গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া : মাত্র দু বছর আগে হিন্দু অধ্যুষিত যেই গ্রামটিতে ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে হিন্দুদের অসংখ্য বাড়িঘর ও একাধিক মন্দিরে সাম্প্রদায়িক এক নারকীয় হামলা ও লুটপাটের তান্ডব চালানো হয়েছিল। দু'বছর পর সেই গ্রামে এবার মা মনসার দশমীতে আবারও হাজার হাজার হিন্দু মুসলমানের উপস্থিতিতে যেন এক ভ্রাতৃত্ববোধসম্পন্ন মানুষজনের মিলনমেলার হাট বসেছিল। কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কোরবানপুর গ্রামে গতকাল মা মনসা পূজার দশমীকে কেন্দ্র করে রাতভর সেখানে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের অসংখ্য নারী পুরুষের উপস্থিতিতে অনুকরণীয় সেই মহা মিলনমেলার দৃষ্টিনন্দন চমকপ্রদ দৃশ্য দেখে আগত মানুষজনকেও সস্তি ও আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

মা মনসার পূজা ও দশমীকে ঘিরে পুরো কোরবানপুর গ্রামটি যেন গত তিনদিন ধরেই একটি আনন্দ ধামে পরিণত হয়েছিলো।

গ্রামের হিন্দু মুসলমানের সার্বিক সহযোগিতায় এবং প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হওয়া স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, আওয়ামীলীগ নেতা শুকলাল দেবনাথের পৃষ্ঠপোষকতা ও আন্তরিক উদ্যোগে তিন বছর পর আবারও এবছর কোরবানপুর গ্রামে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে ওই মনসার দশমী অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেল। এতে কোরবানপুরসহ আশ পাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় ৩০টির মতো মা মনসার নান্দনিক প্রতীমা ওই দশমীর উৎসবস্থলে ঢাক ঢোল বাজিয়ে আসতে দেখা যায়।

এ উপলক্ষে অনুষ্ঠানস্থলে সার্বজনীন মনসার দশমীকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠানস্থলে বিশাল মঞ্চ বানিয়ে সেখানে একটি ঋদ্ধ আলোচনা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। এতে কোরবানপুর গ্রামের বিশিষ্টজন দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর ব্যবস্থাপক শ্রী সঞ্জীব কুমার দেবনাথ সভাপতিত্ব করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই ১৫ আগস্ট নিহত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ বিগত দিনে ওই গ্রামের মৃত বিশিষ্টজনদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রপাঠসহ প্রদীপ প্রজ্জলনের মাধ্যমে এই মাঙ্গলিক দশমী অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন মুরাদনগরের রহিমপুর অযাচক আশ্রমের অধ্যক্ষ, দেশের বিশিষ্ট পন্ডিত ডা. শ্রীমৎ যুগল ব্রহ্মচারী মহারাজ।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কুমিল্লা (উত্তর) জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ম. রুহুল আমীন। এতে প্রধান আলোচক ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব বিশিষ্ট ধর্মীয় আলোচক শ্রী নারায়ণ চন্দ্র দেবনাথ।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মুরাদনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শ্রী অভিষেক দাশ, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, বাঙ্গরা থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শ্রী দীনেশ দাসগুপ্ত, মুরাদনগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক শ্রী নিত্যানন্দ রায়, সাধারণ সম্পাদক শ্রী রামপ্রসাদ দেব, দৈনিক বাংলা ৭১ এর বিশেষ প্রতিনিধি সিনিয়র সাংবাদিক শ্রী গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু, ডা. শ্রী জহরলাল ভৌমিক প্রমুখ। এসময় মঞ্চে কুমিল্লা ও মুরাদনগর থেকে আগত পুজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দসহ বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন।

পরে দশমী অনুষ্ঠানে সারারাতভর অনুষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিযোগীতা শেষে সামগ্রিক বিবেচনায় খোষঘর গ্রামের শান্তি সংঘের প্রতীমাকে প্রথম, একই গ্রামের পরিমল দাসের বাড়ির প্রতীমাকে দ্বিতীয় এবং কোরবানপুর গ্রামের কালী সংঘের প্রতীমাকে তৃতীয় 'শ্রেষ্ঠ প্রতিমা' হিসেবে ঘোষণা করে পুরস্কৃত করা হয়।

এদিকে অনুষ্ঠানের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে প্রচুর সংখ্যক পুলিশকে রাতভর দশমী অনুষ্ঠান স্থলের চারপাশে মোতায়েন থাকতে দেখা যায়।

(জিডি/এসপি/আগস্ট ২০, ২০২২)