আবীর আহাদ


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারত সফরে রয়েছেন। এ সফরকে কেন্দ্র করে জনমনে অনেক কৌতূহল ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ ভারতের সঙ্গে আমাদের  রয়েছে অগণন অমীমাংসিত বিষয়। সেসব বিষয়ের সন্তোষজনক সুরাহা হলে উভয় দেশই লাভবান হবে। যদিও তা মোটেও সহজ নয়। বলা চলে যুগ যুগ ধরে দ্বিপক্ষীয় নানান সমস্যা ঝুলে রয়েছে। তবে দেশের সরকার প্রধানের সফরে এসব সমস্যার জট কিছুটা হলেও খুলতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কেবল নিকট প্রতিবেশীসুলভ নয়। এর চেয়েও অনেক বেশি। দু' দেশের মানুষের ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি, আবেগ, মূল্যবোধ ও স্বার্থের এক অপূর্ব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে এক বিশেষত্ব দান করেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল অনন্য। যদিও কালের বিবর্তনে মুক্তিযুদ্ধকালীন উভয় দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে গড়ে উঠা অপূর্ব সমন্বয় ও সমঝোতা সন্দেহ ও অবিশ্বাসের চোরাগলিতে হারিয়ে গেছে। তারপরও উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ অনেক ঘটনা এখনও পরস্পরকে প্রভাবিত করে। এখনও ভারতে ধর্মীয় সহিংসতার কোনো ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। নানাবিধ বৈরিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ বেড়াতে, পড়তে ও চিকিৎসা নিতে ভারতে যায়। বিভিন্ন খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য, মেশিনারি, পোশাক, চিকিত্সা, টিভি সিরিয়াল, সিনেমা, সঙ্গীত ইত্যাদির জন্য বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি ভারতের ওপর নির্ভরশীল।

গত দেড় দশকে উভয় দেশের সম্পর্কে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সম্পর্কটা ঠিক ‘সন্তোষজনক’ পর্যায়ে উপনীত হতে পারেনি। এর জন্য ভারতের ‘অপরিণামদর্শী রাষ্ট্রীয় নীতি’ (যেমন নাগরিকত্ব বিল) যেমন দায়ী, বাংলাদেশের কূটনৈতিক অদক্ষতা ও ‘ভারতবিরোধী প্রচারণা’-র রাজনীতিও বেশ দায়ী। যদিও এসবের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে উভয় দেশের সরকার ও জনগণের স্বার্থ ও আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয় মূলত ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর। তখন ভারত-বিরোধী রাজনীতি পরিচর্যা করায় সরকারিভাবে আনুষ্ঠানিকতা বজায় থাকলেও জনগণের পর্যায়ে এসে দুই দেশের মধ্যে এক বড় ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়, যা পরবর্তীকালে দুই দেশের সম্পর্ককে কখনো কখনো প্রায় বৈরিতার পর্যায়ে ঠেলে দেয়।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কারের এক বড় সুবিধাভোগী হয়ে ওঠে ভারত এবং বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে। দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি দুই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের এজেন্ডায় প্রধান বিষয় হিসেবে উঠে আসে। তবে নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়ে ধারাবাহিকতার বাইরে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বরং ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবৈধ অভিবাসন ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদদানের অভিযোগ উত্থাপন করে।

১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টনের বিষয়ে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের নতুন বিন্যাসকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের নতুন সরকার পানির হিস্যা অর্জনে মোটামুটি সফল হয়। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুর অবদানের কথা এ ক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হয়। এই সময়ে নিরাপত্তা বিষয়েও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে চুক্তি ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছাড়া সম্ভব হতো না বলে অনেকেই মনে করেন।

প্রথমেই স্থলসীমানা চিহ্নিতকরণসহ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সীমান্ত সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভিসা-পদ্ধতি সহজীকরণ, চালু যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে গ্রাহকবান্ধব করে তোলা, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিনিময়ের মতো বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের অংশীদার অন্যান্য আঞ্চলিক দেশকে সম্পৃক্ত করে, বিশেষ করে, অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন ও ব্যবহার, জ্বালানি নিরাপত্তা, আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিশেষ করে, স্থল ও জলপথে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে পারস্পরিক সুবিধা লাভের জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, সন্ত্রাস দমন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত বিপর্যয় ঠেকাতে যথোপযুক্ত সহযোগিতার বিষয়ও বিবেচনায় রাখতে হবে।

এ জন্য দরকার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতি। প্রয়োজন বাংলাদেশের কূটনৈতিক কাঠামোকে আরও বেশি কার্যকর ও শক্তিশালী করা এবং একইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পেশাদার সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য ‘ভারতনীতি’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া। মনে রাখা দরকার যে, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্কের বিষয়টি ভাবাবেগ দ্বারা পরিচালিত নয়, বরং এটি একটি গভীর স্বার্থের বিষয়। এখানে প্রয়োজনে ছাড় দিতে হবে, প্রয়োজনে কূটনৈতিকভাবে দর-কষাকষি করে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। এটা হবে রবিঠাকুরের কবিতার মতো-‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে।‘ এটি আপাতদৃষ্টিতে কঠিন মনে হলেও তা একেবারেই অসম্ভব নয়।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে ৭টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। গত মঙ্গলবার দুপুরে এই সমঝোতা স্মারকগুলো সই করা হয়।

বাংলাদেশ ও ভারত যে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে সেগুলো হলো- কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলনের জন্য সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ ও ভারতের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক, ভারতের ভোপালের ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি ও বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ ও ভারতের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও প্রসার ভারতীর মধ্যে সমঝোতা স্মারক, স্পেস টেকনোলজি বা মহাকাশ প্রযুক্তি খাতে সমঝোতা স্মারক।

প্রথমেই স্থলসীমানা চিহ্নিতকরণসহ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সীমান্ত সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করা, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভিসা-পদ্ধতি সহজীকরণ, চালু যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে গ্রাহকবান্ধব করে তোলা, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি বিনিময়ের মতো বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের অংশীদার অন্যান্য আঞ্চলিক দেশকে সম্পৃক্ত করে, বিশেষ করে, অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন ও ব্যবহার, জ্বালানি নিরাপত্তা, আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিশেষ করে, স্থল ও জলপথে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্টের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে পারস্পরিক সুবিধা লাভের জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, সন্ত্রাস দমন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত বিপর্যয় ঠেকাতে যথোপযুক্ত সহযোগিতার বিষয়ও বিবেচনায় রাখতে হবে।

এ জন্য দরকার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতি। প্রয়োজন বাংলাদেশের কূটনৈতিক কাঠামোকে আরও বেশি কার্যকর ও শক্তিশালী করা এবং একইসঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পেশাদার সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সচেষ্ট হওয়া। মনে রাখা দরকার যে, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্কের বিষয়টি ভাবাবেগ দ্বারা পরিচালিত নয়, বরং এটি একটি গভীর স্বার্থের বিষয়। এখানে প্রয়োজনে ছাড় দিতে হবে, প্রয়োজনে কূটনৈতিকভাবে দর-কষাকষি করে নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। এটা হবে বিশ্বকবি রবিঠাকুরের সেই কবিতার মতো : দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে।’

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক।