সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : বাঁশ-বেত, ছন-খড়, হুগলাপাতা, তালপাতা-খেঁজুরপাতাসহ আধুনিক কালের প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য বা তৈজসপত্র তৈরির কথা শুনেছেন সবাই। কম-বেশী ব্যবহারেও অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু কচুরিপানার ডাটায় তৈরি করা নানা তৈজসপত্রের কথা শুনা যায়নি এতোদিন। সেইসব পণ্য আবার রপ্তানী হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার ৩০টিও দেশে। আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। কর্মসংস্থান তৈরি করেছে শত শত লোকের। সমৃদ্ধ হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। 

কচুরিপানা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের একটি পরিচিত জলজ উদ্ভিদ। নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুর ভরা থাকে এই কচুরিপানায়। যার ইংরেজি নামWater Hyacinths ওয়াটার হাইসিন্থস। বৈজ্ঞানিক নামEichhornia Crassipes এইছরনিয়া ক্র্যাসিপ্যাস। দেশের আনাচে কানাচে ব্যাপকহারে জন্মালেও এই উদ্ভিদটির জন্মভূমি কিন্তু এখানে নয়, ফুটবলের দেশ ব্রাজিলে। ধারণা করা হয় অর্কিড সদৃশ ফুলের সৌন্দর্যপ্রমিক এক ব্রাজিলীয় পর্যটক ১৮শ শতকের শেষভাগে বাংলায় কচুরিপানা নিয়ে আসেন। তারপর এটি এতো দ্রুত বাড়তে থাকে যে, ১৯২০ সালের মধ্যে বাংলার প্রতিটি জলাশয় কচুরিপানায় ভরে যায়।

দেশের বিভিন্ন এলাকায় আঞ্চলিক ভাষায় জারমনি, কচ্চা, কইচ্চা-ইত্যাদি নামে ডাকা হয় কচুরিপানাকে। জলে ঘের/বেড় দিয়ে মাছের আবাসস্থল তৈরি, জৈবসার, জৈবগ্যাস, আলু ও টমেটোর জমিতে ব্যবহার, গো-খাদ্য, জলশোধক, কাগজের মন্ড তৈরি ইত্যাদি কাজে কচুরিপানার ব্যাপক ব্যবহার হয়ে আসলেও তৈজসপত্র তৈরির কথা এতোদিন কেউ ভাবেননি।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের কিছু উদ্যোক্তা এক বছর যাবত এই অভাবনীয় কাজটিই করে যাচ্ছেন। উপজেলার ফরিদপুর, আলীনগর, আলালপুর, আহমদপুর, নলবাইদ, চরপাড়া, নাপিতেরচর, সালুয়া প্রভৃতি গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরকে প্রশিক্ষিত করে তাদের দিয়ে তৈরি করাচ্ছেন বিভিন্ন ধরণের দৃষ্টিনন্দন ও পরিবেশ বান্ধব তৈজসপত্র। উদ্যোক্তাদের দাবি, ওইসব তৈজসপত্র দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে রপ্তানী হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার ৩০টিরও বেশী দেশে। আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।

ওইসব দেশে পরিবেশ বন্ধব এই তৈজসপত্রের ব্যাপক চাহিদা থাকায় উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত গ্রামের মানুষদের প্রশিক্ষিত করে তৈরি করাচ্ছেন নানাপণ্য। এতে করে এই অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কচুরিপানার তৈরি এই কুটিরশিল্প। ফলে এক সময়ের জলজ জঞ্জাল হিসেবে পরিচিত কচুরিপানা এখন মূল্যবান সম্পদে পরিণত হয়েছে।

কিভাবে এবং কি কি তৈজসপত্র তৈরি হচ্ছে কচুরিপানায়: নদী-নালা, খাল-বিল থেকে প্রথমে কচুরিপানা কাটা হয়। পরে পাতা ফেলে কা- বা ডাটা রোদে শুকানো হয়। সেই শুকানো ডাটা ডিটারজেন পাউডার মেশানো গরম পানি দিয়ে ভালোভাবে পরিস্কার করা হয়। এরপর আবারও ভালোভাবে রোদে শুকানো হয়। ওই শুকনো ডাটা দিয়ে বাঁশ বা প্লাস্টিকের বেতের মতো করে বুনন করা হয় বিভিন্ন পণ্য। তবে যে পণ্যটি তৈরি হবে এর লোহার ফ্রেম আগে তৈরি করা হয় ওয়ার্কসপে। সেই ফ্রেমে কচুরিপানার ডাটার শৈল্পিক বুননে অববয় তৈরি হয় একেকটি তৈজসপত্রের।

বর্তমানে এখানে তৈরি হওয়া তৈজসপত্রের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আকারের ফল, ফুল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি রাখার ঝুঁড়ি, ফুলের টব, পাপস, কুকুর-বেড়াল, খরগোস থাকার ঘর, শিশুদের দোলনা, নানা প্রকারের ডালি, ফুল ও কলমদানি, ক্যাপ, মুড়া, টি-টেবিল ইত্যাদি।

উদ্যোক্তারা ফ্রেম ও কচুরিপানার ডাটা সরবরাহ করে থাকেন। কারিগররা পণ্যটি তৈরি করে দেন। পণ্যভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে মজুরি পেয়ে থাকেন কারিগররা। তবে অনেক ক্ষেত্রে নিজেরাও স্থানীয় ওয়ার্কসপ থেকে চিকন রডের ফ্রেম তৈরি ও কচুরিপানা ডাটা প্রস্তুত করে নানা তৈজসপত্র তৈরি করে থাকেন। সেইসব তৈজসপত্র উদ্যোক্তাদের কাছে নগদ টাকায় বিক্রি করে থাকেন। পণ্যভেদে প্রতিটি ৫০ থেকে ৫শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। এভাবে বিক্রি করলে মজুরির চেয়ে একটু বেশী আর্থিক সুবিধা পাওয়া যায় বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

নারীরা ঘর-সংসারের কাজ-কর্ম করে এবং শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ফাঁকে এইসব পণ্য তৈরির কাজ করে মাসে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে পারেন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশী হলে রোজগারের পরিমাণও বেড়ে যায়।

বিগত এক বছর যাবত এই শিল্পকর্মে জড়িত হয়ে এখানকার বহু মানুষ আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হয়েছেন বলে জানালেন উপজেলার নলবাইদ গ্রামের সোহানা, সাদ্দাম ও জীবন মিয়া। ফরিদপুর গ্রামের দেলোয়ারা, নাদিরা ও আরিফ মিয়া। আলীনগরের রেহেনা, জাকির হোসেন ও রিক্তা বেগম। আহমদপুরের সুফিয়া বেগম, আলম মিয়া।
উদ্যোক্তা জাকির হোসেন, রবিউল্লাহ ও রফিক মিয়া জানান, এক বছর আগে তারা একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে সাভার/গাজীপুর এলাকা থেকে নিজেরা এইসব পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে নিজ নিজ গ্রামে এসে ২১ দিন ব্যাপী বিভিন্ন বয়সী কয়েকশ নারীকে প্রশিক্ষিত করে তুলেন। পরে প্রশিক্ষিত ওইসব নারীদের কাছ থেকে তাদের পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশীরা কাজ শিখে এই কাজের সাথে জড়িত হন।

তারা আরও জানান, কারিগরদের তৈরি তৈজসপত্রগুলি তারা বাড়ি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে শ্রমিক দিয়ে কাটিং করে মসৃন করান। পরে পণ্যগুলিতে বাহারি রং দিয়ে সৌন্দর্যম-িত করে কার্টুনে ভরে প্যাকেটজাত করে ঢাকা, গাজীপুর, টঙ্গি, উত্তরায় তাদের নিজেদের নির্ধারিত অফিসে সরবরাহ করেন। সেখান থেকে পণ্যগুলি রপ্তানী হয় বিভিন্ন দেশে।
রপ্তানী করা দেশগুলিতে কচুরিপানায় তৈরি এইসব তৈজসপত্রের প্রচুর চাহিদার কথা জানিয়ে তারা জানান, তারা তাদের এই অঞ্চলে এই কাজের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে গ্রামের মানুষের অস্বচ্ছল পরিবারের ফিরছে স্বচ্ছলতা। শিল্পকর্মটি দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে বহুলোকের কর্মসংস্থান তৈরিসহ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

এদিকে স্থানীয় লোকজন কচুরিপানা দিয়ে তৈরি এই কুটিরশিল্পকে অত্যান্ত ইতিবাচক হিসেবে আখ্যা দিয়ে জানান, যেহেতু নদী মাতৃক বাংলাদেশে কচুরিপানা খুবই সহজলভ্য। যেটি বিনে পয়সায় পাওয়া যায়। আর সহজলভ্য ও বিনে পয়সার দ্রব্যকে কাঁচামাল হিসেবে গ্রহণ করে তৈরি করা এই রপ্তানীমূখি শিল্পটি দারিদ্রতা দূরীকরণসহ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখবে। এই অঞ্চলের মতো দেশের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশ সমৃদ্ধ হবে।
স্থানীয় বাসিন্দারাও এই কুটিরশিল্পটি নিয়ে বেশ আশাবাদী। এই নিয়ে কথা হয় ফরিদপুর গ্রামের মো. হুমায়ূন কবির, আনন্দ বাজারের মো. সাইফুল ইসলাম, নাপিতেরচর এলাকার মো. খালেদ মিয়ার সাথে। তারা জানান, নদীমাতৃক বাংলাদেশে কচুরিপানা একটি সহজলভ্য ও বিনে পয়সার একটি পণ্য।

সেটিকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে তৈরি করা এই শিল্পকর্মটি অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে দিতে পারলে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে এটি। এ ছাড়া পরিবেশ ও মাটির উর্বরা শক্তির জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক সামগ্রীর বিকল্প হিসেবে দেশের মানুষও এইসব পণ্য ব্যবহার করে উপকৃত হতে পারেন। এই শিল্পটির প্রসারে তারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাশা করেন।

(এস/এসপি/জুন ১৯, ২০২২)