রণেশ মৈত্র


বাল্যকালে গ্রামে বাস করেছি। প্রায় ১৪ বছর বয়স পর্য্যন্ত। অত:পর সেখান থেকে চলে এলাম জেলা শহর পাবনাতে। তাই উভয় স্থানের দুর্গোৎসব দেখার বিরল সুযোগ আমার জীবনে ঘটেছে। যে সময়কাল পর্য্যন্ত গ্রামে বাস করেছি সে সময়টা ছিল অখ-ভারত বৃটিশ শাসিত। ইংরেজ শাসকদের কল্যাণে উন্নত যান বাহন, ট্রেন সার্ভিস, বাস সার্ভিস, স্টীমার ও লঞ্চ সার্ভিস প্রবর্তিত হয়ে যাওয়ার ফলে দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে প্রিয়জনদের সাথে মিলিত হতে অখ- ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সপরিবারে যেতে আসতে সচক্ষে দেখেছি। শুধু তাই নয়, ওই উপলক্ষ্যে দূল দূর এলাকা থেকে আমাদের আত্মীয়য়দের অনেকেই আমাদের গ্রামের বাড়ীতে অন্তত: সপ্তাহ খানেকের জন্যে আসতেন। কী আনন্দই না পেতাম তাঁদের আসাতে। তাঁরা আবার আমাদের ভাই-বোনদের জন্যে নানা ধরণের পোষাক, বইপত্র নিয়ে আসতেন। মায়ের সাথে মিলিত হতেন আগত মহিলা স্বজনেরা। রান্নাবাড়ি সকলকে নাওয়ানোর সে কী ধূম। তেমন একটা আনন্দঘন পরিবেশের কথা আজ কল্পনাতেও আনা সম্ভব হয় না।

মনে পড়ে, যদিও আমাদের বাড়ীতে কোন দিন দুর্গাপূজার আয়োজন হতো না-তবু পূজার এক-দেড় মাস আগে থেকেই বাবার সে কজী ব্যস্ততা। তিনি ঘরগুলি মেরামত করাতেন-প্রয়োজনে নতুন একটা টিনের ঘর তুলেও ফেলতেন। প্রয়োজন অনব্য কিছু নয়-পূজো উপলক্ষ্যে যাঁরা দূর-দূরান্ত থেকে আসবেন-শিশু, নারী ও পুরুষ-তাদের থাকবার ব্যবস্থা করা।

আবার মায়ের ব্যস্ততাই বা কম ছিলো কিসে? অন্তত: ১৫ দিন আগে থেকে ধানভানা, চাল তৈরী করা, মুড়ি, খই ভাজা, মোয়া বানানো, নারকেল তিলের নাড়– বানানো-ইত্যাদি কাজে মায়েল আর আসর ছিল না। বাড়ীতে পূজা নেই তাতে কি? পুজার উৎসব তো সর্বত্র।

একে একে কলকাতা, মেদিনীপুর, মাথাভাঙ্গা(দিনাজপুর) ও দাঁড়ামুদা (পাবনা জেলার একটি গ্রাম যেখানে আমার বড় মেসো-মাসী থাকতেন) থেকে আত্মীয় স্বজন চলে আসতেন পূজার ছুটি উপভোগ করতে। এ এক মহামিলনের উৎসব যেন।

আমাদের গ্রামের নাম ভুলবাড়িয়া পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানাধীন। পাবনা শহর থেকে ১৫ মাইল উত্তরে ইছামতি নদীর তীরে। আমাদের গ্রামটি ছিল মুসলিম প্রধান। এক ঘর ব্রাহ্মণ, এক ঘর কায়স্থ, কয়েক ঘর পানচাষী (বারই বলে পরিচিতি) ৮/১০ ঘর পাল (যাঁরা মাটির পাতিল ও অন্যান্য ব্যবহার্য্য জিনিষ এক ধরণের কাঠের চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তৈরী করতেন) দু’এক ঘর নাপিত এই ছিল ভুলবাড়িয়াতে সেকালে হিন্দু বসতি। মুসলিম পরিবার ছিল অনেক বেশী সংখ্যায়। তাঁরা প্রধানত: কৃষি কাজ করতেন, বাড়ীতে পোষা গরুর দুধ বিক্রী করতেন (গ্রাহকদের বাড়ী বাড়ী পৌঁছে দিতেন) ইত্যাদি।

কিন্তু দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সে কী ধূমই না পড় যেত সারা গ্রাম জুড়ে। যে ২/৩ টি বাড়ীতে মূর্তি তুলে পূজার আয়োজন হতো-সন্ধ্যা লাগতে না লাগতেই প্রতিমা দর্শনের লক্ষ্যে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি থেকে পায়ে হেঁটে নারী শিশু পুরুষ দলে দলে আসতে দেখেছি। আরতির সময় ঢাকের বাদ্যের সাথে নানা ঢং এ আরতি যুবকদের অংশগ্রহণ দু’এক জন মুসলিম যুবকও অংশ নিত) এক ভিন্ন আবহ তৈরী করতো মহাসপ্তমী মহাষ্টমী ও মহানবমি এই তিনদিনের সন্ধ্যায়।
গ্রামাঞ্চলে তখনতো বিদ্যুতের নামই কেউ শুনি নি। রাস্তাঘাট সবই থাকতো অন্ধকার-তদুপরি সদ্য বর্ষা বিদায় হলেও পথের কাদা গ্রামাঞ্চলে পুরাপূরি শুকায় নি। এই অবস্থার মধ্যেই শত শত দর্শনার্থীর ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত।

যে বাড়ীর পূজা মণ্ডপে পূজার আয়োজন হতো-সেই বাড়ী ও আশপাশের বাড়ীগুলির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মন্দির প্রাঙ্গনে বা পাশের কোন নিরাপদ স্থানে যে হৈচৈ কলকাকলিতে মেতে উঠতো নানা বয়সের মেয়েরা, বিশেষ করে সদ্য বিবাহিত অবিবাহিত যুবতীরা নতুন শাড়ি, ব্লাউজ, চুল-বন্ধনী, সোনার গহনাদি পরে বাড়ী বাড়ী বেড়াত (নিজ বাড়ীর কাজ কর্ম সেরে), যেত প্রতিমা দর্শন নিজ গ্রাম ছাড়াও পাশ্ববর্তী গ্রামগুলিতে, মন্দিরগুলি ঘিরে যে সপ্তাহব্যাপী মেলা বসতো সেগুলিতে দিব্যি ঢুকে পড়েকেনা কাটা করতো যেমন কুলা, চালুন, ময়দা চালা-বেলুন, বেতের ও বাঁশের নানা পণ্য, বটি, কাঠি, নানাবিধ খাবার) তা আজ সেভাবে আর চোখে পড়ে না। সেই দিনগুলিতে কোন মন্দিরে, মেলায় বা পথে ঘাটে কোথাও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রহরা চোখে পড়তো না-পূজাকে সামন রেখে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে পূজার আয়োজকদের পূজার দিনগুলিতে সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের দাবীতে বৈঠকও করতে হতো না।

বাদ্যি-বাজনা সবই চলতো দিবারাত্র। তখন অবশ্য মাইক ছিল না-এত বেশী সংখ্যক মসজিদও ছিল না। মুসলিম পরিবারের ছেলে মেয়েরাও দিব্যি তাদের হিন্দু বন্ধু বান্ধবীদের সাথে পূজা দেখতে বের হতো-বিজয়ের পরদিন মিষ্টিমুখ করতে হিন্দুবাড়ীগুলিতে দল ধরে বিনা আমন্ত্রনেই যেত।

ঢাক-ঢোল-সানাই এর বাজনা কোন মসজিদ থেকে শুনা যেত না-তা নয়। কারণ গ্রামের নিঝুম পরিবেশে ঐ বাজনার আওয়াজ তো বহুদূর থেকেই শুনা যেত। কিন্তু কদাপি কোন মুসুল্লি মসজিদ বা বাড়ী থেকে তেড়ে আসেন নি বাদ্যি-বাজনার দাবী নিয়। ধর্মীয় সহনশীলতা সে কালে সবার মধ্যে বিরাজ করতো-যা আজ আর দেখা যায় না। সেই সহশীলতা যেন ক্রমশ:ই বিলুপ্তির পথে। মন্দিরে বাতের বেলায় আগুন দেওয়া, নির্মীয়মান দুর্গা, কালী ও অন্যান্য মূর্তি ভাঙ্গা আদৌ দেখি নি সে যুগে। তবে কি বলতে হবে-সে যুগে মুসলমানরা, হিন্দুরা আজকের তুলনায় কিছু কম শ্রদ্ধাশীল ছিলেন ধর্মের প্রতি।

শুধু কি মেয়েরাই? আমরা যারা ছোট ছোট ছেলে-যারা প্রাইমারী থেকে মাধ্যমিক সজ্জিত হতাম-রাতের বেলায় পূজা মন্দিরে আরতির নাচ দেখতাম অথবা কেউ কেউ তাতে অংশগ্রহণ ধূপতি হাতে নিয়ে। আরতি ও বোগের শেষে দল ধরে রাতের অন্ধকারে ছুটতাম সবজীর বাগানে ফুলকপি-বাঁধাকপি চুরি করে এনে মন্দিরে দিতাম পুন্য হবে এই বিশ্বাসে। তবে মন্দিরের মালিক বা নিজেদের অভিবাবকদেরকে দিব্যি বলতাম, এগুলি আমাদের বন্ধুদের বাড়ী থেকে তুলে এনেছি-তাঁরাও আনন্দের সাথে দিয়েছেন পূজার ভোগে লাগবে বলে। আসলে ওই চুরিরও যেন একটা আনন্দ ছিল যার উপভোগ থেকে কিছুতেই বিরত থাকতাম না।

হালের কাহিনী

অতীতের মত বিদ্যুত অভাবে আলো-আঁধারির পরিবেশে নয়-হাল আমলে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের মন্দিরেও, স্থায়ী বিদ্যুৎ সংযাগ না থাকলে, অস্থায়ী বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে আলো-ঝলমল পরিবেশে, মাইক্রোফোনে বাদ্যি-বাজনার শব্দ দূর দূরান্তরে ভাসিয়ে দিয়ে, শংখ-ঘন্টা ও উলুধ্বনিতে মুখরিত করে পূজা-আরতির অপয়োজন হলেও নমায, আজান প্রভৃতির সময়ে মাইকই না শুধু বাদ্যি বাজনা, শংখ-ঘন্টা-উলুধ্বনিও বন্ধ রাখতে হয়। পুলিশ-আনসার প্রহরা নিয়ে মন্দির ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। পূজার আগ আগ দিয়ে নানা স্থানে নির্মানাধীন দেব-দেবী মূর্তি ভাঙ্গা, মন্দিরে অগ্নিসংযোগ প্রতি বছরই কোথাও না কোথাও ঘটেই থাকে।

মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী, মহানবমীর সন্ধ্যায় আরতির ধূম-দর্শনার্থীর ভিড় থাকলেও মেয়েরা সোনার গহনা নিয়ে বেরোতে সাহস পান না। তাই নকল সোনারূপার গহনা পরে বেরিয়ে থাকেন। হিন্দুরা বাদ্যি-বাজনাকে পূজা ভোগ আরতির অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেন কিন্তু আজান নামাযের সময় তা বন্ধ রাখায় উৎসব যেন ব্যাহত হয়। এক্ষেত্রে সরকার মন্দির মসজিদ উভয় ক্ষেত্রে মাইক্রোফোনের আওয়াজ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করলে এই ক্ষুদ্র বিষয় সংক্রান্ত বিরোধ এড়ানো যেতে পারে। পক্ষ দুটিকে বুঝানো যায়, আজকের ৪০/৫০ বছর আগে না ছিল বিদ্যুত, না ছিল মাইক্রোফোন। তখন তো এগুলি ছাড়াই সর্বত্র যেমন পূজা-আরতি হতো, তেমনই আযান, নামাযও হতো। কাজেই মাইক্রোফোনের ভলিউম কমালে উৎসবের কারণ নেই। অষ্ট্রেলিয়ায় দেখেছি মন্দির মসজিদের ঘরের মধ্যে মাইক এমন বাজাতে হয় যাতে ঘরের বাইরে সামান্যতম আওয়াজও না যায়। দিব্যি এ নিয়ম মেনেই খৃষ্টানরা প্রতি রবিবারে এবং তাদের উৎসবের দিনগুলিতে, মন্দির মসজিদগুলিতে পূজা-আরতি বা আযান ও নামায অনুষ্ঠিত হচ্ছে অষ্ট্রেলিয়া ও পাশ্চাত্যের অপরাপর দেশগুলিতে।

বাংলাদেশে তাবৎ প্রতিকূলতা সত্বেও দুর্গা প্রতিমার সংখ্যা প্রতি বছরই কিছু কিছু করে বাড়ছে। অপরদিকে নিরাপত্তা পুলিশ আনসার ছাড়াও তাদের গম-চাল বা টাকা রিলিফ হিসেবে সরকারের কাছ থেকে নেওয়ার প্রবণতাও কি গ্রামে, কি শহরে, হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বাড়ছে। সরকারও ভোটের কথা ভেবে দিব্রি দুর্গাপূজায় এই ত্রাণ বিতরণ করে চলেছে। এগুলি বাজারে সস্তা দামে বিক্রী করে দিয়ে যে টাকা পাওয়া যায় সেটা পূজার কাজে লাগানো হয়। এই ভিক্ষুক সুলভ কারবার শত শত বছরে কদাপি চালু চিল না। চালু হলো এরশাদ আমলে আশির দশকে। তথন এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী জারী করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করায় হিন্দু ও অসাম্প্রদায়িক সকল নাগরিকের কাছে কঠিন সমালোচনার ক্ষোভের সম্মুখীন হন। এই সমালোচনার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হিন্দুদেরকে অন্যভাবে প্রলুব্ধ করার জন্য এই ভিক্ষাতুল্য ত্রাণ সামগ্রী দুর্গাপূজার সময় বিতরণের ব্যবস্থা করেন। হিন্দুরাও দিব্যি এই টোপ গিলল। এখন এই খয়রাতি পাবনার জন্যে তাদের চেষ্টা তদবিরের বিরাম নেই।

ছোট ছোট এক একটি শহরে এখন ৪০ থেকে ৫০ টি মূর্তি স্থাপন করে পূজার আয়োজন করা হয়-থানা পর্য্যায়ে হেড কায়ার্টারে সংখ্যা বিভাগ পূর্ব আমলের সর্বোচ্চ সংখ্যার চাইতে অনেক ক্ষেত্রে বেশী। কিন্তু স্বত:ষ্ফূর্ত আনন্দমুখর পরিবেশের অভাব।কারণ সন্ত্রাসী হামলার আতংক সকলকে সবদা উদ্বিগ্ন করে রাখে। ভিড়ের মধ্যে নারীদেহে ইচ্ছাকৃত আঘাত, গলার মালা, কানের দুল প্রভৃতি ছিঁড়ে নেওয়ার ঘটনা একোরে অনুল্লেখযোগ্য ভাবলে ভুল করা হবে। তদুপরি প্রতি মাসেই কোন না কোন স্থান বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটে চলেছে কিন্তু বিচার নেই।

যারা মন্দিরে আগুন দেয়-মুর্তি ভাঙ্গে-তাদের আইন আমলে এনে শাস্তি দেওয়ার কোন নজির নেই। ফলে একদিকে অপরাধীরা দুঃসাহসী হয়ে উঠছে অপরদিকে হিন্দুরা অধিকতর আতংকগ্রস্ত হয়ে উঠছেন এবং তার মধ্যেই তাঁরা পূজা উৎসবের আয়োজনও করছেন।

এত সব সত্বেও নেতা-নেত্রী, মন্ত্রী-এম.পিদের মুখে দিব্যি শুনছি, “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ”। এই মাত্র ফেসবুকে দুর্গামূর্তি ভাঙচুরের ছবি সহ খবর দেখলাম। তাতে বলা হয়েছে মানিকগঞ্জ জেলার হরিপুর উপজেলার ভাদিয়াখোলা গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছে। গ্রেফতারের খবর নেই।

লেখক : সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক।