প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


দুর্যোগ শব্দটি আতংকের। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে কোন দুর্যোগে সত্যিকার অর্থেই একটি মানবিক বাংলাদেশের ছবিই আমরা দেখতে পাই এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। কথায় কথায় যারা বলে মানবিক বাংলাদেশ এখন হয়ে উঠতে পারেনি আমাদের দেশ তাদের  ধারণা যে ভ্রান্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার জন্য বর্তমান বাংলাদেশের মানবিক চিত্র অবলোকন করা প্রয়োজন। ভৌগোলিক অবস্থানে সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশকে সবসময় বিপর্যস্ত দেশ হিসেবেই বলা চলে। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক দিক দিয়েই দুর্যোগের শিকার হচ্ছি তা নয়। মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগও আমাদের বেকায়দায় ফেলছে অনেক। 

অর্থনৈতিক দিকে দিয়েও উন্নয়নশীল দেশে অবস্থান করছি। তবে সম্প্রতি বাড়ছে মাথাপিছু আয় সাথে সাথে সুসংহত হচ্ছে অর্থনৈতিক অবস্থান। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হঠ্যাৎ করে আসার কারনে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে সরকারের জন্য এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরইডি ও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউএনডিআর যৌথভাবে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সে অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ১০টি দেশের মধ্যে ৮টি এশিয়া মহাদেশে এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ গুলোর মধ্যে অন্যতম ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস, কালবৈশাখী ঝড় ও টর্নেডো, বন্যা, নদী ভাঙ্গন, লবণাক্ততা, খরা, আর্সেনিক, ভূমিকম্প ও সুনামি ছাড়াও রয়েছে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। প্রত্যেকটি দুর্যোগ নিত্যনতুন জটিলতা নিয়ে হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে। আর একটি দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পর আরেকটি দুর্যোগ সামনে চলে আসছে খুব দ্রুত। যার ফলে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে যাচ্ছে কঠিন। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম বন্যা।

গত কয়েকদিন আগে সুনামগঞ্জ সিলেট নেত্রকোনায় ব্যাপক বন্যা দেখে দিয়েছে। এসব অঞ্চলে এত বড় দেখো গিয়েছিল প্রায় ১২২ বছর আগে। মূল আলোচ্য বিষয়টি হলো এতসব দুর্যোগে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ত্রাণ কার্যক্রমে যে নিবিড় সমর্থন তা সত্যিকার অর্থে আশা জাগানোর মতো। আমরা যদি পিছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখা যাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের ভয়াবহ চিত্র। সে সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সমর্থনে মানুষের পরিমাণ ছিল খুই কম। বেশির ভাগ মানুষই একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে এসেছে। সকল সংকটে পাশে থেকেছে একজনের সাথে আরেকজন। সে সময়ে সাম্প্রদায়িকতার বীজ খুব একটা রোপিত হয়নি। এদেশে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুরা একত্রে বসবাস করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে না হলে পরিস্থিতি হতো আরো ঘোলাটে। আমরা যদি এভাবে প্রত্যেকটি দুর্যোগের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই এক মানবিক বাংলাদেশের চিত্র।

২০১৭ সালে যখন পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ এদেশে আশ্রয়ের জন্য আসে তখন শত সীমাবদ্ধতা থাকার পর তাদেরকে আমাদের দেশে জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে আমাদের দেশ সারা পৃথিবীতে মানবিকতায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সরকারের পাশাপাশি দেশের সাধারণ জনগণও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে এমন কি এখনও করে যাচ্ছে। সম্প্রতি সীতাকুন্ডের বিএম ডিপোতে অগ্নিকান্ডের পর অগ্নিদগ্ধদের হাসপাতালে ভর্তি করার পর ব্যাপক পরিমাণে রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্ত এক্ষেত্রে অভাব হয়নি কোন রক্তের। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ও সাধারণ জনগণ রোগীদের পাশে দাঁড়ায়। সাহায্যের বিষয়গুলো দেখতে অনেকক্ষেত্রে ছোট মনে হলেও এর তাৎপর্য অনেক বড়। বিপদের সময় ছোট পরিমাণে সাহায্য অনেক বড় মনে হয় ।

প্রতিটি বড় বড় অগ্নিকান্ডের সময় ফায়ার সার্ভিসের পাশে থেকে আগুন নেভাতে সাহায্য করে থাকে সাধারণ মানুষ। আর ছোট ছোট অগ্নিকান্ড ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসার আগেই নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম হয় সাধারণ জনতা। প্রত্যেকটি বিপর্যয়ে দেশের ধনী শ্রেণির ব্যক্তি কিংবা বড় বড় গ্রুপ কোম্পানি থেকে আগে আসে সাধারণ মানুষ অন্যকে সহায়তা করার জন্য। এসব সহযোগিতাকে কখনও আর্থিকভাবে মূল্যায়ণ করা যাবে না। এসব সহযোগিতায় থাকে মনের ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। দেশে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মানবিক সংগঠন বাদেও প্রত্যেকটি সাধারণ সংগঠনের রয়েছে মানবিক দিক যার ফলে সাধারণ সংগঠনগুলো বাড়িয়ে দিচ্ছে সাহায্যের হাত। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার সময় আমরা দেখি সিনিয়ররা হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে নবীনদের প্রতি। হলে থাকা খাওয়া এমনকি পরীক্ষার দিন হলে নিয়ে যাওয়া সীট খুঁজে দেওয়া থেকে শুরু করে ফলাফল হওয়ার পর ভর্তি ক্ষেত্রেও সাহায্য সহযোগিতা করা।

অনেক ক্ষেত্রে নিজের স্বার্থ ও লোকদেখানোর জন্য হলেও যারা বিপদগ্রস্থ তাদের জন্য এসব কার্যক্রম অসীমই মনে হয়। এমনকি আমরা দেখছি টাকা পয়সার অভাবে কারো লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দিলে এগিয়ে আসছে মানুষ। বর্তমানে প্রেক্ষাপটে এমন দেখাচ্ছে যে মানুষ সাহায্য করতে চায় কিন্তু সঠিক জায়গা পায় না বা সাহায্য করলেও অনেকক্ষেত্রে সঠিক জায়গায় পৌঁছে না যার ফলে মন বাঁধাগ্রস্থ হয় সাহায্যের ক্ষেত্রে। তবে সমস্যা হলো সতিক্যর অর্থে আমরা ভালো দিকটা সবসময় মূল্যায়ণ করি না এমনকি নেগেটিভ চিন্তা চেতনায় মানবিক দিকগুলোকে বিষিয়ে তুলি। সমাজে সবসময় নেগেটিভ চিন্তা ধারা ভালো কাজগুলোকে আটকে দিচ্ছে তথাপি সমাজ ব্যবস্থায় মানবিক দিকগুলোও যথেষ্ট পরিমাণে এগোচ্ছে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। শুধু যে কেবলমাত্র প্রাকৃতিক বিপর্যয় তা কেবল নয় মানুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগেও মানুষ এগিয়ে আসছে একজন অন্যজনকে সাহায্য করার জন্য।

তবে অনেক ক্ষেত্রেই সাহায্য করার সময় সাহায্যকারী বিপদে পরে যাচ্ছে যার ফলে অনেক সময় মানবিক দিকের উল্টো বার্তা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে। আরেকটি কথা না বললেই নয় । সম্প্রতি বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এক করোনার কারনে মহাবিপর্যয় কাল অতিক্রম করছে। করোনা কালে দেশে আমরা কি দেখেছি ? দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অস্থির হয়ে উঠেছিল। ঘর থেকে বের হতে না পারার কারনে সাধারণ মানুষের ঘরে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসে দেশের বিত্তবান ও বিভিন্ন মানবিক গোষ্ঠী। এছাড়াও প্রথম অবস্থায় করোনায় মারা যাওয়ার পর লাশ দাফন অথবা দাহ করার মতো লোক পাওয়ার ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয়।

কিন্তু আস্তে আস্তে এসব কাজ করার জন্য জীবনবাজি রেখে একাজে এগিয়ে আসে দেশের সাধারণ মানুষ। ডাক্তররা কেবল পেশার খাতিরে নয় মানবিক বিবেচনায়ও এগিয়ে এসেছে রোগীদের বাঁচানোর জন্য না হলে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যার যে অবস্থা তাতে ভয়াবহ অবস্থা হতে পারতো। হাজার হাজার ঘটনা ঘটে যাচ্ছে ছোট ও বিশাল এ জনগোষ্ঠীর দেশে। সকল কিছুই সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় তাই এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ মানুষকে তেমনি উৎসাহ দিতে হবে ভালো কাজ করা মানুষদের। তাহলেই দেশে জন্ম নিবে মানবিক মানুষ। দেশ হবে সুস্থ্য ও সুন্দর।


লেখক :শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।