শিতাংশু গুহ


পূর্ব-নির্ধারিত ছিলো যে আমরা ভ্যানকুভার পৌঁছবো ৫ই আগষ্ট ২০২২, দুপুরের পর পড়ন্ত বিকালে। ডেল্টা ফ্লাইট ক্যানসেল হওয়ায় সেটি সামান্য পিঁছিয়ে যায়। সন্ধ্যার দিকে খবর আসে, মেজর (অব:) সুরঞ্জন দাশ সস্ত্রীক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। প্ল্যান ছিলো ভ্যানকুভারে নেমে সুরঞ্জনদা’কে কল দেবো, এবং তাঁর বাসায় যাবো। তাঁর বাড়ীতে গিয়েছি ঠিকই, তিনি ছিলেন না, তাঁর মরদেহ পুলিশ তখনো হস্তান্তর করেনি; সময়টা রবিবার ৭ই আগষ্ট সন্ধ্যা হয় হয়, বেশ কিছুক্ষন ছিলাম, অনেকেই ছিলেন, চিনিনা। বড্ড কষ্ট লেগেছে। 

সুরঞ্জন দাশ সস্ত্রীক ঘুরতে গিয়েছিলেন, পরদিন ফেরার কথা। সকাল সাড়ে ৮টা’র দিকে হাইওয়েতে তিনি গাড়ী চালাচ্ছিলেন। তাঁর বাড়ী থেকে ঘটনাস্থল বৃটিশ কলম্বিয়ার কলোনা সিটি ৩৫০-৪০০ কিলোমিটার দূর। সেখানকার হাইওয়েতে সব জায়গায় ডিভাইডার নেই, বরং ডবল ইয়োলো লাইন দিয়ে দু’দিকের ট্রাফিক বিভক্ত করা হয়েছে। সচরাচর দুই লেন, কোথাও কোথাও তিন বা চার লেইন। এবার কানাডার ওই অঞ্চলে আমি অনেকটা পথ ড্রাইভ করে স্বচক্ষে এটি প্রত্যক্ষ করেছি। কানাডায় হাইওয়েতে ডিভাইডার থাকবে না, এটি কেমন যেন বেমানান মনে হয়েছে।

সুরঞ্জনদা যেদিকে যাচ্ছিলেন, সেটি ছিলো দুই লেন, তিনি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ লেনে ছিলেন। ঐসব রাস্তায় স্পীড লিমিট সচরাচর ঘন্টায় ১০০/ ১১০কিলোমিটার, সবাই ১৩০/১৪০-এ চালায়। যে ট্রাকটি এক্সিডেন্ট ঘটায় সেটি উল্টোদিক থেকে আসছিলো, চালক ড্রাঙ্ক ছিলো। সুরঞ্জনদা’র বাড়ী থেকে আরো জানলাম যে, ট্রাকটি প্রথমে সুরঞ্জনদা’র পাশের গাড়িতে কোনাকুনি আঘাত করলে সেটি সরে যায় অথবা পিছিয়ে যায় (ঐ গাড়ীর যাত্রীদের খবর আমরা জানিনা), ফলে ট্রাকটি সজোরে, সরাসরি সুরঞ্জনদা’র গাড়ীতে মুখোমুখি আঘাত করে! ভাঙ্গা গাড়িটি দেখে দুর্ঘটনার ভয়াবহতা টের পাওয়া যায়।

সব শেষ, সুরঞ্জন দাশ এবং বউদি সুপর্ণা দাশ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁদের আত্মার সদ্গতি কামনা করি। সুরঞ্জনদা’র ৩মেয়ে ১ছেলে, সবাই এডাল্ট। ২মেয়ে, ১ছেলে ডাক্তার; এক কন্যা এটর্নী। সবাই প্রতিষ্ঠিত। বৌদি’র মা জীবিত, তিনি মেয়ের কাছে থাকেন। ঘটনার একদিন পর তাঁকে সবকিছু জানানো হয়েছে। তিনি বিহ্বল। আমাদের জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, আমার জামাই-মেয়ে চলে গেছে। তাঁর আর এক মেয়ে জানালো, খবর শোনার পর তাদের মা দাদার সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, ‘তোরা এতিম হয়ে গেলি’। এমন মৃত্যু কাম্য নয়, একসাথে দু’জন! গড ব্লেস দেম।

সুরঞ্জন দাশ থাকতেন ভ্যানকুভার, নিউইয়র্ক ও মন্ট্রিলে তাঁর গুণগ্রাহীর সংখ্যা অগুনতি। মন্ট্রিলের অনেক কথা শুনেছি, নিউইয়র্কে তাঁর সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতা ছিলো বটে। বয়সে আমি তাঁর ছোট, সেই সুবাদে তিনি ‘দাদা’র’ মতই আচরণ করতেন। আমিও সুবোধ ছোটভাই হয়েই থাকতে পছন্দ করতাম। তিনি মহামানব ছিলেন না, দোষেগুণে সাধারণ মানুষ ছিলেন। নিউইয়র্কে ‘বাংলাদেশ হিন্দু মন্দির’ প্রতিষ্ঠাকালে অনেকে তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, আমি জানি তাঁর মৃত্যুতে এঁরা সবাই ব্যথিত, সবাই তাঁর মঙ্গল কামনা করছেন। কেউ কেউ শোক সভা করছেন। নমস্কার দাদা, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।

সাপ্তাহিক জন্মভূমি সুরঞ্জন দাশ-কে ‘বাংলাদেশ হিন্দু মন্দির’-র স্থপতি হিসাবে আখ্যায়িত করেছে। এটি সত্য তিনি ছিলেন বলেই মন্দিরটি ঐসময় প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। মন্দির প্রতিষ্ঠার কর্মকান্ডে তিনি গতি সঞ্চার করেছেন। প্রতিষ্ঠাকালে সর্বাধিক অনুদান তারই। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, সম্ভাব্য সভাপতি যা দেবেন তিনি এরচেয়ে ১হাজার ডলার বেশি দেবেন। অতিরিক্ত ১হাজার তিনি তাঁর স্ত্রী’র নামে দিয়েছেন। নিউইয়র্কে তিনি অনেকগুলো বৈঠক করেছেন, সকল গ্রূপের মাঝে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। ফলশ্রুতিতে উডসাইডের এক বাসায় বসে আমরা তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে সর্বসম্মতভাবে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করি। যদিও বেশিদিন তিনি টিকে থাকতে পারেননি। বহুদূরে থাকা সত্বেও তাঁকে সরে যেতে হয়েছে!

সুরঞ্জন দাশ বুঝেছিলেন জনগণের টাকায় কেনা মন্দিরটি ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ হয়ে যাচ্ছে। মন্দিরের নেতারা তাঁকে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, এমনকি গঠনতন্ত্রটি পর্যন্ত তাঁকে দেয়া হয়নি? তিনি পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ পত্রের একটি কপি আমার কাছে ছিলো, সময়ের ব্যবধানে সব লেখা মুছে গেছে। যিনি সুরঞ্জনদাকে মন্দিরের সাথে যুক্ত করতে সবচেয়ে বেশি সচেষ্ট ছিলেন, তিনি তখন মন্দিরে যথেষ্ট ক্ষমতাবান, আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম সুরঞ্জনদা’র পদত্যাগ পত্র যেন গ্রহণ করা না হয়। এও বললাম, উপস্থিতি না থাকলেও তিনি নামেমাত্র সাধারণ সম্পাদক থাকার অর্থই হচ্ছে, মন্দিরটি সাধারণ হিন্দুদের থাকবে। তিনি আমার কথা শুনলেন না, শুনলেন ‘দিদি’র’ কথা! পদত্যাগ গৃহীত হলো। সত্য হচ্ছে, সুরঞ্জন দাশ-কে আমরা যতটা সন্মান দিয়ে ডেকে এনেছিলাম, ততটা অসম্মান করেই বিদায় দিয়েছি।

সুরঞ্জন দাশ কাজের লোক, অনেকটা খামখেয়ালী। একবার তাঁর ইচ্ছে হলো ঢাকায় একটি বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করবেন। আমি তখন দেশে যাচ্ছিলাম, আমায় তাঁর প্ল্যান বুঝিয়ে দিলেন। আমি ঢাকায় বেশ ক’জন বড়বড় সাংবাদিকের সাথে কথা বললাম। আবেদ খান একটি চমৎকার প্ল্যান দিয়েছিলেন। এটি সম্ভবত: ৯৭/৯৮ সাল, সুরঞ্জনদা হয়তো তখন অতগুলো টাকা খরচ করতে রাজি ছিলেন না, তাই প্ল্যান এগোয়নি। আরো পরে তিনি ঠিকই একটি দৈনিক কাগজ ‘মাতৃভূমি’ বের করেছিলেন। আমি তাতে জড়িত ছিলাম না, সেটি টেকেনি।

আওয়ামী ঘরানার অনেকের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিলো, শোনা যায় শেখ রেহানা’র সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিলো। তিনি এমপি হতে চেয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়নি। সেনাবাহিনীর অনেকের সাথেও যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক ছিলো। মীরপুর বা আশেপাশে তাঁর একটি সম্পত্তি ছিলো, তিনি আমাকে দেখে আসতে বলেছিলেন। তাঁর এক বন্ধু, যিনি তখন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি আমায় নিয়ে ওই জমিটি দেখিয়ে আনেন। তিনি আমাকে আরো কয়েকজনের সাথে দেখা করতে বলেছিলেন, আমি করেছিলাম। সুরঞ্জনদা’র ছোট ভাই হিসাবে এঁরা সবাই আমার সাথে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করেছিলেন।

সুরঞ্জনদা একবার আমার বাসায় কল দেন, আমরা তখন উডসাইডে থাকি। আমাদের ছোট ছেলে ফোন ধরে। সুরঞ্জনদা জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমার বাবা কোথায়’? ছেলে উত্তর দেয়, ‘বাবা বাজারে গেছে’। এরপর দাদা আমার স্ত্রী’র সাথে কথা বলে হাসতে হাসতে খুন, জানালেন, ‘বাবা বাজারে গেছে’ একথাটি তিনি অনেক দিন পর শুনেছেন। মধ্যখানে সুরঞ্জনদা’র সামনে অনেক দিন যোগাযোগ ছিলোনা। ক’বছর আগে হটাৎ কল দিলেন? জানালেন, মেয়ের বিয়ে। নিমন্ত্রণ, ভ্যানকুভার যাওয়ার। যাওয়া হয়নি, দেখা হয়নি। আর কখনো হবেনা। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু এ কেমন যাওয়া?

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।