ইমরান হোসাইন


বেকার জীবন একটা হতাশার জীবন। যতই দিন যাচ্ছে, বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বেকারত্ব বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। বেকারত্বের কারণে দেশের লাখ লাখ  তরুণ আজ হতাশায় জীবন কাটাচ্ছে। পড়াশোনা করেও যখন চাকরি পাচ্ছে না, তখন তারা পথ হারিয়ে ফেলছে। সহসা যখন এ সমস্যা থেকে মুক্তি মিলছে না তখন কেউ কেউ বেকারত্ব থেকে মুক্তির আশায় বিভিন্ন অবৈধ পন্থা অবলম্বন করছেন। কেউ বা আবার অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দিতেও পিছপা হচ্ছেন না। কেউ কেউ তো বেকারত্বের চাপ সামলাতে না পেরে আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছেন,তবুও যেন বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়! বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ এর হিসাব বলছে, দেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তির মোট পরিমাণ ৫ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে ৫ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার জন। এর অর্থ বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ ৮০ হাজার।

আমাদের দেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দুইজনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশ বেকারের দিক থেকে দ্বিতীয় সেই চিত্র উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে। আইএলওর হিসাবটিকেই পর্যবেক্ষকেরা বাংলাদেশের প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বলে মনে করেন।

হাজার হাজার তরুণরা স্বপ্ন নিয়ে পথ চলছে, কিন্তু তারা পথের দেখা পাচ্ছে না। বুকে হাজারো কষ্ট নিয়ে পরিবারে দিকে তাকিয়ে পথ চলছে। শিক্ষিত তরুণরা দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু শিক্ষিত তরুণরা তো দেশের বোঝা নয়, তারা দেশের সম্পদ। বেকার নারী-পুরুষ পাগলের মত হয়ে চাকুরি খুঁজছেন, কিন্তু তারা পাচ্ছেন না। পরিবারের মা-বাবা হয়তো পড়াশোনা শেষ করা ছেলে কিংবা মেয়েটির পথ চেয়ে বসে আছে, কখন সেই বেকার মানুষটি পরিবারে দিকে তাকাবে, সচ্ছলতা ফিরে আনবে ও তাদের পাশে দাড়াবে , এটাই স্বাভাবিক বিষয় । কিন্তু একজন বেকারের নীরব যন্ত্রণা কেউ অনুভব করে না, কেউ বোঝে না তাদের মনের কথা। তাদের চোখের জল দেখবার মত কেউ নাই। দরিদ্রতা, স্বজনপ্রীতি, নড়বড়ে শিক্ষাববস্থা, ও সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে মূলত বেকারত্ব তৈরি হচ্ছে। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু বেকারত্বের হার কোন ভাবেই কমছে না বরং বাড়ছে । আর এতেই লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণদের বেকারের যন্ত্রণা বেড়েই চলছে। দেশে কাজ না পেয়ে বিদেশে কাজের আশায় এ দেশের তরুণরা প্রবাসী জীবন বেছে নিচ্ছে, বাবার শেষ সম্পদটুকু বিক্রয় করে। ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যাবার সময় অনেকে মৃত্যু বরণ করছে। পৌঁছাতে পারলেও অনেক সময় কাজ পাচ্ছে না তারা। এ যেন মরা উপর খরার ঘা। বেকারত্বের কারণে বিগত বছর গুলোতে অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।

আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে বলা হয়েছিল, ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের, ২৭ জন কলেজের, ৭৩ জন স্কুলের ও ৯ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। এর আগে ২০১৮ সালে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১১ জন এবং ২০১৭ সালে ১৯ জন। এত সংখ্যক আত্মাহত্যার পেছনে যেসব প্রধান কারণ দেখা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে- পড়াশোনার চাপ, বেকার সমস্যা, বৈবাহিক সমস্যা, প্রেমে ব্যর্থতা, মানসিক নির্যাতন, পারিবারিক সমস্যা, অবসাদ ও বিষন্নতা। এ ছাড়াও ব্যক্তি বিশেষে নানা কারণ রয়েছে। এমনি কি জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম নয়। আর্থসামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক সংকটের কারণেও বেকার জীবন হয়ে ওঠে অসহ্য যন্ত্রণাময়। পরিবারে চাপ ও সমাজের অবহেলায় তরুণেরা আজ মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ ও হেনস্তার শিকার । প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে আর কত দিন চলবে? এই ভাবে ভেঙ্গে যাবে আর কত স্বপ্ন! বেকারত্ব থেকে কি মুক্তির কোনো পথ নেই? থাকলে সেই পথে অগ্রসর হওয়া উচিত। দেশের উন্নয়নের সাথে তরুণদের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। যে দেশের তরুণরা যত বেশি কর্মঠ, সে দেশ উন্নয়নের ধারায় ততবেশি অগ্রসর। আমাদের দেশের বেকার যুবকদের সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ত্বরায়ন করতে পারে । তবে সেটি নির্ভর করছে বয়স-কাঠামোর পরিবর্তনে জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও সুশাসন নিশ্চিতকরণের ওপর। তাই রাষ্ট্রের বেকারদের নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন করা। দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা দরকার বেকার যুবকদের। যুবকদের হাতিয়ারকে যেভাবে রাষ্ট্র ব্যবহার করবে সেভাবেই কাজ করবেন তারা। যুবসমাজের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সরকারের আরো আন্তরিক হতে হবে। তাই দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে হলেও বেকারত্ব দুরীকরণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কেননা দেশের বেকারত্বের হার কমলে দেশ আর উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। তাই সরকার, প্রশাসন থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি চাওয়া থাকবে দেশের কথা চিন্তা করে, দেশের তরুণ-যুবকদের কথা ভেবে এই বেকারত্ব সমস্যা দূরীকরণে পদক্ষেপ নিন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী