| মাসুম আহমদ |

আমার সেই কোঁকড়া চুলওয়ালা বন্ধুটি একটু বেশি ভিজেছিল


প্রায়ই আমরা চার বন্ধু মিলে খোলা আসমানের নিচে গল্পগুজব করতাম। পাশে দাঁড়িয়ে থাকত একটা সাদা তিনতলা বাড়ি। মাঝেমাঝে বাড়ির রং আর আসমানের রঙ মিলেমিশে একাকার করে বৃষ্টি নিচে নেমে আসত। আমরা খোলা আসমানের নিচে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম অথচ কেউই ভিজতাম না। কারণ বৃষ্টি ছিল সাদা রঙ তিনতলা বাড়ির তিনতলার মেয়েটির নাম। একদিন দেখলাম বাড়িটা লাল করে সাজানো হয়েছে। লাল রং বাতিরা চোখ লাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে অনবরত চোখ টিপছে। সেদিনও বৃষ্টি নিচে নেমে এলো, আমরা ঠিক আগের মত করে খোলা আসমানে নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু আমরা চারজন সেদিন ভিজে গেলাম। একটু বেশি ভিজলো আমার সেই খাটো করে কোঁকড়া চুলওয়ালা বন্ধুটি, যে তিনতলা বাড়ির দিকে মুখ করে সবসময় দাঁড়াত।


ছোটবেলায় এক বাতাসা বিক্রেতার কাছ থেকে পুরানো কাঁচের বোতল দিয়ে একটা মন্ত্র কিনেছিলাম । মানুষকে ধরে রাখার মন্ত্র। জীবনে কতবার যে সে মন্ত্র পাঠ করেছি তার কোন হিসেব রাখেনি। তবে সে হিসাব আছে– কে আমায় ছেড়ে চলে গেল, কে বিদায় বেলায় কাঁদুকাঁদু হয়ে বলে গেল মনে রেখ, মাঝে মাঝে চিঠি দিও। সবাই চলে যায়, কাউকে কাউকে আবার চলে যেতে হয়। আসলে আমাদের কারোরেই কাউকে ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। সেটা জাপটে ধরে হউক আর মন্ত্র পড়ে হউক ।


অস্ত যাবার আগে একবার সোনালী রোদ হয়ে আড্ডা দিব মেঘলা বিকালের সাথে। তুমি প্রস্তুত থেক, তোমাকেও নিয়ে যাব। এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে বলে আমি অপেক্ষায় ছিলাম।

আমরা একবার মাতাল হতে বেরিয়ে পড়েছিলাম



একবার সদ্য বন্ধু বিয়োগের ব্যথা ভুলতে আমরা কয়েকজন বেরিয়ে পড়েছিলাম। জীবন গোছানোর জন্য কোন ধরণের সরঞ্জাম পাওয়া গেলে সেটা সংগ্রহ করে নিয়ে আসব, এই ধরনে একটা গোপন ইচ্ছাও মনে মধ্যে লুকানো ছিল। অনেকদূর গিয়েছিলাম যেখানে পরিচিত মুখ বলতে আমরা কয়েকজন আহত যুবক। ভাঙ্গাচোরা ডাকবাংলায় রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত হল। জায়গাটা অনেকটা দ্বীপের মত। চারদিক জলময়, ছোটছোট টেউয়ের মৃদু মায়াবী ছন্দ। রাতের রং ধবধবে ফর্সা, সুগন্ধি বাতাসে ঘুমপাড়ানি পরশ। এরকম পরিবেশে একজন বলল– চল আমরা আজ উচ্চাভিলাষী হই। আরেকজন বলল– চল আমরা আমাদের ভুলে গিয়ে আদিম মানুষ হয়ে যাই। পিছন থেকে একজন ব্যাগ থেকে আরজেলেনিকের বোতল বের কর বলল– এটা আমার এক স্কটিশ বন্ধু আমার জন্মদিনে উপহার দিয়েছে। চল সবাই আরজেলেনিকে আঘাতে আমরা আমাদের আরও আহত করি।


আমরা প্রথমে আরজেলেনিকে আঘাতে নিজেদের আরও আহত করলাম। তারপর নিজেদের ভুলে গিয়ে আদিম মানুষ হয়ে জলাশয়ের দিকে হাঁটা ধরলাম। আমাদের উচ্চাভিলাষ দেখে জলাশয় থেকে উঠে আসতে লাগল মৎসকন্যা আর মৎসবালকরা।


ওরা আমাদের জিজ্ঞেস করল – তোমরা এমন করছ কেন? এখানে কেউ মাতাল হয় না, এখানে সবাই সুখী হতে আসে। আমরা সমস্বরে বলে উঠি, বন্ধু হারানোর ব্যথা বুকে নিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। আমারা এখানে সুখী হতে আসি নাই, আমরা মাতাল হতেই এসেছি।

জীবন গোছানোর জন্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাদের মাঝেমাঝে মাতাল হতে হয়।

মৃত লোকগুলোর জীবিত ভাব নেয়ার দৃশ্যটি ছিল করুণ


উড়ন্ত পাখি লাফ দিয়ে ধরার শখ কয়জনের থাকে? এই প্রশ্নটা আমার মনে যখন প্রথম এসেছিল, তখন আমি দেখছিলাম – একটা মেয়ে শিশু লাফ দিয়ে পায়রা ধরার চেষ্টা করছে। পায়রাটি একবার কার্নিশে বসে তো তিনবার মেয়েটির মাথার কাছাকাছি উড়াউড়ি করে। তাই পায়রাটি যে দুষ্ট ছিল সেটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। আর বোঝতে পেরেছিলাম মেয়েটির চোখ কেন বারবার ছোট হয়ে আসছিল।


মইরা গেলাম গো, আমি একেবারে মইরা গেলাম। বৃদ্ধা মহিলার এইরকম চিৎকার রাস্তার ওপাশ থেকে একদল মৃত লোক উপভোগ করছিল। মৃত লোকগুলো এমনভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে বৃদ্ধা মহিলাকে দেখছিল যে, যেন তারা জীবিত, কোন কালেই তারা মারা যায়নি।

বৃদ্ধা মহিলার মৃত্যু দৃশ্যের চেয়ে মৃত লোকগুলোর জীবিত ভাব নেয়ার দৃশ্যটি ছিল করুণ ।


টুনাটুনি সংসারকে আলোকিত করে এক টুনটুনি এসে উপস্থিত। টুনা অনেক গবেষণা করে বের করলো টুনটুনি আগের জনমে রূপকথার রাজকন্যা ছিল। টুনি’র গবেষণায় বেরিয়ে আসলো টুনটুনি হল এনজেলের বাচ্চা। তাই টুনা টুনটুনিকে ডাকে রাজকন্যা, টুনি টুনটুনিকে ডাকে এনজেল। এভাবেই আস্তে আস্তে করে একটা সুখী পরিবারের জন্ম হল এবং আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে লাগলো।

যেই – সেই



মাথার উপরে উড়ছে যুদ্ধের কালো কবুতর। ছওয়াবের হিসাব করতে ক্যালকুলেটারের বাটন টিপছে কিছু মানুষ। কিছু মানুষ তাদের পরিচয় নিয়ে চেঁচামেচি করছে। মানবতা মানবতা বলে কিছু মানুষ চিৎকার করে ফাটিয়ে দিচ্ছে তাদের সুরেলা কণ্ঠ। আপাতদৃষ্টিতে বদলে গেছে মনে হলেও – আসলে কিছুই বদল হয়না। সেই অন্যায়-সেই অবিচার– সেই শোষকের দল- সেই পাপের ইতিহাস।


একদিন যারা পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পথ আঁকড়ে ধরে বসে ছিল শূন্য কলস নিয়ে পুকুর ঘাটে। তাদের কেউ কেউ আজ অত্যাধুনিক হওয়ার প্রচেষ্টায় লেক্সাস বা বিএম ডব্লিউয়ের স্পিডিংয়ে হাইওয়েতে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে । অন্যদিকে কেউ কেউ পুকুর পাড়ের বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া সুপারি গাছের মত ন্যুব্জ হয়ে ঘুরছে পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পথের সন্ধানে।