আবীর আহাদ


বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, সমাজের সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের সমন্বয়ে তিনি একটি সুখীসমাজ গড়ে তুলবেন। তিনি হিংসা বিদ্বেষ জবরদস্তি ও রক্তপাতমূলক কার্যকলাপের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ভালবাসা ও বিশ্বস্ততা দিয়েই তিনি সকল বাঙালিকে একতাবদ্ধ করতে চেয়েছেন। তিনি আরো বিশ্বাস করতেন যে, বাংলাদেশ কেবলই বাঙালির দেশ, বাঙালি একটি বৃহত্ পরিবার। এই পরিবারের মধ্যে ভাল মানুষ আছে, খারাপ মানুষও আছে। শোষকও আছে শোষিতও আছে। ধনী আছে, গরীবও আছে। শিক্ষিত-জ্ঞানী আছে, মূর্খও আছে। এসব নিয়েই বাঙালি পরিবার। আমরা সকলে পরের তরে এ-চেতনার পরিবার। এই চেতনার চিরন্তন বিশ্বাসের ওপর ভর করে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে শোষক-শোষিতের প্রশ্ন তুলে জাতিকে বিভক্ত করেননি। ফলে আওয়ামী লীগ হয়ে দাঁড়ায় এদেশের জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রী ও উঠতি পুঁজিবাদীদের একটি সমন্বিত রাজনৈতিক ফ্লাটফরম। এককথায় আওয়ামী লীগ বহু শ্রেণীভিত্তিক রাজনৈতিক সংস্থা (মাল্টিক্লাস অরগানাইজেশন) হিশেবে পরিগণিত হয়।

অপরদিকে মুসলিম লীগ ছিল সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ তথা সমাজের উচ্চস্তরের শাসক ও শোষকদের প্লাটফরম। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া ধনিক বণিক শিল্পপতি জমিদার আমলা ও জেনারেল সামন্তবাদী, সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীলদের সম্মিলিত রাজনৈতিক ক্লাব। ঐসবচক্রের স্বার্থে ও পরামর্শে মুসলিম লীগ পরিচালিত হতো। পূর্ববাংলার দু'চারটি ধনিক পরিবার দালালির মাধ্যমে তাদের সাথে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছিল। বাকি উঠতি পুঁজিপতি বা ধনিকগোষ্ঠী ভবিষ্যত্ ক্ষমতার আশায় আওয়ামী লীগের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এ-ব্যতীত আরো কতিপয় রাজনৈতিক দল যেমন, জামায়াতে ইসলামি, পিডিপি, নেজামে ইসলামি প্রভৃতি ইসলামপন্থী-পুঁজিবাদী দল শাসক ও শোষকদের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অবস্থান করলেও এরা ছিল শাসক-শোষকদের বি-টিম। এদের কাজই ছিল আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা, বিশেষ করে বামপন্থা বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে ইসলাম ও আল্লাহবিরোধী নাস্তিকতাবাদের দর্শন বলে জনগণের মাঝে ধূম্রজাল ছড়ানো, যাতে শাসক-শোষকগোষ্ঠীর বিরোধী সংগঠন আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলগুলোর প্রতি জনগণ ঝুঁকে না পড়ে।

সমাজতান্ত্রিক বা বামপন্থী রাজনৈতিক দলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দল যেমন, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রভৃতি মার্কসবাদী-লেনিন-মাওবাদী রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে একমাত্র পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির দু'টি উপদল (ভাসানী-মোজাফফর) ব্যতীত অন্যান্য দলগুলো ছিল নিষিদ্ধ। আণ্ডারগ্রাউণ্ডেই তারা তাদের সংগঠন পরিচালনা করতো। শাসক-শোষকগোষ্ঠী ও ইসলামওয়ালারা ছিল তাদের প্রতি খড়্গহস্ত। এদের মধ্যে মস্কোপন্থী দলগুলো আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে তাদের কাজ চালাতো। তবে পিকিংপন্থী দলগুলো পাকিস্তানের শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে যতো না গলাবাজি করতো, তারচেয়ে বেশি গলাবাজি করতো আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে। তারা আওয়ামী লীগকে সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের আনুসারি বলেও গালাগাল দিতো। মূলত: ন্যাপ-ভাসানী ও কতিপয় চৈনিকপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের সাথে তাদের মুরব্বী চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূত্র ধরে তারা বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বিরোধিতার মধ্যেই বেশি সময় ব্যয় করতো। রাতের বেলা গ্রাম্য ধনিকদের গলা-কাটা আর দিনের বেলা আওয়ামী লীগের গোষ্ঠী উদ্ধার করাই ছিলো এদের মূল লক্ষ্য। এসব কর্মকান্ড পরিচালনা করার বিনিময়ে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তানের শাসকদের নিকট থেকে অঢেল অর্থকড়ি লাভ করতো।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে কমিউনিস্ট চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের শেষদিকে বেশ অগ্রসর হয়। এ-স্তরে পাকিস্তান সেতুবন্ধ হিশেবে কাজ করে। এ-সুযোগে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমাজতন্ত্রকে হিংসা-বিদ্বেষ, রক্তপাত, হানাহানি, ধর্মবিরোধী নাস্তিকতাবাদের দর্শন হিশেবে চিত্রিত ও চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ঐসব চৈনিকপন্থী সর্বহারা-সমাজতন্ত্রীদের দিয়ে ঐসব কার্যক্রম সুচারুরূপে করতে সক্ষম হয়। মূলত: এরা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের অর্থ খেয়ে সমাজতন্ত্রের নামাবলী আওড়ে প্রকারান্তরে সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার কার্যক্রমে লিপ্ত হওয়াসহ সমাজতন্ত্রকেই কৌশলে গণবিরোধী মতবাদ হিশেবে চিহ্নিত করে। এদেরকে তাই বঙ্গবন্ধু 'পেন্টাগনপন্থী সমাজতন্ত্রী' বলে আখ্যায়িত করতেন। এরা যে মূলত: মার্কিন সেবাদাস তার প্রমাণ এরা রেখেছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। কারণ মার্কিন ও চীন উভয়েই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ছিল। ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও এসব তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা-কর্মীরা সংগত:কারণে কখনোই সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভ করেনি। ঐ তথাকথিত সমাজতন্ত্রী ও ইসলামপন্থীদের কার্যকলাপ তাই জনবিরোধী ও স্বাধীনতাবিরোধী কার্যক্রমেই প্রতিভাত হয়েছে। মূলত: পিকিংপন্থী ও ইসলামপন্থীরা এক ও অভিন্ন উদ্দেশ্যে তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করেছে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে। এরা উভয়েই আসলে প্রতিক্রিয়াশীল। এই দুই প্রতিক্রিয়াশীল চক্র কেবল সমাজতন্ত্রকে নস্যাত্ করার লক্ষ্যে ইসলাম ও সমাজতন্ত্রের নাম ব্যবহার করেছে। এই দুই চক্র ইসলামপন্থী ও চৈনিকপন্থী এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, উন্নয়ন ও প্রগতির শত্রু; এরা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের পেইড এজেন্ট।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সাথে সাথে পাকিস্তান আমলের উঠতি ধনিক পুঁজিবাদীচক্র ও অন্যান্য কায়েমী স্বার্থান্বেষিরা আনিবার্য কারণেই বহুদিনের লালিত কামনাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্য আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। এ সুযোগ আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের মোড়লরা উঠতি ধনিকশ্রেণীর পেছনে এসে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যে পরাজয়ের গ্লানি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী শক্তির কপালে লেপ্টে দিয়েছে, সেই কালিমা মোচন ও পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণকল্পে এবার তারা এদেশীয় উঠতি ধনিকশ্রেণী ও অন্যান্য সুবিধবাদকচক্রের মাধ্যমে তাদের কালো থাবা বিস্তারিত করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এসব ধনিক-সুবিধাবাদীদের লালসা গুড়িয়ে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক আর্থবৈষয়িক কর্মসূচি গ্রহণ করলেন। উঠতি ধনিকশ্রেণী অবশ্য বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বিশিষ্ট অনুসারীদের পুঁজিবাদ পরিহার করার বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিলেন। প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন : এক সাগর রক্তে কেনা বাংলাদেশকে পুঁজিবাদের রক্তচুষা বাঁদুড়দের হাতে তুলে দিতে পারি না।' তিনি শাসনতান্ত্রিক তথা রাষ্ট্রীয় মৌলিক আদর্শ থেকে পুঁজিবাদকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিয়ে সমাজতান্ত্রিক পথের দিকনির্দেশ প্রদান করেছিলেন।

উঠতি ধনিকশ্রেণী প্রমাদ গণলো। মুজিবের দর্শন-কর্মসূচির মধ্যে তারা তাদের মৃত্যুবাণ দেখতে পেলো। ফলে তারা তাদের লক্ষ্য হাসিলের জন্য সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা নিয়ে মুজিব সরকারকে হেয় ও উৎখাতের লক্ষ্যে অতি পুরানো চালটি চাললো। তারা স্বাধীনতাবিরোধী পলাতক মুসলিম লীগ, জামায়াত, নেজাম, পিডিপি, ভাসানী ন্যাপ, চৈনিকপন্থী সর্বহারা-সমাজতান্ত্রিক পার্টি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, হতাশাগ্রস্ত মুক্তিযোদ্ধা, প্রশাসনিক দালাল আমলা, উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তাসহ সমাজের দাগী ডাকাত-গুণ্ডা, মোল্লা-মাওলানা, টাউট রাজনীতিক, ব্যবসায়ী প্রভৃতি শ্রেণীর সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচিকে বানচাল করার লক্ষ্যে এবার তারা নেপথ্যে মদদ দিয়ে কিছু হতাশাগ্রস্ত নামীদামী মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে গঠন করলো প্রথম বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। এদের লক্ষ্যই নাকি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। তারপর শুরু হলো জ্বালাও-পোড়াও, ব্যাঙ্ক লুট, কলকারখানায় অগ্নিসংযোগ, হত্যা-গুম প্রভৃতি নাশকতামূলক কার্যকলাপ। জনগণকে এভাবেই তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের চেহারা দেখালো।

সমাজতান্ত্রিক আদর্শের এ চেহারা দেখে সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলো। সেই ঢেউ গিয়ে পড়লো বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির ওপর। সারা দেশে যেন ঢেউ জাগালো, থামাও সমাজতন্ত্র! এভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্য আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও এদেশীয় উঠতি পুঁজিবাদীচক্র বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করলো! তাদের চক্রান্তমূলক কারসাজিতে দেশের প্রতিটি স্তরে অবিশ্বাস হানাহানি রেষারেষি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে থাকে। জাতীয় ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি হলো। চারদিকে শুরু হলো সীমাহীন স্বেচ্ছচারিতা, দুর্নীতি, চাটারদলের চাটাচাটি, চোরাকারবারি, ফটকাবাজারি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, হাইজ্যাকিং, নৈরাজ্য আর নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির হলাহল। আর এসব কার্যকলাপের পশ্চাতে যাবতীয় ঘুঁটি চালাতে থাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, চীনসহ পরাজিত শক্তি ও এদেশীয় উঠতি ধনিক ও পুঁজিবাদীচক্র। (চলবে)

লেখক :বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বহু গ্রন্থের লেখক, চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।