পীযূষ সিকদার


‘‘শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি হোক আমাদের আত্মপব্ধির প্রথম পাঠ’’ - এই শ্লোগানকে সামনে রেখে রাজবাড়ী-ফরিদপুর সংস্কৃতি বিনিময়-২০২২। সেই সাথে চলে আলোচনা, গুণীজন সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘ফেরা’। রচনা ও নির্দেশনা- ম.নিজাম। একক অভিনয়-নিরব ইমতিয়াজ শান্ত। পরিবেশনায়-খেয়া সাংস্কৃতিক সংস্থা, ফরিদপুর। নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন ফরিদপুর শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চস্থ হয়। ১৮ আগস্ট রোজ বৃহস্পতিবার। একই নাটক ফেরা ১৯ আগস্ট রোজ শুক্রবার জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তন, রাজবাড়ীতে মঞ্চস্থ হয়। সমগ্র অনুষ্ঠানটির আয়োজনে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি সংসদ, রাজবাড়ী ও খেয়া সাংস্কৃতিক সংস্থা, ফরিদপুর। অনুষ্ঠানটি দুইদিন ব্যাপী। একদিন ফরিদপুর ও পরের দিন রাজবাড়ীতে অনুষ্ঠিত হয়। ১৮ আগস্ট জনকের জন্য কবিতা, গুণীজন সংবর্ধনা ও নাটক ‘ফেরা’ মঞ্চস্থ হয়। ১৯ আগস্ট-এ গুণীজন সম্মাননা ও একই নাটক ‘ফেরা’ মঞ্চস্থ হয়। দর্শক একদমে নাটকটি শুরু থেকে শেষাবধি দেখে নেয়। নিরব ইমতিয়াজ শান্তর অভিনয় ছিলো মন কাড়ার মতো।

‘ফেরা’ নাটকটি পর পর দুইদিন মঞ্চস্থ হয়। একদিন ফরিদপুর পরেরদিন রাজবাড়ীতে। সংস্কৃতি বিনিময় নিমিত্ত। এ এক দারুণ আইডিয়া। সাধুবাদ দিই ম.নিজামকে। এমন একটি শৈল্পিক দিক নির্দেশনার জন্য। সংবর্ধনার পর শুরু হয় নাটক। সংবর্ধিত করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম খান, করোনা যোদ্ধা ডাঃ ওয়াজেদ জামিল ও খায়রুল ইসলাম নিলু (সঙ্গীতজ্ঞ)।

মঞ্চ অন্ধকার। আলো জ্বললেই শুরু হয় নাটক ‘ফেরা’। টান টান উত্তেজনায় প্রথম থেকেই দর্শককে মাতিয়ে রাখে। বহু চরিত্রের সম্মিলনে কথক একাই বহু চরিত্র হয়ে উঠে। এ একটা যাদু। শরীরের মর্মস্পর্শী যাদুতে একাই হয়ে ওঠে ‘ফেরা’। নাটকের কথক বর্ণনায় বর্ণনায় কখনো অভিনয়ে অভিনয়ে একাই হয়ে ওঠে দ্বান্দ্বিকতার মিথ। মিথের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধের কথকতায় একক নাটক ‘ফেরা’ আমাদের নিয়ে যায় সুদূর অতীতে। মুক্তিযুদ্ধে। ‘‘হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগছেরে, হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগছে’’। তখন মঞ্চজুড়ে হাসির রেখা মিলিয়ে যায়। মাস্টারের দেশ প্রেম ও ছোট মানিকের গ্রেনেড বহন করে মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া। এ যেন সমকালীন বাস্তবতায় বিপরীত মুখীতে দাঁড়িয়ে নাট্যকার নিজে দুঃখের রুপকার হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু ও ‘ফেরা’ যেনো অভেদাত্মা।

অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে বাড়ি ফিরেছেন। আবার কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে বাড়ি ফিরতে পারেননি। যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধকে নির্ভর করে এমন একটি নাটক উপহার দেয়া সত্যিই বিরল। ১৯৭১ সাল। সেই ভয়াল দিনগুলো আমাদের স্মৃতিপটে দাগ কেটে যায়। একটি শিশুর জন্মের ভেতর দিয়ে নাটকটি শুরু হয়। বাবার নির্দেশে মানিক মিষ্টি আনতে যায়। মিষ্টি কেনা হয় না। ছোট্ট মানিক জড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। কত বাধা বিপত্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানিক ঠিকই গ্রেনেড মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেয়। হঠাৎ কমান্ডারের নিতিশের কথা মনে পড়ে যায়! এই গ্রেনেডটি না পেলে তারা স্বদলবলে মারা পড়তেন। মানিক একটি চিঠি দেয়। এক মর্মস্পর্শী লেখনীর মাধ্যমে চোখের জলে গাঙ হই আমরা সকলে। পুরো নাটকটি নিরব ইমতিয়াজ শান্ত একাই টেনে নিয়ে যায়।

স্বাধীনতাকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটতে থাকে। পাক হানাদার বাহিনীর মরণ থাবা শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। তারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। হত্যাযজ্ঞ চালায় নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর। লুট, হত্যা, নারী নির্যাতন করতে থাকে শহর থেকে গ্রামে। এর মধ্যে একটি ব্যাগ নিয়ে ছুটতে থাকে এক বিস্ময় বালক। চোখে মুখে ভয়, সেই সাথে স্বপ্ন। চোখে মুখে আতংক। ভয় বুক ভরা। প্রতি পদে পদে বাধা যেনবা বাধার প্রাচীর। হাজারো লোভাতুর চোখ সামলে মানিক প্রাণপণে ছুটতে থাকে দিনের পর দিন। ও যেনো দেশের জন্য এক মর্মস্পর্শী মুক্তির গান। পদে পদে বাধা। সেই বাধাকে ডিঙিয়ে মানিক এগিয়ে যায় সামনের দিকে। এ নাটকে মানিকই হয়ে উঠে প্রধান চরিত্র।

মানিক দৌঁড়ায়। চটের ব্যাগ নিয়ে। অন্যরা ভাবতে থাকে এই চটের ব্যাগের মধ্যে দামী সোনা দানা গহনা আছে। সবার লোভ হয়। তার শিক্ষক বাবা মেনে নিতে পারে না মানিককে। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আর মানিক সোনা ভর্তি ব্যাগ নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। না মানিক আমার পুত্র না! নাটকের শেষের দিকে জানা যায় এই ব্যাগে সোনা নয়! কী তাহলে? নাটকের শেষের দিকে গোমর ভাঙে! এই চটের ব্যাগের মধ্যে সোনা নয় আছে গ্রেনেড। এই গ্রেনেডই মুক্তিযোদ্ধাদের সদলবলে বাঁচিয়ে দেয়। মানিক হয়ে উঠে মিথের রুপকার। মাস্টার আনন্দে বিউগল বাজায়। কুড়িয়ে পাওয়া একটি কন্যাশিশু দেশমাতৃকা হয়। বঙ্গবন্ধুর অমর বাণীর সংগীতের মধ্য দিয়ে নাটক-এর সূত্রপাত ও পরিসমাপ্তি।
নাটকে ব্যবহৃত হয়েছে নিরাভরণ সেট। সেটটি কখনো নৌকা, কখনো টুল, কখনোবা গাছের গুঁড়ি হিসেবে নাটককে আরো গতিশীল করে তুলেছে। আবহসংগীত নাটকে প্রাণের সঞ্চার করেছে। আলোর ব্যবহার চমকে দেবার মতো। আলো-আঁধারের খেলা নাটককে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেছে।

সাধুবাদ দিই ‘ফেরা’ নাটকের নাট্যকারকে। এমন একটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক উপহার দেবার জন্য। সেই সাথে এই নাটকের অভিনেতা নিরব ইমতিয়াজ শান্তকে অভিবাদন জানাই। টান টান উত্তেজনায় বহুর মধ্যে এককে ফুঁটিয়ে তোলার জন্য আরো একবার সাধুবাদ। সেই সাথে অভিনন্দন। অভিনন্দন জানাই- রাজবাড়ী ও ফরিদপুরকে এমন একটি সুন্দর সন্ধ্যা উপহার দেয়ার জন্য। সংস্কৃতির বিনিময় এক নতুন উদ্যোগ। আমাদেরকে নবসূত্র ধরিয়ে দিলেন।
পরিশেষে বলতেই হয়-মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘ফেরা’র শততম মঞ্চায়ন হোক। ম.নিজাম শত আয়ু পাক। নিরব ইমতিয়াজ প্রতি সন্ধ্যায় ফুল হয়ে ফুঁটুক। মুক্তির গানে গানে ফেরা কী যায়! যারা ঘরে ফেরে তারা ভিতু! তাই ফেরা হয় না নাট্যকার তথা অভিনেতার! যুদ্ধ শেষ না করে আমরাও কী ঘরে ফিরি!!

লেখক : শিক্ষক ও নাট্যকার।