চাঁদপুর প্রতিনিধি : জাতীয় মৎস্য সম্পদ ইলিশ মাছের নিরাপদ প্রজনন সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চাঁদপুরের মেঘনা এবং পদ্মায় চলছে মা ইলিশ নিধনের উৎসব। মতলবের ষাটনল থেকে হাইমচরের চরভৈরবী পর্যন্ত মেঘনার ৬০ কি.মি. নদী এখন ইলিশ শিকারীর দখলে। নদীর পাড়ে প্রকাশ্যে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ইলিশের। ব্যাগ ভরে মাছ কিনে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

মা ইলিশ রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন সোচ্চার থাকলেও দল বেঁধে জেলে এবং জনগণ সবাই ইলিশ ধরা, ক্রয়-বিক্রয়ের পক্ষে থাকায় অভিযান সফল হতে পারছে না। ইলিশ আটক নিয়েও চলছে বাণিজ্য এবং মাছ ভাগাভাগি। জাল নৌকা জেলে আটক করে নৌ-পুলিশের বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদবাজির অভিযোগ। প্রকৃত মৎস্য ব্যবসায়ীরা আড়ত বন্ধ রাখলেও নদীর পাড়স্থ মৎস্য আড়তে হরদম চলে ইলিশের আড়তদারি।

সবদিক পর্যালোচনায় প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিমত, ইলিশ প্রজনন রক্ষা অভিযান তো নয়, এ যেনো ইলিশ নিধন, বিক্রি, সংগ্রহ এবং কম দামে ইলিশ খাওয়ার উৎসব। মা ইলিশ রক্ষা আইন যেমন জেলেরা মানছে না, পাবলিকও মানছে না। পরিকল্পিতভাবে প্রশাসনের অভিযান পারিচালিত না হওয়ায় সমূলে ইলিশ ধ্বংসযজ্ঞের মহড়া বেশি হচ্ছে। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। চাঁদপুরে যে হারে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ আহরণ হচ্ছে, আগামী ভরা মওসুমে ইলিশ উৎপাদনে এ বছরের চেয়েও আরও খারাপ পরিস্থিতি হবে।

প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেরই অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পাবলিকের মাছ আটক করে নিয়ে যায়। কিন্তু যারা মাছ বিক্রি এবং আড়তদারি করছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিপুল পরিমাণ ইলিশ পুলিশ, কোস্টাগার্ড আটক করলেও পরবর্তীতে জেলা টাস্কফোর্সের কাছে মাছ আটকের সঠিক পরিমাণ তুলে ধরা হচ্ছে না। প্রতিদিনই ইলিশ আটকের ঘটনা ঘটছে। সেগুলো দুঃস্থদের মাঝে বিতরণ না করে যারাই আটক করছে তাদের আওতায় নিয়ে যাওয়ার পর সেই মাছ গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এমন অভিযোগ মানুষের মুখে মুখে।

যে কারণে ১১ দিনের মা ইলিশ রক্ষা অভিযান:

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে গত ৫ অক্টোবর হতে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত এ ১১ দিন চাঁদপুর মেঘনা এলাকাসহ দেশের চৌদ্দ জেলার নদ-নদীতে ইলিশ প্রজনন রক্ষায় ইলিশ আহরণ, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহণ এবং মজুদ নিষিদ্ধ করেছে। পূর্ণিমার আগে এবং পরের এগারো দিন প্রজনন সক্ষম ইলিশ মাছ দল বেঁধে সাগর থেকে ডিম ছাড়ার জন্যে মিঠা পানিতে আসতে থাকে। সাগর মোহনা ও নদ-নদীতে প্রজনন সক্ষম ইলিশ এ সময়ে ডিম ছাড়ে। নিরাপদে যাতে মা ইলিশ নদ-নদীতে ডিম ছাড়তে পারে, কোনোভাবেই যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্যে ইলিশ নিধন এ সময়ের জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। যাতে দেশের মোট ইলিশ উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।

যেভাবে মা ইলিশ ধরা হচ্ছে:
গত ৫ অক্টোবর অর্থাৎ ঈদের ১ দিন আগ থেকে মা ইলিশ রক্ষা অভিযান শুরু হয়। সেদিন থেকেই নদীতে মাছ ধরার জন্য জাল, নৌকা নিয়ে নেমে পড়ে শত শত জেলে। জাল ফেললেই বড় বড় ইলিশ। লোভনীয় ব্যাপার। কোনো জেলেই এখন ঘরে বসে নেই । সবাই নেমে পড়েছে মাছ ধরার জন্যে। স্রোতের বিপরীতে জাল ফেলা হচ্ছে। প্রতি নৌকায় ৩/৪ জন জেলে। ২৪ ঘণ্টাই তারা মাছ ধরতে জাল ফেলছে। ফিশারি, নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ডের স্পীড বোট কিংবা ইঞ্জিন চালিত নৌকা নদীতে দেখলেই জেলেরা দূর থেকে তাদের অনুসরণ করে। অবস্থা বেগতিক দেখলে নৌকা কিনারে চাপিয়ে দেয়। প্রশাসনের বোট চলে গেলে আবার পুরোদমে শুরু করে ইলিশ শিকার। মাছ ধরা পড়লে সেগুলো বিক্রির জন্যে নদীর পাড়, খালের মুখ ও আড়তে নিয়ে আসে।

যেভাবে রক্ষা পেতে পারে মা ইলিশ:
সাধারণ মানুষের মতে, চলমান অভিযানে মা ইলিশ রক্ষা করতে হলে নদী পাড়ের আড়তগুলোতে ও খালের মুখে পুলিশ পাহারা বসিয়ে রাখতে হবে। নদীর ৪/৫টি স্থানে সার্বক্ষণিক কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশের টইল রাখলে জেলেরা মাছ ধরতে সাহসও পাবে না, মানুষ দল বেঁধে কিনতেও আসবে না।

পাবলিক ইলিশ কিনে যেভাবে:
ঈদ, পূজার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে সবাই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব একে অপরকে ফোন করে জানায়, সস্তায় বড় বড় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। চাঁদপুর জেলার সব প্রান্তের মানুষ এমন লোভনীয় খবরে মাইক্রোবাস, সিএনিজ স্কুটার, মোটর সাইকেল এমনকি অ্যাম্বুলেন্স নিয়েও নদীর পাড় অভিমুখে রওয়ানা হয়। দিন-রাত সব পেশার মানুষের থাকে জনস্রোত। হাতের কাছেই থলে কিনতে পাওয়া যায়। এক কেজির বেশি বা তার চেয়ে কিছু কম পরিমাণের এক হালি ইলিশ জেলে নৌকার পাশেই দাম হাঁকা হয় হাজার, ১২শ’ টাকা। যার পছন্দ হয় সে সাথে সাথে যে কয়টা মাছ সম্ভব কিনে ব্যাগে করে বাড়ি নিয়ে যায়। অনেকে আরও সস্তায় কেনার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীর পাড়ে অবস্থান করে। পুরুষের পাশাপাশি মহিলা ক্রেতার সংখ্যাও কম নয়। মাছ নিয়ে যাবার সময় তাদের অনেকের মাছ কেউ কেড়ে নিচ্ছে, আবার আইনের লোক আটক করে নিয়ে যাচ্ছে।

যে কারণে নদীর পাড় অরক্ষিত থাকছে:
প্রশাসনের লোকজন আসছে, এমন খবর আগে ভাগেই জেনে যায় আখনের হাট, পুরাণবাজার রণা গোয়াল, দোকানঘর, বহরিয়াসহ অন্যসব স্পটের ইলিশ আড়তদাররা। তাদের লোক রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। মোবাইল ফোনে তারা প্রশাসনের খবর জানিয়ে দিলে ইলিশ ক্রয়-বিক্রয় এবং আড়তদারি মুহূর্তের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। জেলেরা লগি ঠেলে তাদের নৌকা সরিয়ে ফেলে। প্রশাসনের ভয়ে যারা ব্যাগে রাখা মাছ লুকিয়ে রাখে, নজরে পড়লে তাও আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রশাসনের লোক চলে গেলে আবার শুরু হয় ইলিশ ক্রয়-বিক্রয়।

যেসব এলাকায় ইলিশ নিধন, ক্রয়-বিক্রয় ও আড়তদারি হয়:
চাঁদপুর সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর চর, এ চরের পশ্চিমে পদ্মা নদীর মোহনা বিষ্ণুপুরের লালপুর, আনন্দ বাজার, সফরমালী, মাদ্রাসা লঞ্চ ঘাটের পশ্চিমে খালের মুখ, পুরাণবাজার হরিসভা থেকে নামার রণা গোয়াল, দোকানঘর, বহরিয়া, লক্ষ্মীপুর, হরিণা ফেরি ঘাট, গাজী বাড়ি খাল, রাঢ়ী বাড়ি খাল, হরিণা স্কুলের পাশে, নন্দীগো দোকান, আখনের হাট, মেঘনার পশ্চিমে ইব্রাহিমপুর ইউনিয়ন চর এলাকা, আলু বাজার, ঈদগাহ বাজার, চর মুকুন্দি, হাইমচরের কাটাখালী থেকে চরভৈরবী এবং শরিয়তপুরের গোসাইর হাট পর্যন্ত এসব এলাকার শত শত জেলে এখন মা ইলিশ রক্ষা অভিযানের মধ্যেও মাছ ধরছে। সেখানেই নদীর পাড়ে মাছের আড়ত এবং ভাসমান অবস্থায় জেলেদের আহরিত ইলিশ ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে।

পুলিশের ইলিশ ও জেলে নৌকা আটক বাণিজ্য:
১১ দিনের ইলিশ রক্ষা অভিযানকে পুঁজি করে হাইমচর থানা, নীলকমল ফাঁড়ি ও আলু বাজার নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। জেলে ও এলাকার লোকজনের অভিযোগ, মাছ ধরার অপরাধে নৌ-পুলিশ ও থানা পুলিশ একের পর এক জেলে নৌকা আটক করার পর এক হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা এবং ১০ হাজার টাকা আদায় করে ছেড়ে দিচ্ছে। অনেক জেলে পরিবার জাল-নৌকা ছাড়িয়ে আনতে দূর থেকে বিকাশের মাধ্যমেও টাকা পরিশোধ করেছেন। আটক করা ইলিশ আত্মসাতের অভিযোগও পুলিশের বিরুদ্ধে।

চলমান অভিযান সম্পর্কে বিভিন্ন মহলের বক্তব্য:
চলমান অভিযানের অগ্রগতি, অনিয়ম, সমন্বয়হীনতা এবং ইলিশ প্রজনন রক্ষা কার্যক্রমের সফলতা প্রসঙ্গে জেলা টাস্কফোর্স ও ইলিশ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রধান ইলিশ গবেষক ড. মোঃ আনিছুর রহমান জানান, যে হারে প্রজনন সক্ষম ইলিশ নিধন হচ্ছে তাতে দেশের টোটাল ইলিশ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর প্রভাব পড়বে আগামী ইলিশ মওসুমের উপর। প্রজনন মৌসুমে পরিপক্ক ইলিশকে নিরাপদে ডিম ছাড়তে সুযোগ দিতে হবে। তার মতে, এভাবে জেলেরা যদি ইলিশ ধরতেই থাকে ইলিশ উৎপাদন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। যেভাবেই হোক প্রতিরোধে প্রশাসনিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।
জেলা টাস্কফোর্সের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাসুদ আলম সিদ্দিক জানান, নদীতে জেলেরা অবৈধভাবে মাছ ধরতে এবং মানুষ যাতে কিনতে না পারে জেলা প্রশাসকের নির্দেশ অনুযায়ী জেলা টাস্কফোর্সের ৬টি মোবাইল টিম সার্বক্ষণিক কাজ করছে। ৪টি জায়গা চিহ্নিত করে বসানো হয়েছে চেক পোস্ট। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এ কাজে প্রশাসনের মধ্যে যারাই অনিয়ম করবে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। টাস্কফোর্সের সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে জানিয়ে তিনি ২/১ দিনের মধ্যে ইলিশের প্রজনন রক্ষা কার্যক্রমে আরও ভালো রেজাল্ট পাওয়ার আশ্বাস দেন।
পুলিশ সুপার মোঃ আমির জাফর জানান, নদীতে সারাক্ষণ টইলের পাশাপাশি নদীর পাড়ের আড়তগুলোকে নিয়ন্ত্রণে পুলিশের চেষ্টার ত্রুটি নেই। আগামী কয়েক দিনও তা অব্যাহত থাকবে। পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় এমন কাজ না করার নির্দেশ রয়েছে। তিনি জাতীয় মৎস্য সম্পদ রক্ষায় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং এলাকায় যাদের প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে তাদের সহযোগিতা কামনা করেন। চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুর রহমান জানান, জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে ইলিশ রক্ষার এ অভিযান অনেক সময় ব্যর্থ হচ্ছে। তারপরও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। জেলেরা সচেতন না হলে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব নয়।

কোস্টগার্ড চাঁদপুর স্টেশন কমান্ডার লেঃ হাসানুর রহমান জানান, দিন রাত ২৪ ঘণ্টাই কোস্টগার্ডের টহল নদীতে রয়েছে। কোস্টগার্ডের কোনো সদস্য আটক মাছ নিজেরা ভাগাভাগি করে নেয়ার এমন অভিযোগ কেউ করতে পারে। তবে তা সত্য নয়। আমার পক্ষ থেকে তা করতে দেয়া হয় না। কোস্টগার্ড তার দায়িত্ব পালনে অবিচল এবং জেলা টাস্কফোর্সের সাথে সমন্বয় করেই কাজ করছে। চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান কালু ভূঁইয়া জানান, ইলিশ রক্ষার নামে লোক দেখানো অভিযান চলছে। টাস্কফোর্সের সভায় মৎস্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে যেসব স্পট চেক দেয়ার জন্য বলা হয়েছে সেই মোতাবেক পদক্ষেপ না নেয়ায় এমন ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা যেনো উৎসবে পরিণত হয়েছে। নদীর পাড়ের আড়তগুলো বন্ধ করতে হবে। প্রজননক্ষম ইলিশ রক্ষা না পেলে ইলিশ উৎপাদনের ক্ষেত্রে চরম সংকট সৃষ্টি হবে। এতে প্রকৃত মৎস্য ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা অর্থ লগ্নি করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

(এমজে/এটিআর/অক্টোবর ১১, ২০১৪)