ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


শোকাবহ আগস্টের ৪র্থ দিন বৃহস্পতিবার  । ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। 

শেখ মুজিবুর রহমান কেবল একজন ব্যক্তির নাম নয়, তিনি নিজেই এক অনন্যসাধারণ ব্যতিক্রমী ইতিহাস। সমাজ, দেশ ও কালের প্রেক্ষাপটে তিনি ব্যক্তি মুজিব থেকে হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক নেতা থেকে হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহানায়ক।

দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের নেপথ্যের কারিগর বঙ্গবন্ধুর ডাকেই সমগ্র বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে। তার হাত ধরেই ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে প্রথমবারের মতো অঙ্কিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে তার নাম লেখা হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিরূপে।

কিন্তু স্বাধীনতার কয়েক বছর পর একদল অকৃতজ্ঞ বাঙালি নৃশংসভাবে হত্যা করে জাতির পিতাকে। ১৯৭৫ সালের এ মাসেই বাঙালি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

এদিন ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল এবং পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালসহ পরিবারের ১৭ জন।

১৫ আগস্টের কালরাতের পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া, ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ৪৬ বছর পেরিয়ে গেছে। আজও বাঙালি জাতি পদে পদে বঙ্গবন্ধুর অভাব অনুভব করে। বাঙালির প্রতিটি অর্জনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে।

আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা.এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন.. আগস্ট এলেই বাঙালি-হৃদয়ে নেমে আসে শোকের আঁধার। গোটা মাসটিই যেনো ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। আগস্ট এলেই শ্রাবণের এক অনিঃশেষ করুণ-ধারা যেনো ছুঁয়ে যায় বাঙালি-আত্মাকে। এ-মাসের বেদনার্ত আর্তি কালকে ছাপিয়ে মহাকাল, সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে গোটা বিশ্ব বিবেককে স্তম্ভিত করেছে! একদিকে বাংলাদেশবিরোধী দেশী-বিদেশী ঘাতকচক্রের সুপরিকল্পিত মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞ বা হত্যা-নকশা, অন্যদিকে ‘নিয়তি’ বা ‘ভাগ্য’ নির্ধারিত বিয়োগান্তুক ঘটনা; সব মিলিয়ে আগস্ট যেনো শোকের শ্রাবণধারা।

আগস্ট মাসটির নাম উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে বাঙালি-হৃদয় যন্ত্রণাদগ্ধ হয়, শোকে মুহ্যমান হয় বাঙালি-আত্মা। হৃদয়পটে ভেসে ওঠে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আরও হত্যা করা হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ আবু নাসের, শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তসত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি, সুকান্ত আবদুল্লাহ, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত।

শুধু বাঙালি জাতির ইতিহাসে নয়, গোটা বিশ্ব ইতিহাস তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও এমন নজিরবিহীন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড দ্বিতীয়টি আর খুঁজে পাওয়া কঠিন। আগস্টকে ঘাতকরা তাদের নিষ্ঠুর টার্গেটের মাস হিসেবে বেছে নিয়েছে বারবার।

১৯৭৫ সালের এ মাসে যেমন বাঙালি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তেমনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড ছুঁড়ে হত্যা-চেষ্টা করা হয়েছিল জাতির জনকের কন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ভাগ্যক্রমে সেদিন তিনি বেঁচে গেলেও এই ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী, আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত এবং পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী মারাত্মকভাবে আহত হন। ওই দেশবিরোধী ঘাতকচক্র ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে দেশব্যাপী একযোগে ৬৩টি জেলায় সিরিজ ৫০০ বোমা হামলা চালিয়ে প্রিয় এই মাতৃভূমিকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছিল।

১৯৪১ সালের আগস্ট মাসের ৭ তারিখ (বাংলা ২২ শে শ্রাবণ) আমরা হারিয়েছিলাম বাঙালি জাতির আত্মছবি আঁকার নিপুণ কারিগর, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম সাম্য-দ্রোহ-প্রেমের কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমানকে। ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুদিন।

১৯৭১ এর ২০ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে। ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম কবি সিকান্দার আবু জাফরকে। ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম গীতি কবি অতুল প্রসাদ সেনকে। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট আমরা হারিয়েছিলাম বিপ্লবের প্রেরণা ক্ষুধিরাম বসুকে। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট বাংলাদেশের সুস্থধারার চলচ্চিত্রের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ এবং বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক ও চিত্রনির্দেশক মিশুক মুনিরকে আমরা হারিয়েছিলাম।আরও কতো কতো গুণীজনকে আমরা এ মাসে যে হারিয়েছি তা একটু গবেষণা করলে সহজেই বের হয়ে আসবে।

আগস্টে এমন মৃত্যুগুলো আমাদেরকে অশ্রুসজল করে তোলে। এই আগস্ট মাসেই ওইসব বিখ্যাত বাঙালিদের মৃত্যু ছিলো যেনো নিয়তি নির্ধারিত! সহমর্মিতা প্রকাশ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রতিবেশীর ওপর শোকের কালো আঁধার নেমে এলে কোনও সুস্থ, বিবেকবোধ-সম্পন্ন মানুষ সুখ-সাগরে ভাসতে পারে না, উল্লাসে ফেটে পড়তে পারে না। বরং শোক সন্তপ্ত প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ানো, শোকাহত প্রতিবেশীর সাথে একাত্ম হয়ে শোককে ভাগাভাগি করে নেওয়াটাই মানবিকতা ও মনুষত্বের পরিচয়। এটাই আমাদের সামাজিক, মানবিক রীতি। এমনকি, চরম শত্রুর মহাবিপদের দিনে, মহাদুর্দিনে বা শোকের দিনে আমরা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠি না। কোনও শ্রেণিকক্ষ থেকে আমাদের এই শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়নি। আমাদের পরিবার-পরিবেশ-প্রতিবেশ আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে। এর ব্যত্যয় মানে সমাজ ও মানুষের প্রতি অস্বাভাবিক, অসুস্থ, বিকৃত আচরণ।

খালেদা জিয়া পৃথিবীর একমাত্র নারী, যিনি ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৯; এই কয় বছরের মধ্যে পাঁচবার জন্মগ্রহণ করেছেন! কাউকে হেয় করার জন্য বা কাউকে ছোট করার জন্য এ তথ্যটি নয়। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাগজপত্র এবং সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন রিপোর্টে সেই তথ্যগুলো উঠে এসেছে।

আসুন খালেদা জিয়ার জন্মদিন সমাচার সম্পর্কে জানি- ১৯৮৪ সালে খালেদা জিয়ার বাবা এস্কান্দার মজুমদার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন আমার তৃতীয় মেয়ে হচ্ছে খালেদা। খালেদার জন্ম ১৯৪৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, একটি ঐতিহাসিক দিনে, যেদিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ, দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সরকারি সংবাদ সংস্থা- বাসস থেকে পাঠানো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জীবনী ছাপা হয়।

ওই জীবনীতে উল্লেখ করা হয়, খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৫ সালের ১৯ আগস্ট। মেট্রিক পরীক্ষার মার্কশিট অনুসারে খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। বিয়ের কাবিন নামা অনুসারে খালেদা জিয়ার জন্মদিন ১৯৪৪ সালের ৯ আগস্ট। ২০০০ সালের ভোটারের তথ্য বিবরণী ফরমে খালেদা জিয়া উল্লেখ করেন যে, তার জন্মদিন ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট!

খালেদা জিয়ার এতোগুলো জন্মতারিখ ও সাল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় জন্মসাল বদলিয়েছেন বয়স কমানোর জন্য। বিয়ের কাবিনে জন্মসাল ও মাস বদলিয়েছেন বয়স বাড়িয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি আইন সিদ্ধ করার জন্য। জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মসাল এবং তারিখ বদলিয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোসহ কটাক্ষ হানার জন্য।

পরিশেষে বলতে চাই, ৭৫-এর ১৫ আগস্ট নরপিশাচ রূপি খুনিরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ঘৃণ্য ইনডেমনিটি আইন জারি করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে দীর্ঘ ২১ বছর বাঙালি জাতি বিচারহীনতার কলঙ্ককের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়।

১৯৯৬ সালে জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে ২১ বছরের কলঙ্ক মুছনে বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১০ সালে ঘাতকদের কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতিকে কলঙ্ক মুক্ত করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শোকাবহ আগস্টে সমগ্র জাতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ যথাযোগ্য মর্যাদা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভাবগম্ভীর আর বেদনাবিধূঁর পরিবেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতীয় শোক দিবস পালন করবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।