শেলী জামান : এবারে পর্তুগালের লিসবন বেড়াতে আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মনটাতে এক ধরনের ফুর ফুরে ভাব ছিল।কারণ অনেকগুলো; এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- আমরা দু’জনেই শারীরিকভাবে খুবই ভাল ছিলাম। ভ্রমণ পথে সঙ্গে কাপড়-চোপড় নিতে প্রথম সিদ্ধান্ত বরাবরের মত এক সুটকেস, একটা হ্যান্ড ট্রলি সঙ্গে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টে দুইটা সুটকেস হলো ।কারণ দুটো সুটকেসই ল্যাগেজে দেওয়া যাবে। হ্যান্ড ল্যাগেজ সঙ্গে বহন মোটেও ভাল লাগছিল না, কারণ আমার যা উচ্চতা তাতে ওটা এয়ারক্রাফ্টের বক্সে ওঠাতে জামানের ভাঙা হাতের সাহায্য দরকার হবে। আর তা থেকে বিরত থাকা আমাদের দুজনের জন্যই বুদ্ধিমানের লক্ষণ । একবার যদি ভাঙা হাতের ব্যাথার শাখা-প্রশাখা বাড়তে থাকে তাহলে এত সাজ সাজ রব করে পর্তুগাল বেড়ানোর তাবদ মজাটা ধুলিসাৎ হবে! চার দিনের রোটারিয়ানদের বিশ্ব সম্মেলনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবারে তার পর্তুগাল ভ্রমণ। আমার গ্রীষ্মে লম্বা ছুটি এবং ছুটির অবকাশযাপনের উদ্দ্যেশে জামানের পিছু নিতে হলো।

“একা একা ঘরে শুয়ে বসে ছুটি কাটানোর চেয়ে আমার সফরসঙ্গী হয়ে যাও” জামান মানে আমার স্বামীর প্রস্তাবটা সানন্দে গ্রহণ করলাম। সাড়ে চার ঘণ্টার উড়োজাহাজ ভ্রমণ শেষে আমরা স্টকহোলম আরলান্দা আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট থেকে লিসবোনের আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। তখন স্থানীয় সময় বিকেল ৬.৩০ মিনিট। এই চার ঘন্টার ভ্রমণে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘একা এবং কয়েকজন’ বইটিতে চোখ বুলালাম। যদিও ভ্রমণের সময় অন্যকিছু নয় শুধুমাত্র বিমানে চোখ বন্ধ করে ঝিমুতে আমার ভাল লাগে। তাতে কেমন জানি এক ধরনের নেশা নেশা ঘোরের সৃষ্টি হয়।দীর্ঘসুত্রতা কমে ভ্রমণটা বড্ড সহজ হয়ে যায়। তবে সুনীলের বইটি পড়তে মন্দ লাগেনি। এটি একটি চমৎকার উপন্যাস।কয়েক পৃষ্ঠা চোখ বুলাতেই বইটি আমাকে আকৃষ্ট করে। প্রায় শত বছর আগে আমাদের বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন, চাল-চলন, বেশ-ভুষা, ধর্ম ও রীতিনীতি বিশেষ করে সমাজে বিভিন্নভাবে নারীকে মানসিকভাবে নিবৃত করা হতো তা লেখক সুন্দর ও সাবলীল করে যত্নভরে লিখেছেন পাঠকদের জন্য।বই পড়ার সময় আজকাল প্রায় হয় না, কিংবা এক ধরনের খোড়া অজুহাত বেছে নিয়েছি।বিমানের খাবার স্টেক কড মাছ, স্ম্যাস পটেটো, সালাদ, চকলেট ক্রিম, রুটি, মাখন ও চা কফি খেতে ভালই লাগলো। ক্ষুধার্ত পেটে।প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা ভ্রমণ শেষে আমরা পর্তুগালের আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স TAP এ চড়ে লিসবন এয়ারপোর্টে নামলাম। গেটে নামতেই দেখলাম জামানের রোটারি বন্ধু ও ক্লাব প্রেসিডেন্ট ক্যাথারিন ব্লুম ও তার স্বামী ড. স্টাফান ব্লুম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, কারণ আমরা উভয় পরিবারই একই জায়গায় রাতে থাকার ব্যবস্থা করেছি। আমরা যখন হোটেল বুক দেই, তখন রোটারির বিশ্ব সম্মেলনের জন্য ভালো চার বা পাঁচ তারা কোন হোটেল খুঁজে পাইনি…সব খানেই ফুল! ফুল!! তাই বাধ্য হয়ে একটা চার তারকা বিশিষ্ট এপার্টমেন্টে বুকিং দেই ।ইদানীং আবার হোটেলে থাকার পরিবর্তে এধরনের এপার্টমেন্টে নিজের সুবিধা মত থাকার জন্য এসব দেশ ব্যবস্থা করছে।ইচ্ছে করলে ভ্রমণকারীরা বাইরে থেকে খাবার কেনা-কাটা করে নিজের পছন্দ মত রান্না করেও খেতে পারে। আমরা চারজন যখন এয়ারপোর্টের বহির্গমন বড় হলঘরটিতে উপস্থিত হলাম দেখলাম উপরে নাকের ডগায় বিশাল বিলবোর্ডে রোটারিয়ানদের স্বাগতম শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। হঠাৎ পেছনে যাত্রীদের ভেতর থেকে বাংলা ভাষায় কথা বলতে শুনলাম।বাহঃ পৃথিবীর কোথায় বাংলাদেশ আর কোথায় পর্তুগাল, এতটা দূর পযর্ন্ত বাংলাভাষা পৌঁছে গিয়েছে! পরিচয় হলো উনি বাংলাদেশের রোটারি ক্লাবের একজন সদস্য।ক্যাথরিন বললো ওয়াও কি ফ্যানটাস্টিক ! এতদূর এসে নিজের ভাষায় তোমরা কথা বলতে পারছো! ও নিজেও তিনটি ভাষায় সমান দক্ষতার সাথে কম্যুনিকেট করতে পারে, সুইডিশ, ইংলিশ ও ফ্রেন্স।

অধিকাংশ সুইডিশ, ইংলিশ ভাষার পাশাপাশি হয় স্প্যানিশ, না হয় জার্মানি অথবা ফ্রেন্চ যেকোন একটি তৃতীয় ভাষা আধূনিক ভাষার শেখার ক্যাটেগরিতে স্কুলে শেখা বাধ্যতামূলক।আমরা চারজন যেহেতু পাশাপাশি এপার্টমেন্টে থাকবো তাই বাইরে এলাম একই সাথে ট্যাক্সি শেয়ার করব বলে। ট্যাক্সি স্টেশানে ভ্রমণকারীদের উপচেপড়ার মত ভীড়, লম্বা সারি। তাদের অধিকাংশই পৃথিবীর বিভিন্ন কর্নার থেকে আগত রোটারিয়ানরা যারা এসেছেন লিসবন বিশ্ব রোটারি সম্মেলন ১০৪-এ অংশগ্রহণ করবার জন্য। এক রোটারিয়ান আরেক রোটারিয়ানকে সহজেই একে অপরকে চিনে ফেলে তাদের বুকে সাঁটা রোটারি কোটপিনটি দেখে। সবায় অনেক উৎফুল্লতার সাথে একে অপরের সাথে পরিচয় করছে, হাতে হাত মেলাচ্ছে।ওখানেই পরিচয় হয়ে গেল আমাদের সাথে বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত আর জার্মানি থেকে আসা উৎফুল্ল বেশ কয়েকজন রোটারিয়ান নতুন বন্ধুদের সাথে ।ট্যাক্সি করে আমাদের এপাটর্মেন্টে বায়রো আলতো এলাকাতে আসতে প্রায় বিশ মিনিট সময় লেগে গেল। পাহাড় কেটে কেটে শহর বানানো হয়েছে। বহু বছরের পুরনো প্রসিদ্ধ শহর। ছোট ছোট চৌকনা পাথর বসিয়ে শহরের উঁচু নীচু রাস্তা বানানো। আমাদের ট্যাস্কি সে রাস্তা দিয়ে একবার ঢালুতে নামছে আবার একবার উঁচুতে উঠছে।ট্যাক্সি যতই গলির ভেতর প্রবেশ করতে থাকলো ততই আমার পাশে বসা জামানের চোখে মুখে একধরনের অসহিষ্ণুতা লক্ষ্য করলাম। ভিতরে ভিতরে মনে হয় আমার ভেতরেও একই ধরনের কিছু অনুভূতি অনুভব করতে থাকলাম যে, না জানি আমাদের সপ্তাহব্যাপির আবাসস্থলটা কেমন এলাকাতে হবে! অথচ ক্যাথরিন ও স্তেফানের ভাবাবেগে তেমন ভিন্নকিছু লক্ষ করলাম না। বরঞ্চ তারা দু’জনে খুশিমনে গল্প করে চললো, সেইসাথে জামানের সাথে পরের দিন সকাল দশটার মুল অধিবেশন শুরুর আগে বাধ্যতামুলক ডেলিগেশন পরিচয়পত্র সংগ্রহ আর রেজিস্ট্রেশনের জন্য জরুরি কথাবার্তাও সেরে ফেললো ।পর্তুগাল অস্বাভিবক একটা সুন্দর দেশ, সুইডেন থেকে একেবারেই ভিন্ন। এখানে দেখার মত অনেক কিছু আছে ও ভাললাগার একটি দেশ। আমরা তখন মনে মনে ভাবছিলাম কি জানি কেমন হবে থাকার ব্যবস্থা, আগামী ক’টা দিনের ছুটির অবকাশ কাটানোর তেরোটা বেজে গেল বুঝি ! এপার্টমেন্টের ভেতর এসে দেখি মাইক্রোওয়েভ, দুই প্লেটের চুলা, ফ্রিজ, কাপড়কাঁচা মেসিনসহ টেলিভিশন মানে একটা আধূনিক বিলাসবহুল একটি বাসায় যা দরকার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। রাত নটায় আমরা চারজন মিলে ডিনার খেতে গেলাম। বোঝা গেল পর্তুগালের প্রধান খাবারের আইটেমগুলি মাছ দিয়েই তৈরি, আমরা সবাই সারডিন, স্কুইড, স্ট্রাউট আর স্যালমন মাছের মেইন ডিস খেলাম। বিল এলো সব মিলিয়ে ১০০ ইউরো অর্থাৎ ১১০০০ টাকা। খাবারের দাম তুলনামূলকভাবে সুইডেন থেকে বেশ কমই। বড় বড় শহরে বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা হলো মেট্রোতে চলা ফেরা করা। মেট্রোতে করেই আমরা কনভেনশন সেন্টার ওরিয়েন্ট নামক জায়গাটিতে যেতাম যেখানে আয়োজিত হয়েছিল রোটারির বিশ্ব-সম্মেলন। এবারের ১০৪তম এই সম্মেলন ১৯৬ দেশের রোটারিয়ানরা প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছিলেন। সংগীত , গান ও প্রেসিডেন্ট জাপানিজ মি. সাকুজি তানাকার শুভেচ্ছা বক্তব্য, অলিম্পিকের মতই পৃথিবীর সব দেশের পতাকাবাহী সদস্যদের প্যারেড ও পতাকা হস্তান্তর অনুষ্ঠান, নানান ধরনের বৈশিষ্টমুলক সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম মধ্যদিয়ে উচ্চপর্যায়ের সুন্দর মনোজ্ঞ বিশ্বমিলন মেলা। অবশ্যই যা করছে ন্যায় নীতি, মানবকল্যাণ সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে প্রতি রোটারিয়ানরা একটা বিশ্ব পরিবারের মত । মানুষ তো মানুষের জন্য। প্রতিটি মানুষই তার অর্থ ও কর্মক্ষমতার সামর্থ্ অনুযায়ী নিজ নিজ অবস্থান থেকে অন্য মানুষের জন্য সামান্য কিছু করতে পারে। মানুষের সামান্য সামান্য প্রচেষ্টা একদিন অনেক বড় আকার ধারণ করে এমন একটা সংগঠন Me & We. ১২ বছর আগে যখন পাকিস্তানের ছোট্ট কিশোর ইকবাল শ্রমের পরিবর্তে শিক্ষার অধিকার আদায়ে জীবন দিয়েছিল। Me & We নামের এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা জেফরি জেনবার্গার তখন নিজেও ইকবালের মতই ১২ বছরের আমেরিকার ছাত্র। এই নির্দয় ঘটনাটি তার কিশোর মনে বিরাট রেখাপাত করে। তার বয়েসি একজন ছেলেরও সমান অধিকার আছে তারই মত শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্যসহ অন্যান্য অধিকার পাবার। এই উপলব্ধি থেকেই সে তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তোলে এই সংগঠনটি। এই মহতি বাস্তবায়নের জন্য সে ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে শিশুদের শ্রমের বিষয়টি অবলোকন করবার সুযোগ পেয়েছে। এখন তার সেই বারো বছর আগে গড়ে তোলা সংগঠনটির মাধ্যমে পৃথিবীর হাজার হাজার শিশু সন্তান সাহায্য পাচ্ছে এবং রোটারির মত আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একটি অরাজনৈতিক আদর্শিক সংগঠনের সাথে পাশাপাশি কিভাবে কাজ করছে তার সুন্দর একটি উপস্থাপনাসহ আরও অনেক সেমিনার বক্তৃতার আয়োজন ছিল। ১৯০৫ সালে আমেরিকান আইনজীবী পল হ্যারিস শিকাগো থেকে পৃথিবীতে মানুষ ও মনুষ্য সমাজের জন্য ভাল কিছু করার মূলমন্ত্র নিয়েই রোটারি ফাউন্ডেশনটি গড়ে তোলেন। পৃথিবীর বহু দেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ,বিশুদ্ধ পানি, রোগ প্রতিরোধ, পরিবেশ রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে নানান দেশে বহু ছোট বড় পর্যায়ে অবদান রেখে চলেছে।সুখের কথা যে রোটারির কল্যাণে পোলিওর মত শিশু রোগ চিরতরে পৃথিবী থেকে নির্মূলের দৃষ্টান্তমূলক অবদান রেখেছে । আজ মাত্র আফ্রিকার দুটি দেশ ও পাকিস্তান বাদে অন্যান্য সকল দেশ থেকে পোলিও রোগ দূরীকরণ করা সম্ভব হয়েছে রোটারিয়ানদের আন্তরিক মহতি উদযোগের কারণেই।এ যাবৎ এই লক্ষ্যে রোটারিয়ানরা নিজস্ব অনুদানে তিনশত মিলিয়ন ডলারের ফান্ড গঠন করেন যার মধ্যে বিল গেটস একাই দেড়শত মিলিয়ন অনুদান দেন POLIO PLUS প্রজেক্ট এর ফান্ড গঠনে। এই তিনটি দেশে মা্ত্র তিনশত পচাশি শিশুর প্রতিষেধক গ্রহণের ব্যাবস্থা করতে পারলেই পুরোপুরি অবলুপ্ত হবে ও সেই সাথে এই বিশাল প্রকল্পের সমাপ্তি লক্ষ্যপুরণের পথে । ভ্রমণ মানেই আনন্দ! দেখা জানা আর আমাদের অভিজ্ঞতার একটি সুন্দর সমন্বয়।আমার অন্যান্য বারের ভ্রমণগুলোর তূলনায় এবারের পর্তূগাল ভ্রমণে রোটারি কনভেনশনে জামানের অতিথি হয়ে আমার অংশগ্রহণে একটি ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে যা আমার জ্ঞানের পরিধিকে সামান্য-বৃদ্ধি করেছে বৈকি।