চৌধুরী আবদুল হান্নান


ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যারা সময় মতো পরিশোধ করেন তারা বোকা মানুষ। ঋণ পরিশোধ না করলেকিছু হয় না, কি ই বা হবে? ঋণখেলাপির খাতায় নাম উঠবে? উঠুক ।তাতেই বা কি আসে যায়! খেলাপিহলে ঋণ পুন:তফসিল হবে। তারপর আবারও খেলাপি হবে, মান-সম্মানের ঘাটতি হবে ? টাকা থাকলেমান-সম্মানও থাকে, কোনো ঘাটতি হয় না।

এক সময় মামলা হবে, হোক ।মামলা চলবে ১০ বছর, এক সময় ঋণ অবলোপন হবে অর্থাৎ ব্যাংকেরএক খাতা থেকে তার নাম বাদ দিয়ে অন্য একটি নতুন খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখা হবে এবং এইঅবলোপনকৃত ঋণকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হিসেবেও দেখানো হয় না।

ব্যাংকের রুগ্নতা ঢাকতে কি সুন্দর কায়দা! ব্যাংকের ঋণ অবলোপন করে তা খেলাপি হিসেবে না দেখানো একটি বড় ধরনের প্রতারণা বলে মনেকরেন ব্যাংক খাতের অনেক বিশেষজ্ঞ।

আপনার আরও টাকা দরকার ? কোনো অসুবিধা নেই ।আবার ব্যাংকে যান, খেলাপি আছেন তো কিহয়েছে ? আপনার একজন একান্ত অনুগত কোনো ব্যক্তিকে বেছে নিন, তাঁর নামে একটি ঋণ প্রস্তাব তৈরিকরে ব্যাংকে জমা দিয়ে পিছনে লেগে থাকুন।

একটু দৌড়ঝাপ আর কিছু খরচপাতি; এ অভ্যাস তো আপনার রপ্ত করাই আছে। টাকার তো এখনআপনার অভাব নেই, এবার কৈ এর তেলে কৈ ভাজুন! ঋণের উপকারভোগী হবেন আপনি আর ঋণের দায় বহন করবে অন্য একজন।

টাকায় সব হয়, হোক সে টাকা বৈধ বা অবৈধ ।অর্থের ক্ষমতা, দাপটে সমাজের উঁচু স্তরে আপনারবিচরণ, ঋণখেলাপি তো আর গায়ে লেখা থাকে না ।

এক সময় আপনি ব্যাংকের পিছনে দৌড়িয়েছেন, এখন ব্যাংক আপনার পিছনে দৌড়ায়, ব্যাংকের এদৌড় এক ম্যারাথন দৌড়!

একটি ব্যাংক তো অনিয়ম, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎসহ এমন সব অপকর্ম করলো যে, ব্যাংকটির প্রতি জনগণের আস্থা-বিশ্বাস উঠে গেল ।বাধ্য হয়ে ব্যাংকটির নামই পাল্টে দিয়ে নতুন নামে আবারযাত্রা শুরু করলো ।কিন্ত সেই ব্যাংকটিতেই একই কাজ আবার শুরু হয়েছে, ১৩ জুনের সমকালে প্রকাশ “অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ১২ প্রতিষ্ঠানের নথি তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন” । সেখানে অর্থআত্মসাৎ ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন সময়ের খবরের কাগজ থেকে ধারণা জন্মে ওই ব্যাংকটিকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্যদায়ী মূলত একজন উদ্যোক্তা পরিচালক এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মো মাহবুবুল হক চিশতী ( বাবুল চিশতী ) যিনি অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন।

এখন প্রশ্ন— “চিনিলো কেমনে ? ” এমন “উপযুক্ত” ব্যক্তিকে খুঁজে বের করলো কে ? সিনেমা হলের সহকারী হিসেবে জীবনে চাকুরি শুরু করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থরোজগারের হাতেখড়ি যার তিনিই এক সময় ব্যাংক মালিক হওয়ার কাহিনী বড়ই চমকপ্রদ। তিনি কেবলব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালকই নন, অডিট কমিটির দায়িত্বও তার ।অডিটের মূল কাজই তো ব্যাংকেসংঘটিত অনিয়ম, দুর্নীতি চিহ্নিত করে তা সংশোধন করার ব্যবস্হা করা। যে অপকর্ম তার প্রতিরোধকরার কথা, সেই কাজটিই তিনি করেছেন। শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা !

ধারণা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, বাবুল চিশতী নামে মাত্র, ব্যক্তি স্বার্থে কোনো সুদূরপ্রসারীপরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাকে বেছে নেওয়া হয়ে থাকতে পারে।

সরকার চায় না কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাক, অব্যবস্থার কারণে কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পড়লে, মাঝে মাঝে সরকার তা পূরণ করে দেয় ।তাতে ব্যাংকটি সচল থাকে বটে কিন্ত নিজের পায়ে দাঁড়ানোরসক্ষমতা হারাতে থাকে।

সংকটে পড়ে কয়েকজন গ্রাহকের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সাবেক ফারমার্স ব্যাংককে বিশেষ ব্যবস্হায়স্বল্প সময়ের জন্য ৯৬ কোটি টাকা ধার হিসেবে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক (সমকাল ২২/১১/১৭ ইং)।

কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে আরও “বাবুল চিশতী” রয়েছেন কিনা তা দেখার জন্য এখনইচিরুনি তল্লাশি করা প্রয়োজন। পূর্বাহ্নে সতর্ক না হলে, হঠাৎ করে গভীর খাদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাথেকেই যায়। ব্যাংক ডুবলে মালিকের কিছু হয় না কিন্ত আমনতকারীদের মাথায় হাত।

খেলাপিরা যে পয়সায় ঝলমলে বিলাসী জীবন যাপন করেন, সে অর্থ তাদের অর্জিত নয় বরংযোগসাজশে কারসাজির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বের করে নেওয়া । ঋণের নামে নেওয়া যে অর্থ ফেরত দিতেহয় না, সে অর্থের ক্ষমতা, দাপট ব্যাপক যার অভিঘাতে নাগরিকেরা পর্যুদস্ত।

বেপরোয়া দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাপী ব্যাংক অবলুপ্তির ঘটনা কম নয় । একজন পাকিস্তানি ব্যাংকার আগা হাসান আবেদী প্রতিষ্ঠিত বিশ্বপরিচিত প্রাইভেট ব্যাংক বিসিসিআইএক সময় ৭৮টি দেশে ৪০০ এর মতো শাখা নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতো। মালিক পক্ষেরসীমাহীন অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির কারণে কীভাবে ব্যাংকটির অবলুপ্তি ঘটেছিল তা বেশি দিনেরপুরানো ঘটনা নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এখনই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যাংক ব্যবস্থাকে কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় নাআনতে পারে , তা হলে ইতোমধ্যে ভিতরে ভিতরে রুগ্ন হয়ে যাওয়া কোনো কোনো ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকেরভাগ্য বরণ করতে হবে না , তা বলা যায় না ।

ব্যাংক খাতের রুগ্নতা দূরীকরণে বিশেষজ্ঞগণ নানা পরামর্শ দিয়েছেন কিন্ত কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। তবে এ রোগের অব্যর্থ ঔষধ ঘরেই রয়েছে, তা কেবল প্রয়োগ করতে হবে ।

ব্যাংকে কর্মরত দজ্ঞ, যোগ্য, সৎ কর্মকর্তাগণ বর্তমানে কোনঠাসা হয়ে আছেন, অনেকে কর্তৃপক্ষেরঅনৈতিক নির্দেশ অবলীলায় মেনে না নেওয়ার জন্য শাস্তি ভোগ করছেন, দূর দূরান্তে বদলি হয়েছেন, তাদের সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তাতে ব্যাংকের অভ্যন্তরেই অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে একটি শক্তি তৈরি হবে। ব্যাংক সমূহের রুগ্নদশাউপশমে এটাই হতে পারে প্রাথমিক চিকিৎসা।

ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যাংক কমিশন গঠন, পর্যবেক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি চিন্তা করার আগে ব্যাংকের বিদ্যমান বিধিবিধান কার্যকর প্রয়োগ করা এবং প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সফল প্রয়োগের মাধ্যমে সুফল পাওয়া যাবে, তাতে সন্দেহ নেই ।

সর্বোপরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারির মধ্যেই নিহীত রয়েছে ব্যাংক খাতের সুশাসন ও সচ্ছতা ।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।