দেবেশ চন্দ্র সান্যাল


সিরাজগঞ্জ জেলার (মহান মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময় অর্থাৎ ১৯৭১ সালে গ্রামটি ছিল পাবনা জেলার) শাহজাদপুর উপজেলার (তদানীন্তন শাহজাদপুর থানার) হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নাধীন (তদানীন্তন শাহজাদপুর ইউনিয়নাধীন) রতন কান্দি একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এই গ্রামের পাশদিয়ে প্রবাহিত হয়েছে করতোয়া নদী। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত রয়েছে এই গ্রামে। আদি কাল থেকে হিন্দু মুসলমান মিলে মিশে বসবাস করে এই গ্রামে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোন হিংসা বিদ্বেশ নাই। একজন হিন্দু যদি একজন মুসলমানকে দাদা বলে ডাকে তার ছেলেকে ডাকে চাচা বলে। একজন হিন্দু যদি একজন মুসলমানকে নানা বলে ডাকে তাহলে তার ছেলেকে ডাকে মামা বলে। এ যেন পারিবারিক সম্পর্কের অটুট বন্ধন। ধর্ম যার যার উৎসব সবার আদর্শে মিলে মিশে বসবাস করে এই গ্রামের হিন্দু মুসলমানেরা। 

আদিকাল থেকে কখনও দাঙ্গা বা হিংসা-হিংসী হয় নাই। সারা বিশ্বের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ যেন একটি অনন্য গ্রাম। ১৯৭১ সাল। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে দেশে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ দল সৃষ্টি হলো। সারাদেশের কিছু গ্রামে হিন্দু মুসলমান দন্দ্ব সৃষ্টি হলো। সারাদেশের সামান্য কিছু মুসলমান হিন্দুদেরকে ভারতের দালাল বললো, তাদের বাড়ি ঘর লুট তরাজ করলো, পাকিস্তানি হায়েনাদের পক্ষ নিয়ে পীচ কমিটি, রাজাকার ও অন্যান্য হলো। কিন্তু ব্যতিক্রম এই গ্রামের মুসলমান। এই গ্রামের একজন মানুষও দেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষ অবলম্বন করেন নাই। এই গ্রামের ৫ জন ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ছিলেন।

তাঁরা হলেন (১) এস.এম রেজাউল করিম হেলাল, (২) এস.এম ফজলুল করিম দুলাল, (৩) মোঃ আব্দুস ছাত্তার প্রমানিক, (৪) মোঃ শামসুল হক ও (৫) কিশোর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। এই গ্রামের ৮ জন স্থানীয় ভাবে প্রশিক্ষন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে ছিলেন। (১) ডাঃ মোঃ খলিলুর রহমান, (২) মোঃ নজরুল ইসলাম, (৩) মোঃ ইমান আলী, (৪) মোঃ আনোয়ার হোসেন মোল্লা, (৫) মোঃ আব্দুল হামিদ (৬) মোঃ মোজাম্মেল হক সরকার, (৭) মোঃ আব্দুল মজিদ সরকার ও (৮) সমরেন্দ্র নাম সান্যাল (ভবেশ)। আমাদের গ্রামের মোঃ রস্তম সরদার বিয়ে করেছিলেন বেড়া উপজেলার পেচাকোলা গ্রামে। গ্রামের সম্পর্কে আমার মাতৃদেবী মোঃ রস্তম সরদারের স্ত্রীকে পিসি বলতেন। আমরা নানী বলতাম। তাঁর মেয়েদেরকে মাসী ও ছেলেদেরকে মামা বলি।

ডাঃ জয়নুল আবেদিন সরকারকে দাদা এবং তার স্ত্রীকে দাদি বলে ডাকতাম। তাঁর ছেলেদেরকে চাচা ও মেয়েদেরকে ফুফু বলে ডাকি। তার নাতিকে আমরা মামা বলি। তারাও আমাদেরকে মামা বলে ডাকেন। মোঃ তাহাজ উদ্দিন সরকারের স্ত্রীকে আমরা নানী বলতাম। তিনি আম, কাঠালের দিনে আমাদের বাড়িতে আমা, কাঠাল পাঠাতেন। তাঁর ছেলেদেরকে আমরা মামা বলি। তারাও আমাদেরকে কে মামা বলেন। কারো সাথে নির্দিষ্ট সম্পর্ক না থাকলেও পরস্পর ভাই ভাই সম্পর্ক হিসেবে সম্মোধন করে থাকি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের গ্রামের হিন্দুদের কোন প্রকার ক্ষতি হয় নাই। মুসলমানেরা রাত জেগে হিন্দুদের বাড়ি পাহাড়া দিতেন।

কোন কোন রাত্রিতে আমরা মুসলমানদের বাড়িতে আশ্রয় নিতাম। মুসলমান নারী পুরুষেরা বাহিরে অবস্থান করে আমাদেরকে ঘরের মধ্যে আশ্রয় দিতেন। আমাদের গ্রামের অনেক হিন্দু তাদের স্বর্ণালঙ্কার, থালা-বাসন, ঘি ও অন্যান্য মুল্যবান সামগ্রী তাদের বাড়িতে জিম্বা রেখে ছিলেন। স্বাধীনতার পর জামিনদারগন সব কিছু অক্ষুন্ন অবস্থায় ফেরত দিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামের কিছু মুসলমান জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছিলেন। প্রত্যেকটি মুসলমান মানবীয়গুণ সম্পন্ন, ধার্মিক ও অসম্প্রাদায়িক চেতনার মানুষ। বর্তমানে কিছু মুসলমান জামায়াতে ইসলাম ও অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতা/কর্মী আছেন। কিন্তু তাড়া খুব ভাল এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। আমরা হিন্দু-মুসলমান মিলে মিশে এই গ্রামে শান্তিতে বসবাস করছি।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা।