নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে ইসির সাথে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলের সাথে ইসি কর্তৃক আয়োজিত সংলাপ। কি পেলাম আর কি পেলাম না সে বিষয়ে পরে কথা বলা যাবে। আগে দেখা যাক সংলাপ কেমন হলো ? মোট কথা হলো সংলাপ সকল দ্বন্ধ অবসানের একটা জায়গা যদি সেটা হয় আন্তরিকতাপূর্ণ এবং থাকে সেক্রিফাইসের মনোভাব। সংলাপের মাধ্যমে মতবিরোধের অবসান ঘটানো সম্ভব। সারা বছর কোন গণতন্ত্র না থাকলেও নির্বাচনের সময় গণতন্ত্রেও কথা বলে অস্থির হয়ে যাই তখন দেখা যায় কাঠগড়ায় ইসি। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৩তম প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব থান সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমানকে নিয়ে কমিশন গঠন করা হয়। সার্চ কমিটির দেওয়া নামের ভিত্তিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগ প্রদান করেন।

এ নিয়োগের পর থেকে বুঝে অথবা না বুঝেই চলছে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা। সরকারি দলের প্রতি বিরোধী দলের আস্থাহীনতা এবং যেততেনভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছে বারবারই প্রশ্নবিদ্ধ করছে আমাদের ইসিকে। কোন দলই ইসির অবস্থান শক্তিশালী করতে পারেনি বা করেনি নিজের স্বার্থে। মোটামুটি বলা চলে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই ইসিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সাংবিধানিকভাবে ইসিকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হলেও বাস্তব অর্থে ইসির পক্ষে সরকারের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন ছাড়া একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া কখনও সম্ভব নয়। মজার বিষয় হলো যখন যেদলই ক্ষমতায় থেকেছে তারা নির্বাচন কমিশনকে স্বচ্ছ বলে দাবী করেছে এবং বিরোধী দলের সকলকে দাবীকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছে। বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বর্তমান সরকারী দল আওয়ামীলীগ যে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে সে কথা রাজনৈতিক ইতিহাসে লেখা থাকবে অন্যদিকে তখনকার সরকারী দল বিএনপি এর বিপক্ষে অপবস্থান নিয়েছিল তা কারো অজানা নয়।

আজকে এনসব ইতিহাসের বিপরীতে অবস্থান দুদলের। শুধু পরিবর্তন হয়েছে সময় ও ক্ষমতার। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়েও সবসময় চলে আসছে না মানার সংস্কৃতি। যদি বর্তমান সরকার সংবিধানের আলোকে তড়িঘড়ি করে একটা আইন তৈরি করেছে যার ভিত্তিতে বর্তমান কমিশন নিয়োগ করা হয়েছে। আমরা দেখছি যখন কমিশন নিয়োগের আলাপ হয় তখনই বলা কমিশনাররা সরকারি দলের কিন্তু এদের দ্বারাই আবার অভিযোগকারীরা বিজয়ী হয়ে আসছে। সুতরাং এ কমিশনের অধীনে অনেক রাজনৈতিক দলই সংলাপে অংশগ্রহণ করবে না এটা অবিশ্বাসের কিছু নেই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। আর সবসময় বিশ্বাস করতে হবে যে সংলাপ শুরু হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এটাও ভাবা ঠিক নয়। বর্তমান সংলাপ আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠ সুন্দর গ্রহণযোগ্য ও সকলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে হওয়ার একটা প্রাথমিক প্লাটফর্ম হতে পারে।

অনন্ত পক্ষে যাদেরকে সরকারি দলের লোক হিসেবে বলা হচ্ছে তাদের সাথে সংলাপের ফলে মুখ দর্শনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও ভাবের একটা জায়গা তৈরি হয় সংলাপে। আর সংলাপে অংশগ্রহণ করে দলীয় দাবী উপস্থাপন করা হলে দেশবাসী দাবীগুলি সম্পর্কে অবগত হতে পারবে এবং দাবীর পক্ষে একটা আলোচনা তৈরি হতে পারে। সুতরাং এখনই সংলাপের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা না করাই শ্রেয়। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের এ সংলাপ গত ১৭ জুলাই থেকে শুরু হয়। মূলত আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি করতে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ ৯টি দল এ আমন্ত্রণে সাড়া দেয়নি। আর দুটি দল পরবর্তীতে সময় চেয়েছে।

ইসির তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে তিনশরও বেশি প্রস্তাব পেয়েছে কমিশন। এসব প্রস্তাবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইভিএম ও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা। অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের পক্ষে মত দিয়েছে এবং ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়ে বলেছেন এটা যেন ব্য্বহৃত না হয় এবং এও বলা হয়েছে যে ইভিএম নিয়ে ইসির অতি উৎসাহ সাধারণ মানুষের মাঝে শংঙ্কা তৈরি করছে । এসব মতামতের সাথে রয়েছে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পাটিও। কোন দল আবার অর্ধেক আসনে ইভিএমের পক্ষেও মতামত দিয়েছে। তবে সবচেয়ে আপত্তি এসেছে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে যেখানে প্রায় ৭০ ভাগ দলই বর্তমান ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং কয়েকটি দল নির্বাচনকালীন সময়ে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও স্থানীয় সরকার বিভাগ ইসির হাতে রাখার প্রস্তাব করেছেন।

এছাড়াও অনেকগুলো প্রস্তাব এসেছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে সংসদ নির্বাচন দুই বা তিনধাপে করাসহ প্রতিকেন্দ্রে সেনা মোতায়ন, নির্বাচনী ব্যয় ৫০ লাখ টাকা করা, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ ও জাতীয় সংসদের আসন বৃদ্ধি, প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব, তফসিল ঘোষণার পর সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া, নির্বাচনী প্রচারণায় প্রত্যেক আসনে সব প্রার্থীদের এক মঞ্চে সভা করা, দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও হয়রানিমূলক আচরণ বন্ধ করা, ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা, প্রার্থীদের জামানত বাড়ানো, বিনামূল্যে ভোটার তালিকা সরবরাহ, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাহীন দলের নিবন্ধন বাতিল, ভোটের তিনমাস আগে সংসদ বিলুপ্ত করা, দলের সব কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার বাধ্যবাধকতা বিলুপ্ত করা, ‘না’ ভোট চালু করার মতো প্রস্তাব।

বিএনপির মূল দাবী হলো দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন না করা। তাই নির্বাচন কমিশনের এ সংলাপে তারা অংশগ্রহণ করেনি। তাদের এ দাবী পূরণ হলেই সংলাপে অংশ নিবে এমন কথা তারা বলছেন। এ সংলাপকে অহেতুক এবং নাটক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। তবে উত্থাপিত এসব প্রস্তাবের অধিকাংশই সংবিধান সম্পর্কিত। তাই সংবিধান সংশোধন ছাড়া এসব প্রস্তাব আমলে নেওয়ার সুযোগ নেই ইসির। তবে ইসি চাইলে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা ইভিএমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কারন আইনে বলা আছে, ব্যালট পেপার কিংবা ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করতে হবে।

তবে যে পরিমাণে ইভিএম মেশিন রয়েছে তা দিয়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তবে বর্তমান সরকারী দল উল্ল্খেযোগ্য আসনে ইভিএমের ব্যবহার চেয়েছে। তবে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে বেশির ভাগ দলই বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সংলাপের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করলে এটা খুই স্পষ্ট যে বিএনপিসহ কয়েকটি দল অংশগ্রহণ না করা এবং বিভিন্ন উত্থাপিত দাবী সম্পর্কে ইসির জবাব স্পষ্ট না হলেও সংলাপকে অর্থহীন বলা যাবে না। কারন এ সংলাপের মাধ্যমে আলোচনার দরজা উন্মুক্ত হতে পারে এবং এটাকে আলোচনার শুভসূচনাও বলা যেতে পারে। শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করে সংলাপ বর্জন করা শুভ লক্ষণ নয়। অন্যদিকে আগামী বছর ডিসেম্বর কিংবা পরের বছর জানুয়ারীতে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারী দল সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাদ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার কথা বলে আসছে। অন্যদিকে বিরোধীদলগুলো বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জনের কথা বলে আসছে। সরকারের সাথে কয়েকটি দল বাদে বিরোধীদলগুলোর অবস্থান বিপরীতমুখি।

তবে বিরোধীদলগুলো তাদের দাবী বাস্তবায়ন করার লক্ষে বারবার বিভিন্ন আন্দোলনের কথা বলে আসছে। তবে সেভাবে আন্দোলন তারা করতে পারেনি। বলা হচ্ছে সরকার মামলা হামলা করে বিরোধী দলের আন্দোলনকে বাঞ্চাল করছে। অন্যদিকে সরকারী দলের বক্তব্য বিরোধীদল সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে ব্যর্থ হচ্ছে কারন সরকারের বিরুদ্ধে জনগনকে তারা সাথে পাচ্ছে না । তবে অনেকটাই সত্য যে নেতাকর্মী বাদে সাধারণ মানুষকে এখন রাস্তায় নামানো কঠিন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সরকারের বর্তমান সময়ে এমন কোন ভুল কাজ করেনি যে সাধারণ জনগন তার প্রতিবাদে মাঠে নেমে আসবে।

এছাড়াও সরকারী দলের দাবী সরকারের উন্নয়নের কারনে সাধারণ জনগন সরকার বিরোধী আন্দোলনে মাঠে আসছে না। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে পরস্পরবিরোধী উত্তাপ তত ছড়াচ্ছে রাজনৈতিক ময়দানে। এসব উত্তাপ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। অন্যদিকে দেশের জনগনের প্রতি আস্থা না থাকায় বিএনপি সরকারের উপর চাপ বাড়াতে বিদেশীদের দারস্থ হচ্ছে বলে ক্ষমতাসীন দল অভিযোগ করে আসছে । সর্বোপরি আগামী জাতীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিবে কিছু ছাড়ের ভিত্তিতে এ আশা দেশের মানুষের সে ক্ষেত্রে সরকারী দলের সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।