ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আগামীকাল শনিবার মীনা দিবস ২০২২। মীনার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা হিসাব করে ১৯৯৮ সালে সার্কের পক্ষ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরকে মীনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর ২৪ সেপ্টেম্বর মীনা দিবস পালন করা হয়। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি উদযাপিত হবে।

দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েশিশুদের একান্ত পরিচিত প্রতীক হচ্ছে মীনা। সে হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের প্রতিনিধি। নয় বছরের মেয়েটির কাজই হলো কিসে সবার ভালো হবে, তা দেখা। মীনার জন্ম ১৯৯২ সালে। দেখতে দেখতে ৩০ বছর পার হলেও মীনা আটকে আছে সেই নয় বছরেই। আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা. এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন-মীনা একটি প্রতিবাদী চরিত্র। সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে অন্যতম চরিত্রের নাম মীনা। বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, স্বাস্থ্যসন্মত পায়খানা নির্মান ও ব্যবহারে উৎসাহিত করা, মেয়েদের স্কুলে পাঠানো, কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে থেকে স্কুলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, যৌতুক বন্ধ করা, ছেলে মেয়ে সমান পুষ্টি ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রভৃতি বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে অন্যতম চরিত্র। সে নিজে করে দেখায়। অন্যকে করতে শিখায়।

জনপ্রিয় এ কার্টুনটির জনক মোস্তফা মনোয়ার। ১৯৯৫ সালে বিটিভি মীনা কার্টুনটি দেখানো শুরু করে। মীনা কার্টুন তৈরি করেছে ইউনিসেফ। মীনা কার্টুন শুধু বাংলা ভাষায় তৈরি হয়নি। হিন্দি, উর্দুসহ ২৯টি ভাষায় মীনা তৈরি হয়েছে। কার্টুনের মূল চরিত্র মীনা তার পরিবারের সঙ্গে একটি ছোট গ্রামে বাস করে। এই চরিত্রের মাধ্যমে শিশুদের অধিকার, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিনোদন এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার চিত্র ফুটে ওঠে। সে সবার কাছে স্বাস্থ্য-সচেতনতা, পরিবেশ-সচেতনতা এবং শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছে।আর ৯০ এর দশকে যে শিশুরা বেড়ে উঠেছে তাদের জন্য এই লাইনগুলো অতি পরিচিত। শুধু পরিচিত বললে ভুল হবে, বরং এই গান শুনে বড় হয়নি এমন কাউকে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিশুদের প্রিয় মীনা কার্টুনের গানের দুটি লাইন এটি। কার্টুন সাধারণত শিশুদের বিনোদনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হলেও এটি শিক্ষামূলক একটি কার্টুন। যার মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে কন্যা শিশুর অধিকার নিয়ে এই কার্টুন সবসময় সচেতনতামূলক বিভিন্ন পর্ব নির্মাণ করেছে। আমরা সবাই মীনা কার্টুনের ব্যাপারে জানলেও কীভাবে এর শুরুটা ঘটলো তা অনেকেই জানিনা।

মীনাকে দক্ষিণ এশিয়ার মেয়ে শিশুদের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হয়। মীনা কার্টুন শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন ভাষায় নির্মিত জনপ্রিয় একটি টিভি কার্টুন। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা আর ভুটানে একযোগে প্রতিবছর মীনা কার্টুন প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে এর শুরুটা বাংলাদেশেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মূলত একটি কার্টুন চিত্র তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। ৮০ দশক ও ৯০ এর পরবর্তী সময়ে মেয়েদের অবস্থা ছিল করুণ। তখনকার সময়ে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে শুধু শহরেই কিছুটা অগ্রগতি ছিল।

গ্রামের বেশির ভাগ মেয়ের শিক্ষার অধিকার ছিল না। শহরেও যে সব মেয়েই পড়ালেখার সুযোগ পেত তাও না। তখন সবার ধারণা ছিল, মেয়েরা ঘর-সংসার করবে তাই তাদের লেখাপড়ার দরকার নেই। অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। শুধু তাই নয়, মেয়ের বিয়ের জন্য যৌতুকের ব্যবস্থাও করতে হত পাত্রী পক্ষকে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের ভালো ভালো খাবার দেওয়া হতো। মেয়েরাও যে নিজ যোগ্যতায় আর্থিক ভাবে দেশ ও নিজের পরিবারের উন্নতি ঘটাতে পারে তা কেউ চিন্তাই করতে পারত না।

গুনীজনরা বুঝতে পারলো এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশ ও জাতি কেউই এগোতে পারবে না। তখনকার সময়ের দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত সাতটি দেশ-বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা (পরে আফগানিস্তান যুক্ত হয়)। ১৯৯০ সালকে ‘মেয়েশিশু দশক’ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে মেয়েদের মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক অবস্থান, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত মেয়েশিশুদের অধিকার সংরক্ষণ, মেয়ে ও ছেলে শিশুদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং এ সম্পর্কে সব অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়। তবে এসব কাজ বাস্তবায়ন করা এত সহজ ছিল না, তারা এমন কিছু করতে চাইছিল যা সব ধরণের মানুষের কাছে পৌঁছাবে এবং তাদের মানসিকতা পরিবর্তনে সহায়তা করবে।

এই দেশগুলো মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিল, মেয়েশিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এমন কিছু করতে হবে, যা তাদের অবস্থার পরিবর্তনে সহায়ক হবে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এ দায়িত্ব নেয়। ইউনিসেফ এমন একটা চরিত্র সৃষ্টি করার কথা ভেবে দেখল, যে পড়ালেখা করে এবং মেয়েদের জন্য পড়ালেখা কেন প্রয়োজন তা তুলে ধরে, যা দেখে মেয়েদের মা-বাবারা বুঝতে পারবেন যে মেয়েদেরও লেখাপড়া করানো দরকার। এছাড়াও সমঅধিকারের ক্ষেত্রে কোন লিঙ্গ বৈষম্য যেন না থাকে তাও তুলে ধরতে হবে।আর সচেতনতার জন্য হাত ধোয়া, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার, বন্যার সময় করণীয়, মেয়েদের নিরাপত্তা, শিশুর ডায়রিয়া হলে কী করতে হবে, শহরে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন রোধ ও শিক্ষার সুযোগ প্রভৃতি বিষয়কে মীনা এত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে যে, শিশুসহ সব বয়সী মানুষের ভেতরে জেগে ওঠে আত্মসচেতনতা।

শিশুদের অধিকার রক্ষা

শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে ও মাদককে চিরতরে ‘না’ বলতে হবে। যৌন হয়রানি ও অশিক্ষাকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজ, পরিবার ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল ও এছাড়া অভিভাবকের সচেতনতা শিশু অধিকার রক্ষার পূর্বশর্ত। শিশু অধিকার একটি বহুমুখী ধারণা। যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও অধিকার লংঘন থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা একটি অপরিহার্য সামাজিক কর্তব্য। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করায় আমাদের শিশুদের একটি বিশাল সংখ্যা বেড়ে উঠছে দারিদ্র্যের ভেতর। এ শিশুরা অধিকার ও প্রয়োজনীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আর মা ও শিশু অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মায়ের অধিকার সুরক্ষা হলে, শিশুর অধিকার অনেকাংশে রক্ষা পায়।

একজন গর্ভবতী মা গর্ভাবস্থায় তার অধিকারগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে পেলে, জন্মের আগে থেকেই অনাগত শিশু ও তার অধিকার ও সুরক্ষা পেয়ে যায়। তাই শিশুর অধিকার ও নিরাপত্তা সুরক্ষায় সবার আগে পরিবারটিকেই কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিপর্যায়ে শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। নিরাপত্তা, বাসস্থান, খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ রাষ্ট্র স্বীকৃত সকল অধিকার এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। আর সেগুলো হতে হবে বৈষম্যহীন। অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, লিঙ্গ, গোত্র, শারীরিক কোনো শ্রেণিভেদে শিশুদের বিভাজন করা যাবে না। এসব পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন হলেই একজন শিশু সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে। যে শিশুটি হবে আমাদের আগামীর কর্ণধার। আর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। অবশ্য এখন কমতে শুরু করেছে।

জরিপে দেখা যায়, দরিদ্র পরিবারের অন্তত ৪০ শতাংশ শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। ৭৪ লাখ শিশু বিভিন্ন খাতে শ্রম দিচ্ছে। ৫৬ লাখ শিশু কোনো প্রকার শিক্ষাকেন্দ্রের আওতায় নেই। রাষ্ট্রের একার পক্ষে সম্ভব নয় সব শিশুর দায়-দায়িত্ব নেয়ার। শিশু অধিকার রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন আইন রয়েছে। এগুলো প্রয়োগে আরও কঠোর হতে হবে। দেশের সব শিশুকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করার জন্য সরকার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।আর প্রতিটি কর্মই হোক সুন্দর এবং শিশুদের জন্য সহযোগিতামূলক। আর এভাবেই মীনা দিবসের শ্লোগানের যথার্থতা ফুটে উঠবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।