ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


শুক্রবার ১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস ২০২২। বিশ্বব্যাপী তরুণ ও যুবদের সমৃদ্ধ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক যুব দিবসের উদ্দেশ্য। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০০ সালের ১২ আগস্ট থেকে এটি পালন করা হচ্ছে। এ দিবসের মধ্য দিয়ে বিভিন্নভাবে তরুণ ও যুবসমাজকে সচেতন করা হয়।

বিশ্বের সব দেশের সরকারের মধ্যে তাদের দেশের যুবকদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং তাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য সচেতনতা তৈরি করা এই দিবসের লক্ষ্য।

বাংলাদেশের জন্য দিবসটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠিই তরুণ ও যুবক। তারাই উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রকৃত কারিগর।এই যুব সমাজ বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এমনকী বর্তমান মহামারী মতো বিভিন্ন ঘটনায় পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। বিশ্বব্যাপী সামগ্রীক পরিবর্তন আনতে যুব সমাজের এই অবদানের জন্য প্রতি বছর ১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালিত হয়।আর প্রতি বছর জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক যুব দিবসের জন্য একটি থিম নির্বাচন করে। তারপরেও, এই থিমের ভিত্তিতে, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সম্পর্কে যুবকদের মতামতও জানা যায়। তাদেরও পরামর্শ নেওয়া হয়।

জাতিসংঘ তরুণদের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই যুব উন্নয়নের বিষয়ে এখন অধিকতর মনোযোগী। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জাতিসংঘের হিসাবে, পৃথিবীতে ১০-২৪ বছর বয়সী ২০০ কোটি মানুষ রয়েছে যারা তরুণ এবং মোট জনসংখ্যার চারভাগের এক ভাগ। বাংলাদেশের জাতীয় যুবনীতি অনুসারে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের ‘যুব’বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ হিসেবে মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই যুব জনতা।জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন আনতে যুবকদের জড়িত থাকার বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য এই দিন একটি সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারও শুরু করেছে।আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট গবেষক ডা.এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন...দেশের যুব সমাজকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে সরকারি ও নানা উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজকে আলোকিত করতে এই যুব সমাজের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যুব সমাজের অংশগ্রহণ কখনো কখনো আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে, কারণ আমরা সমাজের কল্যাণকর কাজের পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই যুবসমাজ নানা ধরণের ঘৃণ্য অপকর্মের সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।

শুধু তাই নয় যুবসমাজ নেশায় আসক্ত হয়ে পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে তৈরি হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য কখনোই কাম্য নয়, কাম্য ছিলও না।আর বৈশ্বিক বিভিন্ন সংকটের কারণে বিশ্বের অনেক জনগোষ্ঠীই বর্তমানে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও খাদ্য নিরাপত্তার সম্মুখীন হচ্ছে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সারা পৃথিবীব্যাপি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো কোভিড-১৯ এর প্রার্দুভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তন। এখনও সকল ক্ষেত্রে ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুবদের সম্পৃক্ততা ও ক্ষমতায়নের অভাব রয়েছে। এই বিশাল সংখ্যক যুবদের অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করতে পারলে তারা দেশের উন্নয়ন তথা গণতান্ত্রিক রাজনীতির উৎকর্ষ সাধনে ভূমিকা রাখতে পারবে না, তাই যুবদের সহযোগিতা নিয়ে দেশ তথা বিশ্ব এগিয়ে যাবে, রাষ্ট্রায়ত্ব, স্বায়ত্বশাসিত, বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানেই যুবদের কাজ করার সুযোগ করতে তৈরি করতে হবে, যেন তারা তাদের মেধা ও দক্ষতা বিকাশের সহায়ক পরিবেশ পায়। কোভিড-১৯ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের মতো সংকট কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার লক্ষ্যে যুবদের অর্থবহ অংশগ্রহণ অতীব জরুরী। যুবদের সক্ষমতার প্রয়োগ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ও তাদের কর্মোদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তাদের প্রতিনিধিত্বকে নিশ্চিত করতে হবে।

এদেশের মুক্তি সংগ্রাম থেকে শুরু করে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এ দেশের যুবসমাজ। শুধু তাই নয় দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজকে আলোকিত করতে এই যুব সমাজের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। যুবসমাজ এদেশের ক্রান্তিকালে সব সময় নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে নিজেরা যেমন হয়েছেন ইতিহাসের উজ্জ্বল স্বাক্ষী, তেমনিভাবে তাদের এই আত্মত্যাগ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হয়ে আছে চির অনুসরণীয়। গণতান্ত্রিক সকল আন্দোলন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এ দেশের যুবসমাজ সবসময় ছিলো সক্রিয় এবং অনাচারের বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠকে সব সময় উচ্চকিত করেছে, তারই মধ্য দিয়েই এসেছে ইতিবাচক পরিবর্তন। কখনো বদলে গেছে ঘুনে ধরা পুরো প্রেক্ষাপট। তবে আজ সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যুব সমাজের অংশগ্রহণ কখনো কখনো আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে, কারণ আমরা সমাজের কল্যাণকর কাজের পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই যুবসমাজ নানা ধরণের ঘৃণ্য অপকর্মের সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় যুবসমাজ নেশায় আসক্ত হয়ে পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে তৈরি হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য কখনোই কাম্য নয়, কাম্য ছিলও না। কারণ আমাদের অতীত ইতিহাস কখনোই আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় না। এ দেশের যুবসমাজ প্রগতিশীল ভাবনা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে যে অতীত স্বর্ণালী ইতিহাস তৈরি করেছে তা আজও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তবে বর্তমানে কেন, যুব সমাজের মধ্যে কুলুষিত রাজনৈতিক দীক্ষা আর রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অপব্যবহারের মাধ্যমে বিত্ত-বৈভব কুক্ষিগত করার নগ্ন মানসিকতা তাদের মগজে ঠাঁই পেয়েছে?

আমি বরাবরই একজন আশাবাদী মানুষ। আমি এখনো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এ দেশের যুবসমাজ এখনো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায় নি, তবে কিছু যুবক বা যুবতী রয়েছে যারা কিছুটা পথভ্রষ্ট, যে মূল্যবোধের ইতিবাচক শিক্ষায় তাদের মেধা ও মনন বিকশিত হওয়ার কথা ছিল, সেটি পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি, ফলে তারা আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব কে অগ্রাধিকার দিয়ে জীবনকে পরিচালিত করছে। যেটা সামগ্রিকভাবে একটি হতাশার জন্ম দিচ্ছে। তবুও আমি বিশ্বাস করি, এ প্রজন্মের মাঝেও অনেক সৃজনশীল প্রতিভাবান যুবক ও যুবতী রয়েছে। যাদের কর্মতৎপরতায় শুধু তারা নিজেরাই বিকশিত হচ্ছে না বরং তাদের ব্যক্তিক সাফল্যের দ্বারা তারা পুরো দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। দেশের অর্জন এবং সুনামকে তারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই ইতিবাচক দিকগুলো আমাদের যুব সমাজের মাঝে বেশি করে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাদেরকে ছাত্রাবস্থায় জীবন গঠনে ইতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে জানানোর সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ একটা পর্যায় থাকে, যখন মানুষের মস্তিষ্ককে যেভাবে পরিচালিত করা হয়, মস্তিষ্ক ঠিক সেভাবেই তার প্রতিফলন ঘটায়। সুতরাং আমাদেরকে চলমান সঙ্কট দূর করার ক্ষেত্রে আশাবাদী হতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং আমাদের দেশের সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে কেউ যেন ভুল পথে ধাবিত করতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। কারণ আজকের এই যুবসমাজই আগামী দিনে এদেশের কর্ণধার হবেন। রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।

সুতরাং এখন থেকে তাদের মাঝে যদি মূল্যবোধের ইতিবাচক চর্চা এবং জীবন সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি করা যায়, তাহলে এটি যেমন ঐ যুবকদের ব্যক্তিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তেমনি এ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চাকাকে গতিশীল রাখতে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। যার ফলে এ দেশের উন্নয়নে ছেলে মেয়ে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই মিলে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন রয়েছে, সেটাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা সম্ভবপর হবে। সুতরাং পুরুষের পাশাপাশি পরিবারের নারী সদস্যদের কে সমান সুযোগ দিয়ে এবং তার অর্জিত মেধা-দক্ষতাকে যেন দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারে, সেই ধরণের সুযোগ বা ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের এ উন্নয়নশীল দেশে রয়েছে এক বিরাট যুব সমাজ- এদের হাতকে দেশ গড়ার কাজের উপযোগী করে তুলতে পারলে, মনে দেশপ্রেম এবং কর্মের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে নিঃসন্দেহে বলা যায় আমাদের এ দেশ আর গরিব থাকবে না।

উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত হবেই। আজকের এ মহান দিনে আমাদের সকলের শপথ হোক যুব সমাজকে দেশের- দশের জাতির উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা। আর এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে পারলেই জাতীয় যুব দিবস পালনের সার্থকতা বাস্তবে প্রতিফলিত হবে। যুব দিবসের তাৎপর্য ও গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পাবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে যৌবনকাল

যুবক হচ্ছে জাতির গৌরব ও ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। যুবক হচ্ছে প্রতিটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির সোপান, জাতির মূল্যবান সম্পদ এবং দেশ গড়ার শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। ইসলাম এ সম্পদের যথাযথ সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। যুবকদের নৈতিকতার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, পরিশীলিত মনন ও বলিষ্ঠ চিন্তাধারায় সমৃদ্ধকরণে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে, যার আলোকে কাজ করে গেছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আদর্শ যুবক গঠনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফল ভূমিকা ও সুনিপুণ কর্মধারা যুবকল্যাণ প্রত্যাশীদের অনুসরণ করতে হবে।

কারণ মানব ইতিহাসে তিনিই সর্বোত্তম ও অতুলণীয় যুবসমাজ উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁরই পবিত্র স্পর্শে পৃথিবী পেয়েছে সংগ্রাম ও বীরত্বের প্রতীক আম্মার ইবনে ইয়াসার, হিজরত ও দাওয়াতের আদর্শ মাসআব ইবনে উমাইর, নেতৃত্ব ও পরিচালনার বিস্ময়কর উদাহরণ উসামা ইবনে যায়েদ এবং ইলম ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)। এসব নিষ্ঠাবান তারুণ্যের তেজে পাল্টে গেছে ইতিহাসের গতিধারা, ধূলোয় মিশে গেছে বাতিলের রাজমুকুট, জুলুম ও অত্যাচারের আঁধার দূরীভূত হয়ে পৃথিবীব্যাপী বয়ে গেছে ইনসাফ ও ন্যায়ের ফল্গুধারা এবং উন্মোচিত হয়েছে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের নবদিগন্ত।আর পবিত্র কোরআন, সহিহ হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে যেখা যায়, ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যুবসমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে।এ পৃথিবীতে মানুষের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহের ধারাকে মোটামুটি তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়।

শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য। এই তিনকালের মধ্যে সকল বিবেচনায় যৌবনকাল হলো- শ্রেষ্ঠ সময়।

শৈশবে মানুষ থাকে অসহায় ও পরনির্ভর। পিতা-মাতা ও অন্যের সহযোগিতা ব্যতীত সে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না এবং এ সময় তার কোনো চিন্তার সুষ্ঠু বিকাশ ঘটে না। অনুরূপভাবে বার্ধক্যেও সে অসহায় দুর্বল ও পরনির্ভর হয়ে পড়ে। মনের ইচ্ছা থাকলেও সে সবকাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারে না। এমনকি চিন্তাশক্তির বিলোপ পর্যন্ত ঘটে থাকে। কিন্তু যৌবনকাল এ দু’য়ের ব্যতিক্রম। যৌবনকালে মানুষ অসাধ্য সাধনে আত্মনিয়োগ করতে পারে। এটাই যৌবনের ধর্ম।

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যৌবনকালকে গণিমতের মাল তথা মূল্যবান সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করে তা মূল্যায়ন করার তাগিদ দিয়েছেন। কেননা এ সময় সম্পর্কে পরকালে জবাবদিহিতা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, আমর ইবনু মায়মুন আল আওদি (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জনৈক ব্যক্তিকে উপদেশস্বরূপ বলেন, পাঁচটি বস্তুর পূর্বে পাঁচটি বস্তুকে গণিমত মনে করো। যথা- ১. তোমার বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে, ২. পীড়িত হওয়ার পূর্বে সুস্বাস্থ্যকে, ৩. দারিদ্র্যতার পূর্বে সচ্ছলতাকে, ৪. ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে ও ৫. মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে। ’ –তিরমিজি

আর আমরা সাধারণত জীবন গঠনের প্রাথমিক শিক্ষা পাই পিতা-মাতার কাছ থেকে। এরপরই আমাদের জীবনে চলে আসে বন্ধুমহল।

পিতা-মাতার স্নেহের কোল থেকে বেরিয়ে মানুষ প্রথম যাদের মাঝে বিচরণ করে তারা হলো বন্ধু। আর বন্ধুদের উচিত হলো বন্ধুর সঙ্গে এমন চরিত্র উপস্থাপন করা যাতে বন্ধু সেই চরিত্রের মাধ্যমে প্রভাবিত হয় এবং সব ধরনের সৎ কাজে উৎসাহিত করা এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা। কিন্তু বর্তমান সমাজের বন্ধুমহল এবং পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতার অবস্থা এমন যে, অনেক সময় দেখা যায় মানুষ তার বন্ধুর কারণেই খারাপ হয়ে যায়, ভুল পথে পা বাড়ায়। সাধারণত দেখা যায়, কোনো মানুষ প্রথম অসৎ কাজটি শেখে বন্ধুর কাছ থেকে। অশ্লীল সিনেমা, সিগারেট, ইভটিজিং, গাঁজা, মদ, অপরাধমূলক কাজগুলো বন্ধুদের প্ররোচনায়ই করা শুরু করে। এ সমাজে নামাজের দিকে ডাকার মতো বন্ধুর তুলনায় আড্ডা দিতে ডাকার মতো বন্ধুর সংখ্যাই বেশি। সুতরাং বন্ধুদের দ্বারা পাশবিক চরিত্র দমনের চেয়ে বিকাশই বেশি হয়। এ জন্যই হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হও’, কারণ বন্ধুর চারিত্রিক প্রভাবেই মানুষ বেড়ে ওঠে। আর এভাবেই যুবসমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত।

আর বর্তমান সমাজে চলমান একটি বাস্তবতা হলো, আমরা আমাদের যুব-তরুণদের দ্বীন ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয় থেকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বিরত রাখার চেষ্টা করে থাকি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সুকৌশলে আমরা যুবকদের ইসলাম সংক্রান্ত বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে রাখি। এ ক্ষেত্রে তরুণ-যুবকদের সামনে তুলে ধরা হয়, যৌবনকাল হচ্ছে এনজয় করার সময়। আর যদি কোনো যুবক ইসলাম নিয়ে অধ্যয়ন করতে চায়, ইসলাম সম্পর্কে মানুষকে দাওয়াত দিতে চায় তাহলে তাকে উৎসাহদানকারীর চেয়ে নিরুৎসাহিতকারীর সংখ্যাই সমাজে বেশি দেখা যায়। তাকে বলা হয় আরে রাখো, ধর্মকর্ম তো বার্ধক্যের জন্য। আগে কিছুদিন আনন্দ-ফুর্তি করো। নিজের ক্যারিয়ার গড়ো।

পক্ষান্তরে আমরা যদি কোরআন-সুন্নাহর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, ইসলাম মানবজীবনের সবচেয়ে বেশি মূল্যবান সময় নির্ধারণ করেছে যৌবনকালকে। প্রতিটি মানুষের যৌবনকাল হচ্ছে ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন কোনো বনি আদমই পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে এক কদম আগে বা পিছে নড়ার অনুমতি পাবে না। এর মধ্যে প্রথম প্রশ্ন হবে তার জীবন সম্পর্কে, কোথায় সে এটি ব্যয় করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হবে তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কী কাজে সে যৌবনকাল নষ্ট করেছে। তৃতীয় প্রশ্ন- সম্পদ কীভাবে উপার্জন করা হয়েছে। চতুর্থ প্রশ্ন- উপার্জিত সম্পদ কোন কাজে এবং কোথায় ব্যয় করেছে। পঞ্চম ও শেষ প্রশ্ন- যেসব বিষয়ে সে জ্ঞানার্জন করেছিল তার কতটুকু আমল করেছে। ’ –সহিহ বোখারি

ইতিহাস সাক্ষী, তাকওয়াবান যুবকদের দ্বারা পৃথিবী উপকৃত হয়েছে এবং পৃথিবীতে উত্তম আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার পথভ্রষ্ট যুবকদের দ্বারা পৃথিবীর বহু সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাকওয়াবান যুবকদের নিয়ে বদর, ওহুদ, খন্দক ও তাবুকসহ অন্যান্য যুদ্ধে বিজয়লাভ করেছেন। চীন বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব এবং বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার যুদ্ধেও লাখ লাখ যুবকের আত্মত্যাগ ও ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে।

পরিশেষে বলতে চাই, ইসলাম যেখানে যৌবনকালকে এত গুরুত্ব দিয়েছে, মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যৌবনকালকে ভালো কাজে ব্যয় করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে, সেখানে আমাদের দেশে অপশক্তিগুলো তরুণদের নেশা, সন্ত্রাস অপকর্মের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।আর পৃথিবীর প্রতিটি বিভাগেই যুবসমাজের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তাই আল্লাহর দেওয়া পবিত্র আমানত যৌবনের প্রতিটি ধাপ, মেধা, শ্রম ও প্রতি ফোঁটা রক্ত মানুষ সত্যিকার অর্থে আল্লাহর পথে ব্যয় করলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কল্যাণে ভরে যাবে এবং পরকালের ভয়াবহ দিনে আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় লাভের সৌভাগ্য অর্জন করবে। যেদিন তার ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। অন্যথায় জাহান্নামের লেলিহান শিখায় অগ্নিদগ্ধ হতে হবে।

আজ আন্তর্জাতিক যুব দিবস আমরা চাই হালের তরুণ-যুবকরা গড্ডলিকা প্রবাহে না ভেসে ইসলাম সম্পর্কে জানবে, ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে এবং সে অনুযায়ী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।