝুঁকির বিষয়টি অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে। যদিও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার তহবিল গঠনসহ দুর্যোগ মোকাবিলার নানান উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু তার আগেও মরুকরণ রোধের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সেসবের ওপর জোর দেয়া জরুরি।

মানুষের জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় যোগ রয়েছে। ফলে প্রকৃতিকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করলে তা ধ্বংস ডেকে আনবে এটাই স্বাভাবিক। সার্বিকভাবে সেই পথেই হাঁটছে দেশ। যেমন কৃষি জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহার করায় সাময়িক উৎপাদনশীলতা বাড়লেও কৃষিজমির ঊর্বরতা শক্তি হ্রাস পাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে মাটির গুণাগুণ। অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে মারা যাচ্ছে উপকারী প্রাণী এবং দেশীয় জাতের মাছ। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের কৃষিজমি একদিন পুরোপুরি অনুর্বর হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে; যা মরুকরণ ঝুঁকির একটি প্রধান দিক। অপর ঝুঁকি হচ্ছে বৃষ্টিপাতের পানি ধরে রাখে যে জলাধারগুলো তাও বিপন্ন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমিতে যথেচ্ছভাবে কৃষিকাজ করার কারণে জলাভূমিগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার জলাভূমি দখল করে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা- জলাভূমি কমে যাওয়ার এটিও একটি কারণ। সরকারি তথ্যে দেশে মোট নদীর সংখ্যা ৩১০টি হলেও এরমধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীর সংখ্যা ১১৭টি। তীব্র নদীভাঙনের কারণে প্রতিবছর কোনো না কোনো নদীর শাখা ধীরে ধীরে পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে নদীমাতৃক বাংলাদেশ থেকে নদী হারিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ আছে। আসলে মানুষের অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড এবং রাষ্ট্রের উদাসীনতার কারণেই প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছি আমরা। সাধারণ হিসাবে গত ৪০ বছরে শুধু তিনটি প্রধান নদী- পদ্মা, মেঘনা, যমুনাতেই এ পর্যন্ত বিলীন হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমি। আর তার বিপরীতে নতুন ভূমি জেগেছে মাত্র ৩০ হাজার হেক্টর। প্রতিবছর কোনো-না-কোনো নদীর শাখা ধীরে ধীরে পলি পড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো নদী দখল হয়ে যাচ্ছে দখলকারীদের হাতে। পরিকল্পনার অভাবেই নদীমাতৃক বাংলাদেশ থেকে এভাবে নদী হারিয়ে যাচ্ছে।

২০২০ সালে ২০ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকায় আঘাত হেনেছিল। ২০০৪ সালে এ ঘূর্র্ণিঝড়ের নাম ‘আম্পান’ দিয়েছিল থাইল্যান্ড। ‘আম্পান’ শব্দের অর্থ ‘আকাশ’। কিন্তু এ আকাশ নামের ঘূর্ণিঝড়ই লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের ক্ষেতের ফসল, ঘড়বাড়ি আর তাদের লালিত স্বপ্ন।আর জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে প্রতিবছর বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে প্রায় দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকা মরুকরণ হচ্ছে। এটি সমগ্র বিশ্বের মানবগোষ্ঠীর জন্য একটি বিস্ময়কর সংবাদ। এ জন্য দায়ীও মানবকূল। পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়িয়ে দেয়ার নেপথ্য নায়ক ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো।

বড় বড় শিল্পকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ, নির্বিচারে বন উজাড়, নদীশাসন ইত্যাদির ফলে দারুণভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। মেরু অঞ্চলের বড় বড় বরফের চাঁই গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা একদিকে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে মরুকরণ হচ্ছে পর্যাপ্ত জলের অভাবে আরেক এলাকা। যার প্রধান শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া দুই মেরুর বরফ গলার ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ছাড়াও মালদ্বীপ, মুম্বাই, ইন্দোনেশিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ফিজি, মার্শাল আইল্যান্ড, মিসরের ব-দ্বীপ অঞ্চল, টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্ক ও ভিয়েতনামের উপকূলীয় শহর সমুদ্রে তলিয়ে যাবে- এমন আশঙ্কার তথ্য রয়েছে। এটা ঘটলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এর অর্থ দু’ভাবেই আক্রান্ত হবে বাংলাদেশ।

আমাদের দেশ যে সার্বিকভাবে মরুকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই যাচ্ছে, তা স্পষ্ট। ফলে এখন থেকেই আমাদের সচেতন হতে হবে। সতর্ক ও সচেতন হওয়া গেলে বিপর্যয় কিছুটা ঠে:কিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে। ফলে মরুকরণ রোধে জরুরি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব কারণে মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয় তা রোধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। নদ-নদী দখল কিংবা জলাশয় যেন কেউ ভরাট করতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি থাকা বাঞ্ছনীয়। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে করে বৃক্ষ নিধনসহ বন্যপ্রাণী নিধন বন্ধ করতে হবে। আর যেহেতু বনায়ন সৃষ্টি মানে মরুকরণের প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া, সেহেতু অধিকমাত্রায় বনায়ন করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে দেশের প্রতিটি নাগরিককেই ভাবতে হবে। অন্যদিকে অভিন্ন নদী-নদীগুলোর পানিপ্রবাহ যাতে ঠিক রাখা যায়, সে ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিতে হবে সঠিক উদ্যোগ।

সর্বজনবিদিত যে, ফারাক্কা বাঁধের ফলে পর্যাপ্ত পানি বাংলাদেশের নদ-নদীতে প্রবাহিত হতে পারছে না। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীও শুকিয়ে যাচ্ছে। এসবও মরুকরণের ধাপ। বলা যায়, এতে মরুকরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হচ্ছে। সুতরাং সরকারের কর্তব্য হওয়া দরকার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণসাপেক্ষে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া। সরকার এবং জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই মরুকরণ প্রতিরোধে সহায়ক হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।