রিয়োসান এক অদ্ভুত পুলিশ কর্মী
প্রবীর বিকাশ সরকার : আমি যার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি সেটা যারা জাপানে আছেন তাদেরকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এটা একটি বিখ্যাত এবং আজও খ্যাতির শীর্ষে একটি জাপানি মানগা কমিকস্ এর চরিত্র। ১৯৮৫ সাল থেকেই যার সঙ্গে আমি পরিচিত। তার নাম রিয়োৎসু কানকিচি।
দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী মানগা বা কমিকস্ এবং পরবর্তীতে চলচ্চিত্র, টিভি অ্যানিমেশন [কোচিরা কাৎসুশিকা-কু কামেআরি কোওয়েন মায়ে হাস্শুৎসুজো] অর্থাৎ [এটা কাৎসুুশিকা ওয়ার্ড পার্ক পুলিশ স্টেশন] যাকে সংক্ষিপ্তাকারে জাপানিরা বলে থাকেন ‘কোচিকামে’। আসলে এটা একটি ‘পুলিশ বক্স’ বা ‘কোওবান’ এবং এর একজন পুলিশ কর্মীর কাহিনী। জাপানের এই কোওবান মেইজি যুগ (১৮৬৮-১৯১২) থেকে চালু হয়েছে এবং সারা জাপানের শহরগ্রামবদন্দরদ্বীপে জনসেবায় নিয়োজিত।
এই কোওবানের প্রধান চরিত্র হচ্ছে উক্ত রিয়োৎসু কানকিচি নামক একজন অলস, খেয়ালী এবং সার্বক্ষণিক হাস্যরসিক পুলিশ কর্মী। যার কাজ হল শহরে অপরাধীদের ধরা। জাপানিরা আদর করে তাকে ডাকেন ‘রিয়োসান’ বা ‘রিয়োচান’---বড়ই অদ্ভুত এক চরিত্র যা জাপানি সমাজে ব্যতিক্রম বটে! আবালবৃদ্ধবনিতা এমন কেউ নেই রিয়োসানকে চেনে না টিভির কল্যাণে। যদিওবা কমিকস্ স্ট্রিপ ম্যাগাজিনের মাধ্যমেই অগণিত পাঠকের কাছে এই বিরল চরিত্রটি প্রথম পরিচিতি লাভ করেছে। তবে প্রচলিত বিশ্বাস: এহেন চরিত্রের একজন মানুষ বাস্তবেই জীবিত ছিলেন একসময় এবং এই কাৎসুশিকা অঞ্চলেই। এবং সেই কোওবানটি এখনও বর্তমান।
আমি থাকি এই টোকিওর কাৎসুশিকা ওয়ার্ডের ওহানাজায়া নামক শহরে যা কামেআরি শহরের প্রতিবেশী। দুটো শহরের ঠিক মাঝখানে আমার বাসস্থান। প্রতিদিন সকাল-বিকেল রিয়োসানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে কামেআরি রেলস্টেশনে (ছবি নং ২) যেখানে তার দুটি স্মারক ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে বছর কয়েক আগে। এই অসামান্য সর্বদা স্যকৌতুকমনস্ক মজাদার কিন্তু মানবিক গুণে গুণান্বিত চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন এই ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা মানগাকা বা কার্টুনিস্ট ওসামু আকিমোতো (১৯৫২-)। যদিওবা প্রথমে তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন তাৎসুহিকো ইয়ামাদোমে নামে। যখন কার্টুনটির সিরিজ ১০০ পূর্ণ হয় তখন প্রকৃত নাম উন্মুক্ত করেন ১৯৭৮ সালে।
কোচিকামে কমিকস্ প্রথম প্রকাশিত হয় সবচেয়ে জনপ্রিয় মানগা ম্যাগাজিন ‘শুউকান শোওনেন জাম্পু’তে ১৯৭৬ সালে। ব্যতিক্রমী গল্পের কারণে এটা প্রকাশের পরপরই জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। উল্লেখ্য যে, ঐতিহ্যবাহী উপশহুরে বা আঞ্চলিক বিনোদন ‘রাকুগো’ বা ‘কৌতুক গল্পবলা’র রীতি এই কমিকস সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলেছে। জাপানিরা স্বল্পভাষী এবং গম্ভীর স্বভাবজাত হলেও খুবই কৌতুকপ্রিয় জাতি। যে কারণে এই দেশে মানগা বা কমিকস্, কার্টুনের বিস্তর ছড়াছড়ি---কোনো কূলকিনারা নেই! ‘রাকুগো’ও একটি সংস্কৃতি এই দেশে। টিভি চ্যানেলগুলোতেও একাধিক কৌতুকানুষ্ঠান চালু আছে। চালু আছে একাধিক অ্যানিমেশন। প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন কোনো না কোনো মানগাবিষয়ক ম্যাগাজিন এবং সিরিজ গ্রন্থ। মানগা ও অ্যানিমেশনের স্বর্গভূমি হচ্ছে জাপান। মানগা আজকে জাতীয় কিয়োতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত পড়ার বিষয় বিশেষ! বিশ্বখ্যাত কেইওগিজুকু বিশ্ববিদ্যালয়ে সমৃদ্ধ মানগা গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে সম্প্রতি। আর এই মানগাকে জনপ্রিয় করার পেছনে কোচিকামে মানগার অবদান অনেকখানি।
কোচিকামের মানগাচরিত্র রিয়োসান এতই জনপ্রিয় যে তার প্রমাণ মেলে ১৭০০টি এপিসোড বা অধ্যায় প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই অধ্যায়গুলো সর্বমোট ১৯২টি গ্রন্থের সমাহার। এই পর্যন্ত এত বহুসংখ্যক একক মানগার গ্রন্থ জাপানে প্রকাশিত হয়নি---২০১২ সাল পর্যন্ত ১৫৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। জনপ্রিয়তার কারণে এর একাধিক মঞ্চপরিবেশন এবং চলচ্চিত্র নির্মিত হওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯৭৭ সালে খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা কাজুহিকো ইয়ামাগুচি (১৯৩৭-) একে প্রথম চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করেন। ফুজি টিভি চ্যানেল অ্যানিশেন সিরিজ তৈরি করে ১৯৯৬ সালে চলে একটানা ২০০৪ সাল পর্যন্ত। টিভি সিরিজচিত্র নির্মিত হয় ২০০৯ সালে টিবিএস বা টোকিও ব্রডকাস্টিং সিস্টেম কোম্পানি কর্তৃক। ২০১১ সালে আরেকবার চলচ্চিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রভাবশালী আসাহি টিভি কোচিকামেকে ১০০ সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের তালিকায় ৩৬ নম্বরে স্থান দিয়েছে। ভিডিও গেমসও তৈরি হয়েছে অনেক আগে। শিশুদের প্রিয় ক্যারেক্টার গুডস হিসেবেও অত্যন্ত জনপ্রিয় রিয়োচান।
এই একটি মানগা লিখেই ওসামু আকিমোতো বিপূল টাকাকড়ির মালিক আজকে।
লেখক : জাপান প্রবাসী