দেবেশ চন্দ্র সান্যাল


বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ এই নির্বাচনে ভোট গ্রহন অনুষ্ঠিত হয় ৭ ডিসেম্বর’৭০ ও ১৭ জানুয়ারী’৭১। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ টি আসনের ১৬০টিতে গণভোটে বিজয়ী হয় তৎকালীন বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ আনুপাতিক হারে আরো ৭টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের অধিকারী হয়। মোট ১৬৭টি জাতীয় পরিষদের আসনের অধিকারী হয়ে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। তখন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ছিল ৩১৩ আসন বিশিষ্ট। 

দেশে তখন সামরিক শাসন চলছিল। সামরিক শাসকের নিয়ন্ত্রেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন দেশের সামরিক প্রেসিডেন্ট ছিলেন সেনবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান। বাঙালিদের বিজয়ে বিহারী শাসক সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের পরিকল্পনা করলেন। ২২ ফেব্রুয়ারী ’৭১ পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেলদের এক বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপন নির্দেশ দিলেন, ৩ মিলিয়ন আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের হত্যা করুণ। তাহলে বাকিরা আমাদের বশ্যতা স্বীকার করবে”। তাঁর ধরানা ছিল নির্যাতন করে লাখ তিনেক বাঙালি হত্যা করলেই আন্দোলন থেমে যাবে’।

কালক্ষেপন করে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য ১৩ ফেব্রুয়ারী ’৭১ ইয়াহিয়া খান মিথ্যা আশ্বাস দিলেন ৩ মার্চ ’৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে। ১৬ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধুকে পার্লামেন্টারী নেতা নির্বাচন করা হয়। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান দুপুের জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বেতার ভাষণে ৩ মার্চ আহুত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বে-আইনী ভাবে অনির্দিষ্টি কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন। বেতার ভাষণ শুনে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিলেন। সারা দেশের মানুষ বাঁশের লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে এলেন। পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানো শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ৩মার্চ কে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের নির্দেশ দিলেন।

৪ মার্চ বেলুচিস্তানের কসাই হিসাবে পরিচিত লে. জে. টিক্কা খান কে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রধান প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো।২মার্চ ঢাকায় এবং ৩-৫ সারাদেশ ব্যাপী অর্ধদিবস হরতাল আহবান করলেন। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের- “আমার সোনার বাংলা...” গানটি নির্বাচিত হলো। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও জাতির পিতা ঘোষণা দেওয়া হল। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ এবং কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো হলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্র জাতির পিতা বুঝতে পারলেন।

৭ মার্চ ’৭১ রেস কোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরোওয়ার্দী উদ্যান) এ বিশ্বখ্যাতি ভাষণে জাতির পিতা বললেন- “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।...যার যা আসে তাই নিয়ে শত্রু মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাক। ১৫ মার্চ নতুন কুট কর্ম-কৌশল নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ থেকে কাল ক্ষেপন ও ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রস্তুতি মূলক কার্যাদি করার জন্য সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রহসন মূলক আলোচনা শুরু করেন। গোপনে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও গোলা বারুদ আনতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেঃ জেনারেল টিক্কা খান ও অন্যদের দিয়ে বাঙালি নিধন যজ্ঞ চালানোর জন্য “অপারেশন সার্চলাইট” পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন।

২৫ মার্চ বিকাল পৌঁনে ৬টায় আলোচনা শেষ না করে “অপারেশন সার্চ লাইট” নামক বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালানোর নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট বিশেষ বিমান যোগে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন। ২৫মার্চ’৭১ সন্ধ্যার পর পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি সৈনিক, ইপিআর ও অন্যান্যদের নিরস্ত্র করে আটক করতে থাকলো। অবস্থা বুঝে বাঙালি সৈনিক ও ইপিআর গণ অনেকে অস্ত্র নিয়ে কেহ কেহ জীবন বাঁচানোর জন্য খালি হাতে পালিয়ে এলেন।

২৫ মার্চ ’৭১ রাত সাড়ে ১১টার পর টিক্কা খান মর্টার্শেল, কামান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র নিয়ে “অপারেশন সার্চ লাইট” শুরু করে। তারা একযোগে পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, জগন্নাথ হল, ইকবাল হল ও অন্যান্য স্থানে আক্রমণ করে। ঢাকা সহ অন্যান্য শহরে গণ হত্যা শুরু করে। নিরীহ, ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। পাখির মত লোক হত্যা করে। বস্তি ও অন্যান্য স্থানে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাঙালিদের উপর মুক্তিযুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়। দেশের সার্বিক অবস্থা দেখে ও বুঝে ২৬ মার্চ ’৭১ প্রথম প্রহরে রাত ১২.২০ মিনিটে ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর নিজ বাড়িতে উপস্থিত নেতা কর্মীদের সম্মুখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষবাণী প্রদান এবং শেষ পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য থাকা পর্যন্ত বাঙালিদেরকে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।

জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ই.পি. আর এর ওয়ারলেস, মগবাজারের টেলিগ্রাম অফিস এর মাধ্যমে চট্রগ্রামসহ দেশের সর্বত্র প্রেরণ করা হয়। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা, ইপিআর, আনসার ও ছাত্র জনতা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। রাত ১.১০টার পর জাতির পিতাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ঢাকা সেনা নিবাসে নিয়ে যায়। পরের দিন জাতির পিতাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ মার্চ ’৭১ চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দুপুর ১.১০ মিনিটের পর জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষনার বার্তাটি পাঠ করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম,এ হান্নান।

২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার বার্তা পাঠ করেন তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমান। তখন সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তানি হানাদারেরা ঢাকাসহ সারা দেশে জ্বালাও, পোড়াও, হত্যা, গন হত্যা, লুটতরাজ, ধষর্ণ, নির্যাতন, নিপীড়নসহ বিভিন্ন মানবতা বিরোধী জঘণ্যতম কার্যকর্ম শুরু করল। পাকিস্তানি বাহিনী সারাদেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কার্যক্রম শুরু করলো।

৩০ মার্চ’ ৭১ জাতির পিতার স্বাধীনতার অভিযোগ এনে ইয়াহিয়া খান তাঁর ভাষণে বলেছিলেন- “মুজিব কে এবার শাস্ত্রি পেতে হবে...”। ৪ এপ্রিল ’৭১ মো: নুরুল আমিন ও অধ্যাপক গোলাম আযম সহ ১২ জন ইসলামী দলগুলোর নেতারা টেক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে। টেক্কা খান স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রলোভন দেয় যে- ‘৭ ডিসেম্বর’ ৭০ এর সাধারণ নির্বাচন বাতিল করা হবে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করার কারনে প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগ কে নিষিদ্ধ ও শেখ মুজিব কে দেশদ্রোহী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। প্রেসিডেন্টের সাথে আমার কথা হয়েছে। দেশদ্রোহী হিসেবে শেখ মুজিব এর বিরুদ্ধে মামলা করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। নির্যাতন, ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াও করে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও ভারতের দালাল হিন্দুদের কে শেষ করে দেওয়া হবে। আপনারা আমাদের সহযোগিতা করুন। পুনরায় সাধারণ নির্বাচন দিয়ে ইসলামী দলগুলোর হাতে পূর্ব-পাকিস্তানের ক্ষমতা দেওয়া হবে।’

টিক্কা খানের প্রলোভনে ইসলামী দলগুলোর অধিকাংশ নেতারা পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করলো। স্বাধীনতা বিরোধীরা পীচ কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও অন্যান্য বাহিনী করে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যোগ দিল। জীবনের ভয়ে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও এ দেশের অধিকাংশ হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় নিল। ১০ এপ্রিল ’৭১, ৭ই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ এম.এন .এ. ও. এম.পি.এ দের নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করল। ১৭ এপ্রিল’৭১ মুজিব নগরে বাংলা দেশ সরকার শপথ গ্রহণ করল।

মহান মুক্তিযুদ্ধ কী, কিভাবে যুদ্ধ করতে হবে, কতদিনে দেশ স্বাধীন হবে, একটি প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত পেশাদার হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন সম্ভব কিনা। ভারত বহিঃবিশ্বের চাপে বাংলাদেশ কে সহযোগীতা করতে পারবে কী না ইত্যাদি বোঝার বয়স তখন আমার হয় নাই। আমি তখন রতন কান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সকলের আলোচনা ও স্থানীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এ্যাড.জনাব মো: আব্দুর রহমান স্যারের কাছ থেকে সব কথা শুনে জাতির ক্রান্তিকালে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

২৩ এপ্রিল ’৭১ বিকাল ৫ টার দিকে পাক মিলিটারি বড়াল নদীর দক্ষিণ পারে এল। ওরা দক্ষিণ পারে অবস্থান নিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টির জন্য শক্তিশালী মর্টারশেল ছাড়লো। ২৩ জুলাই ’৭১,৬ শ্রাবণ ১৩৭৯ শুক্রবার হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার একটা সুযোগ এলো। আমাদের শাহজাদপুরের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এ্যাড. জনাব মোঃ আব্দুর রহমান সাহেব মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ দিতে ইচ্ছুকদের ভারতে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের গ্রামের সুনিল কুমার হাজরা সহ আমরা ২২জন এক যোগে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে উদ্দেশ্যে যাতরা করলাম। আমাদের ঘাট থেকে নৌকা ছাড়া হলো। ঝুঁকি পূর্ণ এলাকা দেখে শুনে ভোরে আমাদের কে নামিয়ে দেওয়া হলো সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া নামক স্থানের কাছে। হেটে সুজানগরের একটি নিভৃত গ্রামে গেলাম। এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম, খাওয়া দাওয়া করলাম। এম,পি,এ স্যার পদ্মা পার হয়ে কুষ্টিয়া যাওয়ার জন্য নৌকা ভাড়া করলেন। সবাই বললেন দিনের বেলা পদ্মা পার হওয়া যাবেনা।

পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকাররা স্পিড বোট দিয়ে পদ্মা নদীতে টহল দেয়। তারা নৌকা ধরলে সবাইকে নির্যাতন করে হত্যা করবে। দিনে সুজানগরের ঐ গ্রামে থাকলাম। রাত ৯টায় সাতবাড়িয়া ঘাটের নিকট থেকে নৌকা কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। রাত ২টার পর কুষ্টিয়া জেলার এক নিভৃত গ্রামে পৌঁছালাম। তারা প্রথমে কাঁঠাল গাছ থেকে কাঁঠাল পেরে মুরি দিয়ে আমাদের কে খাওয়ালেন। জানা গেল স্থানটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অদূরে পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকার ক্যাম্প আছে। গ্রামেও পীচ কমিটির সদস্য আছে। তারা জানতে পারলে সংবাদ দিয়ে পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকারদের নিয়ে এসে তাদের হাতে ধরিয়ে দেবে। পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকাররা নির্যাতন করে হত্যা করবে। ডাল ভাত রান্না হলো। আমরা তাড়াহুড়া করে খেয়ে হেটে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাতে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতেই পথ চলা। এম,পি এ স্যারের হেঁটে চলা কষ্ট হচ্ছিল।

সুনিল কুমার হাজরা, মো: এরশাদ আলী, মো: আব্দুর রাজ্জাক ও অন্যান্যরা পর্যায়ক্রমে এম.পিএ স্যার কে ধরে হাটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ভোরে নিরাপদে ভারতের নদীয়া জেলার জলঙ্গী বর্ডার পার হলাম। বর্ডারের কাছেই ছিল বি.এস.এফ ক্যাম্প। বি.এস.এফ ক্যাম্পে ঢুকে সবাই প্রস্রাব পায়খানা করে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। যার যার কাছে বাংলাদেশী টাকা ছিল তা বদলিয়ে নিলেন। এম,পি,এ স্যার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কামার পাড়া যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাবার জন্য বাস এর ব্যবস্থা করলেন। আমাদের কে নিয়ে গেলেন মালদহ শহরে। মালদহ শহরে দুপুরে বাস থামিয়ে কাঠাল ও মুরি খাওয়ালেন। এম,পি,এ স্যার আমাদেরকে সব বুঝিয়ে বালুর ঘাটের নিকটে কামার পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি প্রবাসী সরকারের উদ্দেশ্যে কলিকাতা রওনা হলেন।

আমরা রাত ৯টায় কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে পৌঁছালাম। আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। পরদিন ফলইন করিয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ানো হলো ও পিটি প্যারেড করানো হলো। আমাদের কয়েকজন কে ট্যান্টজিট ক্যাম্প কুড়মাইল ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হলো। পরের দিন মালঞ্চ ক্যাম্পে স্থানাস্তর করা হলো। পরেরদিন পতিরাম ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হলো। দুদিন পর পতিরাম ক্যাম্প থেকে আমাদের ২০/২২ জন কে ভারতীয় সেনা ট্রাকে শিলিগুড়ির পানি ঘাটা নামক মুক্তিযোদ্ধা হায়ার ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলো। পানি ঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিখ সেনা ডি.এস ভিলন এর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাদের দ্বারা বিভিন্ন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হলো। থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এল এম জি, এস.এল.আর, স্টেনগান, হ্যান্ড গেনেড, টু ইঞ্চ মর্টার , ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য এক্সপ্লোসিব ও অন্যান্য অস্ত্রের উপর ২১দিন প্রশিক্ষণ হলো। থিওরিকাল ও প্যাটিকাল প্রশিক্ষণ হলো। গেরিলা যুদ্ধের কলা কৌশল, সহযোদ্ধা শহীদ বা আহত হলে করনীয় সম্পর্কে বললেন। শিখ প্রশিক্ষক ডি.এস.ভিলন জানালেন আমার এফ এফ নম্বর হলো- ৪৭৪২। আমাকে, রবীন্দ্রনাথ বাগচী, মো: নজরুল ইসলাম, রতন কুমার দাস ও অন্যান্যদের কে পানি ঘাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ৭নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার পশ্চিম দিনাজপুরের তরঙ্গপুর নিয়ে আসা হলো। আমাদের প্রত্যেকের নামে অস্ত্র ইস্যু করা হলো। একই এলাকার রাস্তা চেনা মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ১০ সদস্যের একটি গ্রুপ করা হলো। গ্রুপ লিডার নিযুক্ত হলেন বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের জনাব এম,এ,মান্নান, ডেপুটি লীডার নিযুক্ত হলেন শাহজাদপুর উপজেলার জামিরতা গ্রামের বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী।

আমাদেরকে রেশনিং ও পকেট মানির টাকা দেওয়া হলো। তরঙ্গপুর বাজার থেকে আমি একখানা শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ, বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত একটি জাতীয় পতাকা ও একটি চার ব্রান্ডের রেডিও ক্রয় করলাম। তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে কালীয়াগঞ্জ পর্যন্ত বাসে এসে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনে শিলিগুড়ি রেলওয়ে জংসনে এলাম। শিলিগুড়ি জংসন থেকে ট্রেন বদলি হয়ে আসামের ধুবরী স্টেশনে এলাম। ধুবরী স্টেশন থেকে বাস যোগে মানিকার চর এলাম। রাত হয়ে পড়ায় রাতে মানিকার চর একটি বোডিং এ থাকলাম। পরের দিন সকালে মানিকার চর নদী পার হয়ে তদানিন্তন রংপুর জেলার মুক্তাঞ্চল (বর্তমানে কুড়িগ্রাম জেলার) রৌমারীতে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে এলাম। স্নান খাওয়া-দাওয়া করলাম। আমাদের কমান্ডার স্যার সিরাজগঞ্জ চড়ে পৌঁছার জন্য নৌকা ভাড়া করলেন।

সন্ধ্যা ৭ টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়লো। বাহাদুরাবাদ, ফুলছড়ি, জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের সম্মুখ দিয়ে আসতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈনিক ও রাজাকারদের ক্যাম্প। তারা নদী পাহারা দেয়। প্রতিটা মুহুর্ত ছিল ঝুঁকি পূর্ণ। সব চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকা। পাকিস্তানি হানাদাররা স্পিডবোট দিয়ে নদী টহল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করে। বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকায় প্রবেশের সময় কমান্ডার স্যার নির্দেশ দিলেন- ‘আপনারা সবাই নৌকার ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকুন। পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার স্পিডবেট নিয়ে ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না, যুদ্ধ করব। যুদ্ধে শহীদ হবো কিন্তু হায়েনাদের হাতে ধরা দিয়ে নির্যাতীত হয়ে জীবন দিব না’। রাত ২ টার দিকে বাহাদুরবাদ ঘাটের সম্মুখ দিয়ে নৌকা অতিক্রম করতে থাকলো।

বাহাদুরাবাদ ঘাটের হানাদারদের সার্চ লাইটের আলো এসে নৌকায় পড়ছিল। ভাগ্য ক্রমে হানাদাররা স্পিডবোট নিয়ে আমাদের কে ধরতে এলোনা। বাহাদুরাবাদ ঘাট অতিক্রম করে এক কাইশা বনের মধ্যে নৌকা লাগিয়ে দিল। আমরা প্রস্রাব পায়খানা করে নিলাম। আমাদের সঙ্গে চিড়াগুড় ছিল। সকলে চিড়াগুড় দিয়ে সকালের খাবার খেলাম। দেখে শুনে থেমে থেমে মাঝিরা নৌকা চালাচ্ছিলেন। আমরা নৌকায় ঘুম ও বিশ্রাম নিতে থাকলাম। নৌকায় ডালভাত রান্নার ব্যবস্থা ছিল। মাঝিরা ডাল ভাত রান্না করে আমাদের খাওয়ালেন। এ ভাবে মাঝিদের রান্না করা খাবার খেতে খেতে চার দিন পর ভোর ৫টায় গিয়ে সিরাজগঞ্জের স্বাধীন এলাকা যমুনার চর পৌছালাম। নৌকায় শেষরাত ও পরে দিন সারা দিন যমুনার চরে থাকলাম। পরের রাতে যমুনা পার হয়ে কামারখন্দ-বেলকুচি নির্বাচনী এলাকার এম,এন,এ জনাব মোঃ আব্দুল মোমিন তালুকদারের গ্রামের বাড়ি এলাম। এম,এন,এ স্যার বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর ভাই জনাব মো: রশিদ তালুকদার আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

আমরা বেলকুচি থানার বিভিন্ন গ্রামে থাকতে থাকলাম। আজ এখানে কাল সেখানে থাকতে থাকলাম। আমরা দিনের বেলা রেকি করতাম। রাতে আজ এ থানা কাল এ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমন করতে থাকলাম। প্রতিরাতে কমান্ডার স্যার আমাদের কে পাশওয়ার্ড দিতেন। প্রতিদিন সকালে আমরা অস্ত্রে ফুল থ্রু মারতাম ও পরিষ্কার করতাম। আমরা তিনটি হিট এন্ড রান কার্যক্রম করেছি। আমি কমান্ডার জনাব এম.এ মান্নান স্যারের কমান্ডে বেলকুচি থানা আক্রমন যুদ্ধ, কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশণ সংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প/পাকিস্তানি সৈন্য বাহি ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার অ্যাম্বুস এ অংশ গ্রহণ করেছি। ডেপুটি লিডার বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী এর কমান্ডা না ধীন হয়ে বেলকুচি থানার কল্যাণপুর ও শাহজাদপুর থানার ধীতপুর নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছি।

আমার মুক্তিযুদ্ধে যাবার সংবাদ কে ১১ সেপ্টেম্বর ’৭১ শাহজাদপুর রাজাকার ক্যাম্প থেকে দুই জন রাজাকার আমাদের বাড়িতে এসে আমার বাবা কে আলটি মেটাম দিয়েছিল - “সাত দিনের মধ্যে দেবেশ কে হাজির করে দিতে হবে, অন্যথায় শাহজাদপুর আার্মি ক্যাম্পের আর্মিরা এসে বাড়ির সবাইকে হত্যা করবে এবং বাড়ি ঘর লুটতরাজ করে অগ্নি সংযোগ করে জ্বালিয়ে দিবে।” রাজাকারদের আলটি মেটামে আমাদের পরিবারের সবাই জীবন বাঁচাতে বাড়ি ঘর সব গ্রামের মো: হোসেন আলীর জিম্বায় রেখে জীবন মরণ ঝুঁকি নিয়ে ভারতের আসাম রাজ্যের মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ দেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে আমি পূনরায় ভারত গিয়ে বাবা মা সহ পরিবারের সবাই কে দেশে ফিরিয়ে এনেছি।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সিরাজগঞ্জ।