বজলুর রশীদ : কানাডায় মাতৃত্বজনিত ছুটি (মেটারনিটি লিভ) প্রায় এক বছর। বাবাও ছুটি নিতে পারেন ৬ মাস। ছুটিতে থাকাকালে বাবা-মা বেতনের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ পেতে থাকেন দু’সপ্তাহ অন্তর নিয়মিতভাবে। সরকারি-বেসরকারি, ছোট-বড় যে, যে চাকরিই করুক না কেন এ সুবিধা সবার জন্য সমান। ২০০৯-এর ১৩ মে আমাদের মেয়ে জেমিমা হওয়ার পর আমার স্ত্রী লিমা এক বছর মেটারনিটি লিভে ছিল। তবে এ সময়ে সে ঘরে বসে ছুটি উপভোগ করতে পারেনি। ছুটির মধ্যে সে প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিল তার লেখাপড়া নিয়ে। জেমিমার বয়স এক মাস হতেই শুরু হয় তার টানা দু’মাসের প্লেসমেন্ট। এ সময়ে ঘর থেকে যে শেষে বের হতো তার দায়িত্ব ছিল জেমিমাকে ‘বেবি সিটার’-এর বাসায় দিয়ে নিজের কাজে যাওয়া। আবার যে আগে ফিরবে, সে বেবি সিটারের বাসা হয়ে জেমিমাকে নিয়ে ঘরে ফিরবে। কখনও লিমাকে, কখনওবা আমাকে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। বাইরে হয়তো ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে, কখনও মুষলধারে অবিরাম স্নো পড়ছে-এর মধ্যেই অনেক দিন জেমিমাকে স্ট্রলারে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়েছে। রাস্তায় এত বেশি স্নো, স্ট্রলারের ছোট্ট চাকাগুলো কিছুতেই ঘুরতে চাইতো না, বারবার আটকে যেতো। গায়ের সমস্ত শক্তি স্ট্রলারের পেছনে উজাড় করে দিয়েও কোনো কাজ হতো না। মনে হতো স্ট্রলারসহ বরং মাথায় তুলে নিয়ে হাঁটা এর চেয়ে সহজ। আমাদের বিল্ডিং থেকে বেবি সিটারের বাসা হেঁটে মাত্র ১০ মিনিটের রাস্তা, এই সামান্য রাস্তাটুকুই কখনও কখনও কত দূরের পথ মনে হয়েছে। বেবি সিটারের কাছে জেমিমাকে বেশি দিন রাখতে হয়নি। প্লেসমেন্ট শেষ করে লিমা যখন ফের কলেজ শুরু করেছে, তখন বেশিরভাগ দিন জেমিমাকে আমিই রাখতে পেরেছি। লিমা কলেজে যেত সন্ধ্যায়, বেশিরভাগ দিনই আমি আমার কাজ শেষে তার আগেই ঘরে চলে আসতে পারতাম। জেমিমাকে রাখার জন্য বেবি সিটারকে ঘণ্টা প্রতি আমরা দিতাম ৪ ডলার করে। দিনে ৯ ঘণ্টা থাকলে তাকে দিতে হতো ৩৬ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩ হাজার টাকা)। জেমিমার বেবি সিটার ওই একই সময়ে আরও একটি বেবি রাখতেন। ওই পিচ্চিটা জেমিমার চেয়ে একটু বড় ছিল। দুটি মাত্র বেবি দেখাশোনা করে ওই বেবি সিটার ঘরে বসে সংসারের কাজকর্ম করে নিজের সন্তানাদি দেখভালের পাশাপাশি দিনে আয় করতেন বাংলাদেশি টাকায় ৬ হাজার টাকা। চাকরি মন্দ না!

মেটারনিটি লিভ চলাকালে ‘ডে কেয়ার’ এর সাবসিডি (সরকারি অর্থ সহযোগিতা) পাওয়া যায় না। সরকার চায় মেটারনিটি লিভের পুরো সময়টা মা শিশুর সঙ্গে কাটাক। শিশুর প্রথম বছরে ডে কেয়ারে বা বেবি সিটারের কাছে রাখা সরকার-পক্ষ পছন্দ করে না। এ ব্যাপারে কোনো প্রকার ব্যাত্যয় ঘটলে এবং সরকার তা জানলে মেটারনিটি লিভের অর্থ প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়। কানাডা সরকার শিশুর প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল। বেবি হওয়ার দিন থেকে সরকার ‘চাইল্ড ট্যাক্স’ দেয়া শুরু করে। বেবির বয়স ১৮ বছর হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে। জেমিমার জন্য আমরা মাসে প্রায় ২শ’ ডলার করে পাই। ১৮ বছর হওয়া পর্যন্ত এ অর্থ সে কানাডিয়ান সরকারের কাছ থেকে পেতে থাকবে। এমনকি জেমিমা আগামীকাল থেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বাস শুরু করলেও এ সুবিধা সে ভোগ করবে। জেমিমার টেককেয়ার করার জন্য প্রতি মাসে লিমা পাচ্ছে একশ’ ডলার করে। এ সুবিধা সে পাবে জেমিমার বয়স ৬ বছর হওয়া পর্যন্ত। মা তার নিজের সন্তানের যত্ন-আত্তি করার জন্যও সরকারের তরফ থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাচ্ছে! মেটারনিটি লিভ শেষ হওয়ার এক মাস আগে থেকেই ডে কেয়ারের সাবসিডি শুরু হয়ে যায়। বেবির বয়স ৮ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত এ সাবসিডি পাওয়া যায়। জেমিমাকে ডে কেয়ারে রাখা শুরু করা হয়েছে ২০১০ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে। ওর বয়স তখন ১১ মাস। প্রথম এক মাস ছিল জেমিমার জন্য ট্রেনিং পিরিয়ড। মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য রাখা হতো। আমরা শুনেছি, কোনো বাচ্চাই ডে কেয়ার পছন্দ করে না। জেমিমার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। সে কী কান্না! ওর বলা প্রথম শব্দ ‘নো’। ডে কেয়ারের টিচারদের দেখা মাত্রই ও শুরু করতো নো, নো বলা।

মেটারনিটি লিভ শেষে ৩ মে ২০১০ তারিখে লিমা কাজে যোগ দিলে শুরু হয় জেমিমার উদয়-অস্ত ডে কেয়ারে থাকা। ডে কেয়ার শুরু হয় সকাল ৭টায়, বন্ধ হয় বিকেল ৬টায়। সাপ্তাহিক ছুটির দু’দিন (শনিবার-রবিবার) ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন খোলা। বেবি সিটারকে ঘণ্টায় আমরা দিতাম ৪ ডলার করে। এখন ডে কেয়ারে পুরো দিনের জন্য আমরা দিচ্ছি ৬ ডলারের মতো। আমাদের হয়ে বাকি অর্থ দিচ্ছে সরকার। আর এটাই হচ্ছে সাবসিডি। প্রতি বছরে একবার সাবসিডি অফিসের লোকজন বাবা-মাকে ডাকেন মিটিংয়ে। এই বৈঠকে নির্ধারিত হয় আগামী এক বছর দৈনিক কত ডলার করে প্যারেন্টকে ডে কেয়ারে পে করতে হবে। গত বছরের পুরো পরিবারের মোট আয়ের ওপর নির্ভর করে কোন পরিবার কী পরিমাণ সাবসিডি পাবে। যে পরিবারের আয় যত বেশি সে পরিবার সাবসিডি পায় তত কম। যাদের আয় বছরে ২০ হাজার ডলারের কম, সরকার সে পরিবারকে পুরো সাবসিডি দিচ্ছে। তাদের বেবি ডে কেয়ারে রাখতে, একটি পয়সাও তাদের পে করতে হয় না। সরকার তাদের হয়ে সব অর্থ শোধ করে। আবার যে পরিবারের আয় ৭০ হাজারের ওপরে সরকার তাদের একটি পয়সাও সাবসিডি দিচ্ছে না। এ ধরনের পরিবারের একটি বেবি ডে কেয়ারে রাখতে মাসে গুনতে হয় কমপক্ষে ১৫শ’ ডলার। সরকার এখানে ‘তেলা মাথায় তেল দেয় না’। বরং এখানে যারা অতিরিক্ত সামর্থ্যবান, সরকার নানা কৌশলে তাদের কাছ থেকে ট্যাক্স নিয়ে, যাদের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে’ তাদেরকে সহযোগিতা দিচ্ছে।

(বিআর/এম/মে ১০, ২০১৩)