চৌধুরী আবদুল হান্নান


লাইফ সাপোর্টে থাকা ব্যাংকগুলোকে তো নিবিড় পরিচর্যা করতেই হবে কিন্ত প্রশ্ন হলো কেবল ১০টি ব্যাংককে কেনো ? পুরো ব্যাংক খাতই তো নড়বড়ে, দুর্দশাগ্রস্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ১০টি ব্যাংককে নিবিড় তদারকির আওতায় নিয়েছে যাতেব্যাংকগুলো দুর্বলতা কাটিয়ে সবল হয়ে উঠতে পারে।

দুর্বল ব্যাংক বেছে বেছে এমন বিশেষ নজরদারি তো আগেও করা হয়েছে কিন্ত কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময়ে ২০ টিরও অধিক দুর্বল চিহ্নত ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক কিন্ততাতে ব্যাংকগুলোর কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি। পুরো ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণহীনতার দিকে দ্রুত ধাবিত হওয়া ঠেকানো যায়নি এবং বর্তমানে ব্যাংকগুলো এক শ্রেনীর লোভী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অর্থ লোপাটের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মহাব্যবস্থাপক বা নির্বাহী পরিচালক পদ মর্যাদার কর্মকর্তাদের অনেক ব্যাংকেই তো পূর্বে পর্যবেক্ষক হিসেবে বসানো হয়েছিল কিন্ত তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। তারা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় উপস্থিত থেকে পরিচালকদের (যারা ব্যাংকটির মালিক বাসরকারের প্রতিনিধি) অন্যায়, অনৈতিক কাজ প্রতিরোধ করবেন যা কেবল অসম্ভবই নয়, হাস্যকরও ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক রূপালী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে কমিশনের বিনিময়ে ভুয়া ঋণ অনুমোদন ও ছাড় করিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল (সমকাল ৬ জুন, ২০১৬) বেসিক ব্যাংকের মহাকেলেঙ্কারীর সময়ও ওই ব্যাংকের পর্ষদে একজন পর্যবেক্ষক নিযুক্ত ছিলেন কিন্ত তাতে কি লাভ হয়েছিল।

ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে পূর্বে গৃহীত যে উদ্যোগ ভুল প্রমানিত হয়েছিল বা ফলপ্রসূ হয়নি, তেমন একই কার্যক্রম পুনরায় গ্রহণ করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকেই এটাকে ভুল সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন, আর ভুল সিদ্ধান্তের ফল ভালো হয় না ।

দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল করার এমন তৎপরতাকে কেবল লোক দেখানো কাজ বলে মনে হবে। মিটিং সিটিং আর চিঠি চালাচালি হবে শুধু। লোকে দেখবে, ব্যাংকের সুশাসন ফেরাতে চেষ্টার কোনো অন্ত নেই কিন্ত বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল তদারকির কারণে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসছে না ।

আমাদের অজানা নয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কম নেই, রাজনৈতিক চাপ, মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনা, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের চাপ, বড় বড় ঋণ খেলাপির বাড়তি ও অন্যায্য সুবিধা আদায়ের চাপ ইত্যাদি তো আছেই ।

স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে যত বাধাই থাকুক না কেনো, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সহজেই করা যায়। ব্যাংকগুলোর ওপর তাদের নিয়মিত পরিদর্শন রিপোর্টে চিহ্নিত অনিয়মগুলো সংশোধন করা হয়েছে কিনাতা নিশ্চিত করা কঠিন নয়। তাছাড়া, প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সফল প্রয়োগের মাধ্যমে অবশ্যই সুফল পাওয়া যাবে, তাদের প্রধান কার্যালয়ে দক্ষ জনবল দ্বারা গঠিত অডিট ও ইন্সপেক্সন ডিপার্টমেন্ট রয়েছে যারা “ওয়াচ ডগ” হিসেবে তৎপর এবং তাদের একমাত্র কাজ শাখাসমূহে অনিয়ম, দুর্নীতি বন্ধে সজাগ থাকা। ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে ব্যাংকে দুর্নীতির মাত্রা বাড়তেই পারে না ।

অন্যান্য ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তাও নজরদারি করার এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছে, কাজ করার পরিবেশ নেই বলে সময় নষ্ট না করে যে কাজগুলো সহজে সম্পন্ন করা যায়তা করতে হবে।

প্রাথমিকভাবে প্রতিটি সরকারি ব্যাংকের শত শত ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির মধ্যে মাত্র বড় ১০ জনের বকেয়া আদায়ে বিশেষ ব্যবস্থা নিন, তাতে ব্যাংকগুলো রুগ্নতা কাটিয়ে উঠবে, ঘুরেও দাঁড়াবে ।

যোগ্য, দক্ষ, সৎ কর্মকর্তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হলে অনিয়ম, দুর্নীতির ব্যাংকের অভ্যন্তরেই একটি প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তবে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে এবং দুরবস্থার ক্রমাগত অবনতি রোধে কেবল ১০ ব্যাংকের ওপর বিশেষ নজরদারির পরিবর্তে সবগুলো ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় তত্ত্বাবধান প্রয়োজন, এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।